বৃষ্টিটা আবারও শুরু - বুক দুরু দুরু। বড় বড় ফোটায় পথ ডুবে যায়। ঝিঁঝিঁ ডাকে। সোনা ব্যাঙ ঘ্যান ঘ্যান করে ।ঢেউ কাটা টিনের চালে তাল দেয় ঝম ঝম বাদল । ঘরের বেড়ার নিচে পানি হামাগুড়ি দিয়ে ঢোকে দমকা বাতাসে। সেগুনের উঁচু পালঙ্কে বসে থাকে কমলা স্যালোয়ারের মেয়ে প্রীতি। চিকন বাদামী হাত। রিন ঝিন রেশমী চুড়ি নড়ে চড়ে। সে চঞ্চলা হয়। আমি শিমুলতলী ফিরতে চাই। প্রীতিও চায় না আমি আজ রাতে থাকি।
তবে যতক্ষন মেঘ আটকায় তার সঙ্গে গল্প করা ছাড়া উপায় নাই। ছোট ভাইটা শুয়ে হা করে গিলে আমাদের আলাপ। অন্যঘরে ডাক আসে, আজ না হয় থাইকা যা তুই - কী আর অইবো রাতে চিতই পিঠা বানাই, চাইলের রুটি আর মুরগী। আমি জবাব দেই, না খালা, অনেক কাম।
শিমুলতলীতে আমার ফিরে যাওয়া দরকার।শো শো বাতাসটা থামে, ঘরের ভেলকী কম নড়ে চড়ে। ফোটা বড় হয়। জলের মুষল ধারায় জানালায় আবছায়া। বিছানায় একরীডের হার্মোনিয়ামে প্রীতি গান ধরে- কী আর করা ভাইজান, তোমারে একটা গীতই শুনাই । খালা আওয়াজ শুনে আবার ডাকে, ওরে প্রীতি, তোর ভাইরে ইস্কুলের গানটা শোনা, ভুল অইলে ঠিক কইরা দেউক। আমি অন্যদিন গান করি। আজ না। আর হাঁটু মুড়ে বসে গান গান গায় প্রীতি। কালো চোখ। দুই বেনী দুই দিকে। চোখে চোখ পড়তেই - পরিচিত দৃষ্টিটা ঘন হয় -প্রীতি আমাকে বোঝে। গুড়ি গুড়ি ধারায় হালকা হয় বর্ষার ধারা। বিকেল সন্ধায় মাথা হেলতে থাকে। আমি উঠিরে, বলি। খুব কাছে আসে প্রীতি, তারপর ফিস ফিস করে কথা হয়। জোরে মা কে শুনিয়ে বলে,আচ্ছা ভাইজান, সাবধান যাও।
শিমুলতলীতে আমার ফিরে যাওয়া দরকার। বাইরে কল কল পানি বয়ে যায় এধার ওধার । কড়ই গাছের গুঁড়ি ফেলে যদি কিছুদুর যাওয়া যায়, বাকিটা গুটাতে হবে পায়জামা।কালো এঁটেলে জমে যাবে চামড়ার জুতা। পানি বয়ে বয়ে মিশে যায় ছোট নালাতে, নখ ঢুকে যাবে ভাঙা শামুকের খোলে, ঢোঁড়া সাপের ছানা এঁকে বেকে পার হতে থাকে। ধান ক্ষেতের আল ভেঙে বিপদের আশংকা। জমিনে সাদা খড় আর সবুজ ঘাস বৃত্তাকারে পাক খায়। তবুও হাঁটতে হবে
শিমুলতলীতে আমার ফিরে যাওয়া দরকার। চপ চপ পায়ের শব্দে পায়ে পানি উঠে আসে। অন্ধকার পড়তে থাকে। হাতে জং ধরা রূপালী টর্চ। চান্দা ব্যাটারী।গোল মৃদু আলো। পথ মির্জাবাড়ীর মধ্যে ঢুকে পড়ে। আম গাছের পাতা থেকে জমানো পানি ঝরে মাথার ওপর।
দুরে বাড়িতে বাড়িতে টিম টিম কুপি বাতি উঁকি দেয়। তারার মতো মিট মিট করে। এভাবে আরও দেড় মাইল পথ গেলে ময়নার দোকান থেকে রিক্সা ডেকে তুলতে হবে। দোকানের ঝাঁপি খুলে চাদর মুড়ি দেয়া রিক্সাওয়ালা জেগে যাবে। তারপর রিক্সার সীটটা সোজা করে বসায়ে ঘুম ঘুমে বলবে, উঠেন।
শিমুলতলীতে আমার ফিরে যাওয়া দরকার ।শিমুলতলীর ইয়াসমীন কে দেখে পছন্দ করেছে অন্যপক্ষ। আমি লজিং থাকি অন্যগ্রামে। মাত্র দুদিন বাকি। সময় অল্প। মনটা অস্থির, কালো। প্রীতি থাকাতে রক্ষা। আজ রাতে বিবাহের কন্যার গোপনে পালানোর কথা।
ঝড় বৃষ্টি, আলো, আঁধার, নদী, রেল - যে করেই হোক সুর্য ওঠার আগে নিরুদ্দেশ হতে হবে।