দু:খী সবুজ পাতা আগের পর্ব
৩
তেতুল গাছের আজ খুব ব্যস্ত দিন। গাছের উপরে একটা খোড়লে ফাটল ধরেছে। কাঠঠোকরা এসেছে ভোরে। সে নষ্ট হয়ে যাওয়া গাছের অংশটা ঠুকরে ঠুকরে আলাদা করে দিচ্ছে। এবার প্রচুর তেতুল হয়েছে। সেগুলো নিয়ে যেতে এসেছে বুলবুলি।
এর মধ্যেই তেতুল গাছটা দেখতে পায় ছোট্ট লতানো পাতাটার মন খারাপ। সে একদৃষ্টে দীঘির পানির দিকে চেয়ে আছে। তেতুল গাছ আস্তে করে জিজ্ঞেস করে, মাগো, এত বেশী মন খারাপ কেন তোমার? উপরে চেয়ে দেখো কি দারুণ রোদ!হিমালয় থেকে দেশান্তরী পাখীরা বেড়াতে এসেছে।
ছিটে পাতাটা ঘাড় ফিরিয়ে লজ্জা পেয়ে চোখ মুছে ফেলে। তেতুলের পাতারা তাকে খুশী হতে দেখে আনন্দিত হয়।
ঠিক এমন সময় দ্রুত গতিতে কিছু একটা ছুটে আসে তার দিকে। একগাদা তেতুল পাতা ঝর ঝর করে নিচে পড়ে যায়।একদল স্কুলপালানো ছেলে পাকা তেতুল পাড়ার জন্য গুলতিতে মার্বেল ছুড়ে মারছে। মার্বেল তো নয় যেন গুলি। ক্রমাগত মার্বেল উড়ে আসছে। তেতুলে না লেগে ডালে আর পাতায় লাগছে। ছিটে পাতা মাথা নিচু করে মায়ের সঙ্গে প্রার্থনা শুরু করছে।
ছিটে পাতার ঠিক কান ঘেষে একটা মার্বেল সদ্য গজানো অঙ্কুর ছিন্ন ভিন্ন করে চলে যায়। পাতারা সমস্বরে ভয়ে বিলাপ করতে থাকে। ছেলেগুলো এমন কেন? তারা কেন বুঝতে পারে না পাতাদের কত কষ্ট হয়? কিছুক্ষণ পর সেই বালকেরা চলে গেলে বন্ধ ছিটে পাতা চোখ খোলে। সে দেখে তার তার সেজ বোন কষ্টে ব্যথায় চিত্কার করছে। বোনের হাত পা মার্বেলের গোলায় ছিঁড়ে গেছে।
মাসখানেক পর আবহাওয়া বদলে যেতে থাকে। দমকা বাতাস বয়ে যায়। সাধারণত: অল্প বাতাসে তেতুল গাছের কিছু হয়না। তবুও ছিটে পাতার মনে হয় তার মায়ের গল্পটা। তেতুল গাছ ছিটে পাতাকে বলে,মাগো, গাছ হতে হলে আর শক্ত হতে হয়। এভাবে তেতুলের স্নেহে দু:খী ছিটে পাতা ভুলে যায় অনেক কষ্ট।
৪
গাছটাকে কিছু জোরে কাঁপাচ্ছিল। তেতুল গাছ খুব ভোরে ঘুমের ঘোরে ধরফড় করে ওঠে। তারপর যা দেখে রক্ত হীম। কয়েকজন কাঠুরে কুড়াল দিয়ে তার সবচেয়ে বড় ডালটা কাটছে। এরই মধ্যে ঠুক ঠুক শব্দে ছালবাকল খুবলে নেয়ায় তারা ব্যস্ত। লোকগুলোর চেহারা যেন কঠিন, দয়া মায়াহীন। দয়া মায়া থাকলে কেউ গাছ কাটতে পারে? ব্যথায় চিৎকার করে সাহায্য চায় তেতুল গাছ। বলে, এই গাছ তোমাদের, তোমরা একে কেটে ফেল না! কিন্তু গাছেদের শব্দ মানুষ শুনতে পায় না। ওরা আরো জোরে গাছের ডাল কাটতে থাকে।
তেতুলের শিশু পাতাদের মরাকান্নায় চারদিক ছেয়ে যায়। ছিটে পাতা ছোট্ট চোখের পাতায় তখনো ঘুম জড়ানো,সে কিছুই বুঝতে পারছিল না। তেতুল গাছকে সে কখনো কাঁদতে দেখেনি। সে দেখে তার মার চোখে পানি। সে প্রার্থনা করছে যাতে কাঠুরে চলে যায়। ছিটে পাতা তখনই বিলাপ করতে থাকে - বাঁচাও মানুষেরা, এমন কাজ তোমরা করো না। কেউ শুনতে পায় না অথবা শোনে না। মগডালটা বিকট শব্দ করে ভেঙে পড়ে যায় নিচে। মা-- বলে আর্তনাদ করে ওঠে তেতুলের বিশাল শরীরটা।
কাঠুরেরা ততক্ষণে একটু ক্লান্ত হয়। কাঠ কাটা থামিয়ে তারা তখন খেতে যাবে।
একটা বিকট চেহারার কাঠুরে গাছ বেয়ে উপরে উঠছে। কেন? তার লাল টকটকে চোখ ছিটে পাতার দিকে। গাছের কান্ড বেয়ে উপরের দিকে উঠে আসে। থপ থপ শব্দ হয়।
শুনেছে মানুষ পাতা থ্যাতলে ঔষধ বানায়। কখনো গরম করে সিদ্ধ করে খায়। মানুষের মতো পাষন্ড আর স্বার্থপর কেউ নেই। ছিটে পাতা তার মাকে আঁকড়ে ধরে চোখ বন্ধ করে। কাঁপতে থাকে। মাও। স্পষ্ট দেখতে পায় - ভয়ংকর লোকটার হাত তাকে ছিঁড়ে নিচ্ছে। ছোট্ট দু:খী পাতার মনে হয় সে অজ্ঞান হয়ে যাবে।
কিন্তু সৌভাগ্যক্রমে লোকটা খুব কাছে এসেও তাকে ধরে না। সে চট করে পানের সবুজ পাতাগুলো ছিড়ে নেয়। কয়েকটা মুখে পোরে। রাক্ষসের মতো দাঁত দিয়ে চিবাতে থাকে। টুপ টুপ করে পানির মত রক্ত ঝরতে থাকে পান গাছের লতা থেকে।
পরপর কয়েকটা নিষ্ঠুরতা দেখে ছিটে পাতার চোখ তখন শুষ্ক।
সবুজ পানপাতাকে সে হিংসা করতো। সুন্দর হয়নি বলে তার আক্ষেপ ছিল । অথচ এত সুন্দর হয়েও কত সহজে তারা নিহত হয়ে গেল।
( ড্রাফট ১.০ - বানান ও বিন্যাসের ভুলগুলো মার্জনীয়)