১
তোমরা হয়তো জানো না - গাছের পাতারাও আমাদের মতো। তাদের কষ্ট থাকে। তারা অভিমানে মন খারাপ করে। সকালে আড়মোড় ভেঙে সুর্যোদয় দেখে। বিকেলের রোদ পোহায়। মায়ের কোলে নাক ঘষে। মায়ের দেহের নরম আদর নিয়ে থাকে সারাজীবন।
গল্পটা এক সবুজ লতানো পাতার। ভাইবোনদের মধ্যে সে সবচেয়ে ছোট। ছোট পাতাটার জন্ম থেকেই অনেক বুদ্ধি, মাথায় রাজ্যের প্রশ্ন।
কাঠবিড়ালী দেখে পিটপিট করে তাকিয়ে মাকে বলে, মা আমাদের পা কোথায়? প্রজাপতি তার নাকে বসতেই তার সুড় সুড়ি পায়। হি হি করে বলে, আচ্ছা মা আমারও কি ডানা হবে? আকাশে চাঁদের আলো তার গালে টোল ফেলে। সে বলে মা, আমরা কি একদিন অমন আলো জ্বালবো? পুকুরে মাছেদের সাঁতার দেখে বলে, মা আমরা কি অমন সাঁতার কাটতে পারবো না?
মা তখন বুঝিয়ে দেয় যে পাতারা হলো লতানো গাছ। প্রজাপতি প্রজাপতিই। মাছ মাছই। প্রকৃতিতে সবাই আলাদা আলাদা। যার যার মতো হয়েই সারাজীবন থাকতে হবে।
তবে গাছেরা প্রাণীদের চেয়ে নিরীহ আর শান্তিপ্রিয়। বাতাস বইলে তারা হেলে দুলে খেলতে থাকে। মানুষের মতো ঝগড়া করে না। কখনো খেলতে খেলতে বোঁটা মচকে কঁকাতে থাকে। আবার নিজেই সেরে যায়।
ছোট পাতার মা অনেক রাত পর্যন্ত জেগে কাজ করে। বাতাসে ভেসে আসা কার্বন ডাই অক্সাইডের কনা ধুয়ে মুছে অক্সিজেন বানায়। সেই শিশু পাতাটা মাকে সাহায্য করে। সে এত ছোট যে খুব দ্রুত হাঁপাতে থাকে। অল্প কাজের পর ক্লান্তিতে দু চোখ বুঁজে আসে।
রাতে পাতার মা সব ভাইবোনকে তার শিশুবেলার গল্প বলে। পাতার মায়ের জন্ম অনেক দুরের কোন অজানা দেশে। তার মায়ের যে মা, মানে ছোট সবুজ পাতার যে নানী - তার ছিল বিরাট পরিবার - একটা দীর্ঘ লতিকায় ১০০টা ছেলেমেয়ে একত্রে থাকতো। বনের ভিতর একটা হ্রদের তীরে বাঁশের কঞ্চি লতিয়ে থাকতো তারা। খুব সুখে ছিল তারা।
ছোট বেলায় তারা দেখতে পেত দুরে ধবল পাহাড় আর অনেক মেঘ। দেখতো রূপালি বৃষ্টির ফোঁটা ঝরছে। সেসব গল্প বলতেই ছোট পাতাটার চোখ চকচকে করে ওঠে। সে সেখানে যেতে চায়। কিন্তু পাতার মা গল্পটা বলতে বলতে এক সময় চুপ হয়ে যায়।
তার পর বলে এক বৈশাখী ঝড় তাকে উড়িয়ে নিয়ে আসে তার মা ভাই বোন থেকে। সে আর জানেনা তার মা বেঁচে আছে কিনা আর কোথায় আছে তার বোনেরা।
২
যখন ঝড় উড়িয়ে নিয়ে যায় পাতার মা ভাবছিল আর বাঁচবেনা। একটা উঁচু তেতুল গাছ ঝড়ে উড়ে যাওয়া সময় বুকে আশ্রয় দিয়ে তাকে বাঁচায়।
ঝড় থেমে যায়। তেতুল গাছটা সেই পাতাটাকে সাহস দিয়ে যায়। সে সময় পাতার মা পাতার মতই ছোট, নিজে খেতে পারতো না। ধীরে ধীরে তার পায়ে পানি খাবার শেকড় গজায়। বাতাসের বাষ্প থেকে পানি নিয়ে সে বাঁচতে শেখে।
মা বলে আমাদের সৌভাগ্য, এই বনে তেতুলের মতো ভাল গাছ আর হয় না । যেমন অল্প দুরে ঝাউ বনের পাতা খুব রূক্ষ। তারা লতাদের দুচোখে দেখতে পারে না। আর শাল, মান্দার, দেবদারু এরা ভাল হলেও নিজের কথা বেশী ভাবে।
উঁচু জাতের গাছদের কেমন যেন একটা গর্ব থাকে। অথচ তেতুল গাছ এমন বিনয়ী আর উপকারী যে মনে হয় সেও লতাদের সমান। বড় হয়েও প্রতিদিন খোঁজ নেয় আশ্রিত লতাপাতাদের।
আর তেতুল এত পুরনো এবং শক্ত যে ঝড়ে কিছু হয়না। বরং যেদিন বৃষ্টি হয় চিরুনীর মতো তেতুলের সব ছোট পাতারা খুশীতে হাত ধরা ধরি করে নাচতে থাকে।
মায়ের দেহটা একটা মাঝারী ডাল কে প্যাচিয়ে আছে। আর সেই নরম লতানো ডগার শেষ মাথায় শিশু পাতাটার জন্ম। লতানোর সময় নিজেকে নিয়ন্ত্রন করা সোজা না।
কখনো আশ্রয়দাতা গাছের নিজের পাতায় ঘষা খেয়ে ব্যথা পায়। কিন্তু তেতুল বিনয়ের সঙ্গে বলে, সবাই এক বড় পরিবার, চলো কষ্টটা ভাগ করে নেই। আমার এত বড় গাছটা লতা গুল্ম না থাকলে খালিই পড়ে থাকে।
ছোট্ট সবুজ পাতাটা মার কথা মতো চারদিকে চেয়ে দেখে কত নানান রকম গাছ আর কত বিচিত্র তাদের পাতা। লতানো গাছের মধ্যেও কত জাত। যেমন একটা লজ্জাবতী নামে একটা অদ্ভুত পরিবার এসেছে চিকন ডালটাতে। তারা যেন একটু বেশী ভদ্র। দেখতে অনেকটা তেতুল পাতার মত । তবে লজ্জাবতী খুব হাসির - সবুজ পাতা একটু কিছু বললেই সব ভাইবোন চোখ বুঁজে ফেলে।
লজ্জাবতীর সবচেয়ে দুষ্টু যে মেয়ে, সে সবুজ পাতার সই। তাকে মাঝে মাঝে ক্ষেপায়, এই ছিটে পাতা এই ছিটে পাতা। ছিটে বললে ছোট্ট পাতাটা মনে মনে ক্ষেপে যেত। তার ধারণা সে সবুজ। সে চাইতো সবাই যেন সবুজ বলেই ডাকে।
অন্যডালে আরেকটা লতা এসেছে কিছুদিন আগে। পাতাটা এই ছিটেপাতার মতই। কিন্তু খুব বদমেজাজী। আর গলাটা কি ভারী! পাতার নাম পান পাতা। মন ভাল থাকলে পান পাতা বলে, আমার রক্তে ঝাঁঝ বেশী - তাই মাথা ঠিক থাকে না।
তেতুল গাছে ঠিক নিচে ছিল একটা বড় দীঘি। টলমল পানি। মাছেরা বুদবুদ উড়িয়ে খেলতে থাকলে ছিটে পাতা মুগ্ধ হয়ে তা উপভোগ করে। একসময় পানি স্থির হয়। যেন কাঁচের আয়না। একদিনে সেই ছিটে পাতা সেখানে নিজের চেহারা দেখে আঁতকে ওঠে - তার সবুজ গালে ছোপ ছোপ বিশ্রী সাদা রং ভরা। অথচ সে নিজেকে ভেবেছে পান পাতার মত সবুজ আর সুন্দর। সেতো তখনো বড়দের মতো শক্ত হয়নি। কি করবে বুঝতে না পেরে তার মায়ের মতো চুপ হয়ে থাকে।
শিশিরের জলে তার চোখ ভিজে যায়। অনেকক্ষণ সেই গভীর জলে নিজেকে দেখে ফোঁপাতে থাকে। আর টুপ করে ফোটা ফোটা পানি পড়ে দীঘিতে।
শুধু তারপর বুঝতে পারে তার মায়েরও এমন ছোপ ছোপ দাগ। তার ভাইবোনেরও। এটা তাদের জন্মগত দোষ। তার দাগটা হয়তো ছোট বলে অনেক বেশি স্পষ্ট। ।
পাতাটা পানিতের তার ছায়ায় তাকিয়ে প্রশ্ন করে পৃথিবীটা কেন এমন স্বার্থপর? সে লতানো দুর্বল শরীরের গাছ, আর একটু সবুজ রঙ দিলে পৃথিবীর এমন কী ক্ষতি হতো?
( ড্রাফট ১.০ - বানান ও বিন্যাসের ভুলগুলো মার্জনীয়)