তখন রঙিন টিভি ছিল হাতে গোনা। ছুটির দিন সকালে টিভিতে মজার মজার অনুষ্ঠান হতো। আর তার জন্য বাচ্চারা চুম্বকের মতো বসে থাকতো। স্কুলে গিয়ে কে কী দেখেছে গল্প চলতো।
ঠিক যখনই প্রিয় কার্টুন বা সিরিয়ালে ডুবে যাচ্ছি, মা কানের কাছে কট কট কট কট করতে থাকতো। যেন ভাঙ্গা কলের গান, "ঝন্টু! ঝন্টু--এক্ষুনি গোসল করতে যা, গোসলে যা, তোর পরে পিন্টু, জেসমিনের গোসল বাকি"। পানি থাকতো না। টাইম মতো বালতি ভরে ভরে গোসল করতে হতো। গোসল করা, দোকানে যাওয়া, পড়তে বসা, খাওয়া দাওয়া এসব সিলি জিনিস নিয়ে চিল্লাপাল্লা কার ভাল লাগে ?মনে হতো মায়ের মতো বিরক্তিকর মানুষ জন্মের পর আর কাউকে দেখিনি।
মা চিল্লানিগুলা যথারীতি ৮০% কানের ডান সাইড দিয়ে বের করে দিতাম, ২০% রাখতাম বিপদের আলামত হিসাবে।
অবশ্য একটু বড় হতেই মায়েরা রাগের একটা সুত্র আবিষ্কার করে ফেলেছিলাম। মা বাপের মত সে হুট করে ক্ষেপতো না । সে ছিল ডিজেল ট্রেনের ইঞ্জিনে মতো - স্পিড বাড়ে আস্তে আস্তে। যতক্ষণ স্পিড বাড়ছে, কুছ পরোয়া নেহি। ফুল গিয়ারে গেলে চুপ থাকতে হবে। তখন ঘরের বারান্দা কাঁপতো। বাবা পর্যন্ত চুপ থাকতো।
সেদিন ভাবছিলাম যে মা বকবক করুক, আমিও পিছলাতে থাকি, যেমন " হয়ে গেছে, যাইতাছি আম্মা, এই তো আর ২ মিনিট" । ঠিক মতো পিছলাতে পারলে আধাঘন্টাও বিষয় না। শুধু ভাতের ডেকচি টগবগে ফুটার আগে আগে গোসল খানায় দৌড় দিতে হবে। আমরা থাকতাম ২ রুমের ছোট বাসায়, টিভির রুমটা রান্না ঘরের কাছে। মায়ের হাতের নাগালে।
সেদিন কপালটা মন্দ। মায়ের কি নিয়ে যেন মেজাজটা টং, উপরন্তু আলটিমেটাম না শোনায় ক্ষেপে গিয়েছিল। তারপর যা হবার তাই। শেখ সাহেবের ভাষনের মতো হাতের কাছে যা কিছু আছে তাই নিয়ে আমার উপর মা ঝাপিয়ে পড়েছিল। হাতের কাছে আর কী থাকে? ঐতিহাসিক ডালঘুটুনি আর শাক নাড়ানোর বাঁশের কাঠি।
মা মারতো তবে বাবার মতো সুদক্ষ ছিলনা। আমি চান্স পেলেই এদিক ঐদিন নড়তাম। তেড়া বেকা মার পড়তো, পিঠে, কাঁধে..সাধারণত দৌড়ে বাইরে চলে যেতে পারতাম। দাঁড়িয়ে মায়ের ঠান্ডা হওয়ার জন্য অপেক্ষা করতাম।
সেইদিন এমনই দিন, পড়েছিলাম মাইনকা চিপায়। মাইর শুরু হয়েছে কিন্তু দৌড় দিতে পারি নাই। ডালঘুর্ণিকার দন্ডের তৃতীয় আঘাতটা ঘাড়ের সাইডে পড়তেই আমি উল্টে মাটিতে পড়ে অজ্ঞান। মা ভাবছিল অভিনয় - পরে বুঝতে পারলো আমি আসলেই মুমুর্ষু। মুখ দিয়ে ফেনা বের হচ্ছে। মা চিল্লাতে লাগলো, "আল্লারে কি করলাম!"
আমি চোখচেপে পেট ফুলানো বন্ধ করে ভাবছি- এইবার বুঝুক সে। মাথায় পানি দেক তাও জ্ঞান ফিরাবো না। মিনিট তিনেক পর চোখ খুলতেই দেখি মা কাঁদছে অঘোরে, আমাকে বুকে চেপে আছে শক্ত করে।
তখন বুঝিনি । হেসেছিলাম। এখন অনেক দুরে থাকা মায়ের সেই চোখগুলো মনে পড়ে। মনে হয় - মা রে! এই অধম সন্তানের জন্য তুমি ছাড়া এমন করে আর কেউ কাঁদতে পারেনা!