এক
আপনাকে যদি প্রকৃতির যেকোন একটি নিয়ম বদলে ফেলার সুযোগ দেয়া হতো, তাহলে আপনি কী বেছে নিতেন? রাতে ঘুমের বদলে কাজ, আর দিনে ঘুমের নিয়ম করতেন? বৃষ্টিকে নিজের ইচ্ছামত নামাতেন?
আমি হলে কী করতাম বলতে পারি। একটা সময় সব কিছু শেষ হয়ে যাবে- সুযোগ পেলে প্রকৃতির এই অমোঘ নিয়মটাই আমি বদলে ফেলতাম। মানুষ তো চাইতেই পারে, তার প্রিয়মুখগুলো এই ধরণী থেকে আস্তে আস্তে হারিয়ে না যাক! পারে কি? নাকি সেই স্বপ্ন দেখা অযৌক্তিক?
দুই
আমি স্বপ্ন খুব কম দেখি। সম্ভবত এর কারণ আমি যখন ঘুমাই, বেঘোরে ঘুমাই। চারিদিকের কোনকিছুর আন্দাজ থাকে না। অনেকে আছেন ঘুমন্ত অবস্থায় পাশ দিয়ে হেঁটে গেলেও ঘুম ভেঙ্গে যায় তাদের। খুবই সজাগ থাকেন। আমি এরকম পারিনা। এটা ভার্চুয়ালি আনার কোন সিস্টেম থাকলে ভালো হত। সেটা নেই।
যাহোক, বলতে চাইছিলাম আসলে স্বপ্ন নিয়ে। আমি সেহরির পর ঘুমাতে যাই। পুরনো অভ্যাস, ৪ টার আগে ঘুম আসে না। গতকাল সেহরির পর ঘুমিয়েছি ৬ টা থেকে ১০ টা পর্যন্ত। এ সময় কম করে হলেও ২০-২৫টা স্বপ্ন দেখেছি। নিশ্চয়ই আমার ঘুম অনেক হালকা ছিলো। আমার ঘুম হালকা হলেই কেবল আমি স্বপ্ন দেখি বা স্বপ্ন দেখলে সেটা আমার মনে থাকে, অন্যদের কথা জানিনা। এই স্বপ্নগুলোর কয়েকটা বিচ্ছিন্ন, আর কয়েকটা আবার একটার সাথে অন্যটা জড়িত। সবগুলোই গত কয়েকদিনে আমার চিন্তাভাবনার ফসল, এটা বুঝতে পারলাম। মজার ব্যপারটা হচ্ছে, এটা আমি ঘুম থেকে জেগে ওঠা পর বুঝিনি। এক একটা স্বপ্ন দেখার পর আমি কিছু সময়ের জন্যে আধো-ঘুম, আধো-চেতনার একটা স্তরে চলে যাচ্ছিলাম, তখন বুঝেছি। এই ব্যপারটাও সাধারণত আমার হয় না। অন্যদের হয়। আমার হয়না কারণ গভীর ঘুমে থাকলে মস্তিস্কের এই আধো-ঘুম, আধো-চেতনার সেন্টার টা খোলা যায় না। এটার একটা নাম ছিলো জানতাম। মস্তিস্কের সবগুলো স্তরেরই নাম আছে, আলফা বিটা গামা জাতীয় নাম। কোনটার কী নাম তা এখন মনে পড়ছে না। আমি খেয়াল করে দেখলাম আধো-ঘুম, আধো-চেতনার স্তরে গেলেই মানুষের মস্তিস্ক সবচেয়ে ভালো কাজ করে, যুক্তি দিয়ে সবকিছু ভাবতে পারে। সম্ভবত এই স্তরের নাম থিটা। এখানে কাজ করার একটাই সমস্যা, পূর্ণ জাগরণের পর এখানে ঘটা সমস্ত ঘটনার প্রায় পুরোটাই মেইন মেমোরী থেকে মুছে যায়। অদ্ভুত না? ওই স্তর মেমোরী তৈরী করতে পারে না। অনেক বিজ্ঞানী আছেন (বা ছিলেন) যারা এই স্তরে পৌছে অনেক জটিল চিন্তাভাবনা করে গেছেন, এবং যেহেতু তারা জানতেন পুরো জেগে উঠলে এসব মনে থাকবে না, তাই সেগুলো তারা লিখে গিয়েছেন। এরকম উদাহরণ পড়া হয়েছিলো, এখন মনে নেই।
ঘুম থেকে ওঠার পর কিন্তু এমন হবে না, যে ব্যাপারটার কিছুই মনে নেই। মনে থাকবে ভাসা ভাসা, কিন্তু কোন খুটিনাটি বিষয় কিছুতেই মনে করা যাবেনা। এই যেমন তখন আমার স্বপ্নগুলো সব মনে ছিলো, একটার সাথে আরেকটা স্বপ্ন রিলেট ও করতে পারছিলাম। জেগে ওঠার পর এখন আর পারছিনা। আরো একটা ব্যপার আছে, ঘুম থেকে ওঠার ঠিক পরপরই মস্তিস্ক মাল্টিটাস্কিং করতে ব্যস্ত হয়ে যায় না, তাই কিছুটা ফ্রি স্পেস পায়। সেই ফ্রি স্পেস সে কাজে লাগায় সম্ভবত ওই আধো-ঘুম, আধো-চেতনার স্তরের কথাবার্তা মনে রাখতে। সময় বাড়তে থাকলে ব্রেইন ও ব্যস্ত হয়ে যায়, তখন এই ডেটাগুলো মুছে যায়। কম্পিউটারের র্যাম ফ্রি করার মতো ব্যাপারটা! আর আমাদের স্মৃতি কে বলা যায় রম। রিড অনলি মেমোরি। ব্যপারটা আবারো টের পেলাম। ঘুম থেকে ওঠার পর দুয়েকটা স্বপ্ন আমার মাথায় হালকাভাবে ছিলো। তখন ভাবছিলাম একটা গল্প লিখব। দুটো স্বপ্ন বেশ অদ্ভুত ছিলো, ওগুলো নিয়ে। এখন সেসবের কিছুই আমার মনে পড়ছে না!
মোট স্বপ্নের সংখ্যা ২০ এর উপরে হবার সম্ভাবনা। এই মূহুর্তে একটা মনে পড়েছে। এই স্বপ্নে আমার ল্যাপটপ পুড়ে যাচ্ছে। তখন আমি সম্ভবত আধো চেতনা স্তরে পৌছে গেছি, তাই বুঝতে পারলাম এটা স্বপ্ন। আমার ল্যাপটপ আসলে পুড়ে যাচ্ছে না। ভাবলাম চোখ খুললেই স্বপ্ন কেটে যাবে। খুলেছিলাম কিনা এখন মনে নেই। সারাদিন ধরে মনে করার চেষ্টা করলে অবশ্য কিছু কিছু ঘটনা মনে পড়ার সম্ভাবনা থাকে। সেটা সম্ভবত ডিপেন্ড করে স্বপ্নের ঘটনাটা আমাদের জন্যে কতটা মেমোরেবল। খুব বেশি ভীতিকর বা অদ্ভুত স্বপ্ন মনে থাকে, সুখস্বপ্ন তেমন মনে থাকে না। কারণ মানুষ সুখি থাকতে চায়। সেটাই স্বাভাবিক। তাই স্বপ্নে স্বাভাবিক কিছু ঘটলে ব্রেইন সেটা মনে রাখার প্রয়োজন বোধ করে না। ভীতিকর বা দুঃখজনক কোন কিছু স্বপ্নে ঘটলেই সেগুলো বেশি মনে থাকে। আমার যেটা মনে পড়েছে সেটাও দুঃখজনক। সারাদিন চেষ্টা করলে আরো কয়েকটা মনে আসার কথা। কিন্তু সেদিন পার হয়ে গেলে সেই সম্ভাবনা অনেক কম। এটারও ব্যখ্যা আছে। যাক সেটা এখন না বললেও হবে!
মানুষের স্লিপ সাইকেলে দুটো ভাগ আছে। র্যাপিড আই মুভমেন্ট স্টেজ আর নন র্যাপিড আই মুভমেন্ট স্টেজ। র্যাপিড আই মুভমেন্টে ব্রেইন পুরোপুরি ঘুমায় না, আধো জাগরণে থাকে। এই স্টেজেই স্বপ্ন তৈরী হয়। নন র্যাপিড আই মুভমেন্টে স্বপ্ন দেখা যায় না। এটা জানার কিছুদিন পর থেকেই আমি আমার সামনে কেউ ঘুমিয়ে থাকলে আগ্রহ নিয়ে দেখার চেষ্টা করতাম তার র্যাপিড আই মুভমেন্ট হচ্ছে কিনা। খুব মজার ব্যপার মনে হতো তখন। এখন অবশ্য এই কাজ আর করা হয়না।
তিন
স্বপ্নের কথা বলতে বলতে মনে পড়লো, কিছুদিন আগে একটা স্বপ্ন দেখেছিলাম বেশ মজার। স্বপ্নটায় দেখলাম আমি হাসান মাহবুব ভাইয়ার একটা গল্প পড়ছি, ব্লগেই। সেই গল্পটা কিন্তু ভাইয়া লেখেননি এখনো। মানে পুরোনো কোন লেখা না। সম্পুর্ণ নতুন একটা লেখা, যেটা তৈরী হয়েছে আমার মাথার মধ্যেই। চমতকৃত হচ্ছিলাম, কারণ সবাই জানেন ভাইয়ার গল্পগুলো ক্যামন হয়! স্বপ্নটা অবশ্য কয়েকটা পার্টে দেখেছি। এবং যথারীতি ঘুম থেকে ওঠার কিছুক্ষণের মধ্যেই ভুলে গেছি। আমার আবার গোল্ডফিশের মেমোরী। আরো কিছুদিন আগেই দেখলাম স্বপ্নের ভেতর লিরিক লিখছি। লেখালেখি যা যতসামান্য পারি, তা থেকে বেশ দূরে আছি অনেকদিন। প্রথম প্রথম যেটা হচ্ছিল, লেখার কিছু পাচ্ছিলাম না। রাইটার্স ব্লক বলে একটা বিষয় আছে, সেরকম কিছু। কিছুই আসতো না মাথায়। এখন কিছুটা মাথায় আসছে, কিন্তু কলমে (পড়ুন কি-বোর্ডে) আনতে ভীষণ বিরক্তি লাগছে। এই কারণেই লেখা হচ্ছে না কিছু। ব্লগিং থেকেও দূরে আছি বেশ কিছুদিন। স্বপ্নগুলো দেখার কী এগুলোই কারণ?
চার
আমি হচ্ছি প্রথম শ্রেণীর লেখা চোর। অবাক হবার কিছু নেই! ভয় পাবারও কিছু নেই। এ লেখাচোর সেই লেখাচোর নয়! পড়ালেখা না করলে ছোটবেলায় অনেকেই নিশ্চয়ই বাবা-মা বা শিক্ষকের কাছে শুনেছেন- তুমি এত পড়াচোর ক্যানো? পড়া না করলে পড়াচোর। সেরকম না লিখলে লেখাচোর। লিখতে আমার কখনোই ভালো লাগতো না। ছাত্রাবস্থায় অন্যদের যেখানে একই বিষয়ের দু তিনটে করে লেখাভরা খাতা থাকত, সেখানে আমার একটা খাতারই পুরোটা ভরত না। এমনকি অংক খাতাতেও এক অঙ্ক দুবার করেছি এমন খুব কমই হয়েছে। পাকা খাতা তৈরী করা শুরু করে জীবনেও শেষ করতে পারিনি, এখনো পারিনা! তবে একটা জিনিস আমি খুব আগ্রহ নিয়ে লিখতাম, ডায়েরী। দিন শেষে ডায়েরী লেখা ছিলো আমার অন্যতম কাজ। কিছু ঘটলেও লিখতাম। না ঘটলেও লিখতাম। এখন অবশ্য সেটাও করা হয় না। গত দুবছরে ডায়েরী কেনা হয়েছে আগের মতই, কিন্তু তাতে সাদা পাতার পরিমাণই বেশি, লেখা আছে এমন পাতা হাতে গোণা যাবে।
পাঁচ
ডায়েরী মানে দিনপঞ্জি। ওয়েবে দিনপঞ্জি লেখার আইডিয়া থেকেই কিন্তু ব্লগ। এটা আমাদের ভার্চুয়াল ডায়েরী। পার্থ্যক্য এটাই পার্সোনাল ডায়েরী আমরা কাউকে পড়তে দেই না। আর ব্লগ কেউ না পড়লেই আমরা বরং কষ্ট পাই। নিজের লেখা মানুষের অগণিত মানুষের সামনে তুলে ধরা ও প্রয়োজন মতো সংশোধন করার অসাধারণ একটা মাধ্যম হলো ব্লগ। ব্লগ আজকাল মেইনস্ট্রিম মিডিয়ার বিকল্প ও হয়ে উঠছে কিন্তু!
এই মুহূর্তে সামহয়্যারইন ব্লগের ব্লগার পরিসংখ্যান বলছে- ব্লগ লিখছেনঃ ৩ বছর ২ সপ্তাহ।
৩ বছর পার করে ফেলেছি এই ব্লগে, কোন এক ফাঁকে তিন বছর কেটে গিয়েছে! অনেক সময়! অবশ্য সামুতে এটাই আমার প্রথম আইডি না। স্বনামে একটা আইডি আছে। যদিও ওটাতে তেমন লেখা হয়নি। ইচ্ছেও করেনি। কারণ তখনো অভ্র আসেনি। আর আমি বিজয়ে লিখতে পারতাম না। কোনদিনই বিজয়ে লিখিনি। ওই আইডিটার বয়স এটার চেয়ে দেড় বছর বেশি। এইচ এস সির পর ভর্তি পরীক্ষার ঝামেলা-টামেলা শেষ করে মনে হল, এখন তবে ব্লগে কিছুটা লেখার চেষ্টা করে দেখা যেতে পারে! যেহেতু স্বনামের আইডিটার উপর কোন মায়া ছিল না, কিছু তো লিখিই নি! তাই এই নিকটা রেজিস্টার করলাম। পড়তে পড়তে কখন যে ব্লগার হয়ে গেলাম নিজেও জানিনা। ঘন্টার পর ঘন্টা ব্লগে পরে থাকা দেখে বন্ধুরা অনেক ঠাট্টা করত, আমার অবশ্য তাতে মজাই লাগত বেশি। অবশ্য ২ বছর যে আমি টানা ব্লগে ছিলাম তা কিন্তু নয়। মাঝখানে অক্টোবর ২০১০ থেকে ফেব্রুয়ারী ২০১১ পর্যন্ত পুরোটা সময় আমি ব্লগে একেবারেই ছিলাম না। আবার মাঝে মাঝেই উধাও হয়ে যাই। হারিয়ে যেতে ভালো লাগে। কারণ হারিয়ে যাওয়া সবসময়েই আনন্দের!
আমার সময়ের বেশ কজন ব্লগার এখন আর ব্লগিং করেন না। ব্লগিং করেন না অনেক হার্ডকোর জনপ্রিয় ব্লগারও। তাদের কে অনেক মিস করি। ব্লগটাও কেমন যেন বদলে গিয়েছে। এত সব কিছুর পরেও সামহোয়ারইনব্লগ আমার কাছে একটা ভাললাগার নাম। এ কারণেই চতুর্মাত্রিক থেকে শুরু করে অনেক বাংলা ব্লগেই একাউন্ট খোলা হয়েছে, কিন্তু নিয়মিত লেখা হয়ে ওঠেনি কিছুই। তার পরও যারা আমার ব্লগে নিয়মিত উকি দিয়ে যান, তাদের কৃতজ্ঞতা জানানোর ভাষা আমার নেই!
(এই বিশাল লেখার শেষের দিকে ৩য় বর্ষপূর্তির বিষয় লেখাটা একটা এক্সপেরিমেন্ট। আমার ধারণা অধিকাংশেরই ব্যপারটা চোখ এড়িয়ে যাবে!)
আর কী বলা যায়? কথপোকথন শেষ করার ব্যপারে আমার ব্যর্থতা চুড়ান্ত পর্যায়ের। অবশ্য এটা কথপোকথন কিনা সেটাও ভাববার অবকাশ আছে! সম্ভবত না! কারণ দুপক্ষের সংলাপ ছাড়া আমি একাই বকবক করে গেলে সেটা তো কথপোকথন হবার কথা না। তাই না?