দুদিন আগে বাংলাদেশের ট্রেকিং এর উপর একটা ব্লগ লিখেছিলাম। সেদিন পুরোটা ব্যস্ততার কারনে শেষ করতে পারি নাই। তাই আজকে আবার আপনাদের কিছুটা সময় চেয়ে নিচ্ছি। আশা করি একটু মন দিয়ে পড়বেন। প্রমিসঃ আজকে উপন্যাস লিখব না।

মাউন্টেনিয়ারিং এর একটা কমন ডায়লগ দিয়ে শুরু করিঃ
“Mountaineering is not about altitude, it’s all about attitude.”
বাই হুক অর বাই ক্রুক। আমাকে এই জায়গায় যেতেই হবে। ওরা গেছে, আমি যদি এখন না যাই তাহলে তো আমার জাত চলে যাবে। ইয়া আল্লাহ...আমি মুখ দেখাব কি করে?? এই ঝরনার নীচে একটা প্রোফাইল পিক আপলোড করতে না পারলে তো জীবন বৃথা। - দুঃখজনক হলেও সত্যি, এটাই আমাদের এখন কার ট্রেকিং এটিটিউড। অস্বীকার করব না, আমি নিজেও এই “শো অফ” দের দলে পরি, নিজেকে জাহির করতে চাই।
দেখসো...?? আমি পারি, আমি এই জায়গায় গেসি, এত দূর্গম জায়গা যে কি বলব, মরতে মরতে শুধু প্রান টা নিয়ে ফেরত আসছি, বাঘ-ভাল্লুক-বুনো গয়াল-ক্ষেত্র বিশেষে নিরীহ হরিন ও আমাকে আক্রমন করতে ছাড়ে না। আর সাথে কিছু মারদাঙ্গা টাইপ ছবি তো বাই ডিফল্ট থাকবে। ব্যাস...আর কি লাগে?? আমি তো হিট।
এই যেমন ধরেন, এর আগের ব্লগ টাই কত মানুষ পড়লো। প্রতিটি লাইকের সাথে সাথে আমার বুক চওড়া হতে হতে ফুলো ঢোল হয়ে গেছে। এই খ্যাতির তৃপ্তি পেয়েছি অনেক।
কিন্তু এই খ্যাতি চাওয়া টাকে আমি খারাপ ভাবে দেখতে পারছি না। অনেক চেষ্টা আর যুক্তি খোঁজার চেষ্টা করেও কিছু পেলাম না। কেউ খ্যাতি চাইতেই পারে। এটাই স্বাভাবিক। বান্দরবানের একটি সুন্দর ঝরনার ছবি দিয়ে আর ভ্রমন কাহিনী, তার এডভেঞ্চারের গল্প, তার দেখা সৌন্দর্য সবার সাথে শেয়ার করতেই পারে। আর পারেই বা বলছি কেন, এই শেয়ার করা টাই তো স্বাভাবিক।
কারন একটাই...ঐ যে আমাদের এটিটিউড। একটা ছবি দেখলাম...ব্যাস। কাজ সারসে। এখন ঐ জায়গা টাতে যেতেই হবে। হুজুগে বাঙালী বলে আমাদের যে খামোখা গালি দেয়া হয় না সেটাই আমরা প্রমান করি...বারবার।
একটা ছবি দেখে যেতে চাওয়া কে আমি খারাপ বলতে চাচ্ছি না। খারাপ বলছি, যেভাবেই হোক যাব টাইপের ম্যান্টালিটি। এখানে যেভাবেই হোক যাব বলতে কি বুঝাচ্ছি?? একজন ট্রেকার তো সব ধরনের বাধা অতিক্রম করেই ট্রেক করবে। এটাই তো স্বাভাবিক। এটাকে খারাপ কি দেখলাম??
তাহলে, আমি স্পষ্ট করেই বলিঃ
এখনকার ট্রেকিং ট্রেন্ড এ টাকার খেলা চলে আসছে। আর এর জন্য আমরাই দায়ী।
ট্রেকিং এর দর্শন বলে, সবচেয়ে কম খরচে ঘুরে বেড়াও। আর আমরা ট্রেকিং এর এই মূল বিষয় টাকেই আমাদের ট্রেন্ড থেকে বিদায় করে দিয়েছি।
আজকে আরেক টা গল্প বলিঃ
গত রোজার ঈদের ছুটিতে আমি বগা লেক গিয়েছিলাম, প্রায় দেড় বছর পর। রুমা বাজারে নামতেই একটা ছোট খাট ধাক্কা খেলাম। গাইড এসোসিয়েশন এর নির্ধারন করা রেট দেখে মাথা ঘুরে গেল। কেওক্রাডাং পর্যন্ত ৪০০ টাকা প্রতিদিন। আর কেওক্রাডাং থেকে ১ ঘন্টা দূরের জাদিপাই যেতে আপনার লাগবে মাত্র ২৫০০ টাকা। কত চমৎকার দেখা গেল। যাই হোক, রুমা বাজারের প্রায় সব কয়টা গাইড এর সাথেই আমার ব্যাক্তিগতভাবে পরিচয় আছে। বগা লেকে গেলেই সবার সাথে টুকটাক আলাপ আলোচনা হয়। তো ওদের কাছেই শুনলাম, একজন গাইড (নাম বলছি না) দুমলং গেল একটা টীম নিয়ে। ১৭ হাজার টাকার কন্ট্যাক্ট। এটা শুনে হাসব না কাঁদব বুঝলাম না। আজকাল বান্দারবানে ট্রেকিং করতে একটা টিমের জন্য একজন গাইড আর দুইজন পোর্টার লাগে। গাইড যত টাকাই হাকুক...কেউ কেউ সেই টাকা দিয়েই সেখানে যাবে। কারন তাকে যেতেই হবে। তার পোর্টফোলিওর জন্য। পিক বলেন আর ঝরনা, সুন্দর রুট বলেন আর ঝিরি, এসবের কোন মানেই নাই এই যুগের ট্রেকার দের কাছে।
সাকা হাফং এ আমাকে যেতেই হবে। বাংলাদশের সর্বোচ্চ চূড়া এটা। এর জন্য ১৫হাজার টাকা লাগলেও আমি দিতে রাজী। কিন্তু এই ১৫ হাজার টাকা একজনের জন্য বেশী হয়ে যায়। তাই গ্রুপ বড় কর। ৩০ জন হলেই তো মাথা পিছু ৫০০ টাকা হয়ে যায়। এভাবেই চেইন রিয়েকশনের মত গত দিনের ব্লগে উল্লেখ করা সমস্যা গুলা দেখা যায়।
২০০৮ এ রামাক্রি ঘুরে আসতে আমাদের ১৫০০ টাকা লেগেছিল। আজকে সেটা দিয়ে এক বেলার খাওয়া ও হয় না।
এখন চাহিদা বাড়লে অর্থনীতির নিয়ম অনুসরন করে দাম তো বাড়বেই। কিন্তু আমরা যদি সেই সিন্ডিকেটের এই অন্যায়কে মেনে নেই তাহলে ট্রেকিং এর মূল দর্শন কেই তো আমরা অমর্যাদা করছি। ট্রেকিং এ আমরা প্রতি মুহুর্তে শারিরিক ও মানিসিক বাধা অতিক্রমের পরীক্ষা দিয়ে যাই। কিন্তু এই ব্যাপার টা তেই আমরা মাথা নত করে ফেললাম। আমি বলছি না সবাই এমন করে, কিন্তু একজন যদি ১৭ হাজার দিয়ে দুমলং আর ১৫ টাকা দিয়ে সাকা সামিট করে আসে, তাহলে গাইড আমার আর আপনার কাছে সেই টাকা দাবী করবে না কেন??
এটাই এখনকার ট্রেন্ড, এটাই বুঝি এখনকার ফ্যাশন। আমরা দিকভ্রান্ত হয়ে যাচ্ছি। আউটডোর স্পোর্টস আমাদের মাঝে জনপ্রিয় হবার আগেই আমরা করাপ্ট হয়ে যাচ্ছি। পিক সামিট না করেই বুক ফুলিয়ে প্রচার করা টা কে তো আমি নগন্য মনে করে সমস্যার কাতারেই ফেলতে রাজী না।
ইকো-টুরিজম এর সাথে লোকাল কমিউনিটির ডেভেলপমেন্ট ওতপ্রোতভাবে জরিত। কিন্তু আমার সাকা যাওয়ার জন্য যেই ১৫ হাজার টাকা লাগছে তার থেকে লোকাল কমিউনিটির কি লাভ হচ্ছে আমি আজকে আপনাদের কাছে একটু জানতে চাই।
রুমা বাজারে গাইড নিয়ে যা হচ্ছে সেটা অন্যায়। আর এই অন্যায় কে আমরাই তৈরী করেছি। রুমা গেলেই আমরা গাইড দের গালাগালি করি, কিন্তু একবার ও ভেবে দেখি না এটা আমাদের ই দোষ। আমাদের অজ্ঞতা আর শো অফ এটিটিউড আজকের এই সিন্ডিকেট দৈত্য কে জন্ম দিয়েছে।
আমাদের এখন সবাই কে এক জোট হয়ে এসব অন্যায় বন্ধ করতে হবে। আমাদের চারপাশে যারাই এমন ভুল ভাবে ট্রেকিং করে পরিবেশ কে নষ্ট করছে-আসুন আমরা তাদের কে বুঝাই। বন্ধ করি এইসব নষ্ট ট্রেন্ড।
আর আসুন শপথ নেই যতদিন পর্যন্ত আমরা আমাদের মধ্যকার এই নষ্ট ট্রেন্ড কে মুছে ফেলতে না পারব ততদিন পর্যন্ত সুন্দর জায়গার কোন রকম প্রচার প্রচারনা বন্ধ রাখব।
এই সুন্দর জায়গার সৌন্দর্য উপভোগ করা যেমন আমাদের সবার অধিকার, তেমনি একে রক্ষার দায়িত্ব আমাদের সবার। শুধু দায়িত্ব না, এটা আমাদের পবিত্র কর্তব্য
ফেসবুকে আমরা এই বিষয় টা নিয়ে আলোচনা করছি। আপনিও অংশ নিন।
সর্বশেষ এডিট : ১৮ ই সেপ্টেম্বর, ২০১২ রাত ১২:৪০