‘মাই নেম ইজ সুলতান’ ‘ঢাকার কিং’ ‘বস্তির বাদশাহ’ আমাদের সিনেমা জগতে এমন আরও অসংখ্য চকচকে নাম খুঁজলে পাওয়া যাবে। প্রশ্ন হল এইজাতীয় বাহারি নামের সিনেমাগুলো আমাদের সমাজকে প্রতিনিয়ত কি উপহার দিচ্ছে?
একথা অনস্বীকার্য যে গুটিকতক সিনেমা বাদে বাকি প্রায় সবগুলোরই দর্শক নিম্নবিত্তের মানুষেরা। আরও নির্দিষ্ট করে বললে পোশাক স্রমিক, রিকশাওয়ালা, দিনমজুর এরাই মূলত আমাদের চলচ্চিত্রের প্রযোজকদের মূল ভরসা। এদের মাঝেও মূলত তরুণ এবং যুবা শ্রেণীর লোকদের আনাগোনাই সিনামা হলগুলোতে বেশি। এখানে উল্লেখ্য যে কোনভাবেই এই পেশাগোষ্ঠীর মানুষকে ব্যঙ্গ করার অভিলাষ নিয়ে আমি লিখতে বসিনি। আগের কথায় ফিরে আসি, উপরে উল্লেখিত সিনেমাগুলো দেখলে এ প্রজন্মের বাংলা সিনেমার রাজপুত্তুর শাকিব খানকে আপনি পাবেন বিভিন্ন রুপে। সারা শরীরে উল্কি আঁকা স্টিকার লাগানো, কানে দুল, হাতে গোটা কয়েক ব্রেসলেট, কপালের ওপর আমেরিকার পতাকা বা অন্য কোন স্কার্ফ ফোল্ড করে পট্টির মত করে বাঁধা। তাকে বা অন্য কোন নায়ক, সহনায়কদেরকে আপনি আবিষ্কার করবেন মেয়েদের সাথে রাস্তাঘাট, স্কুল কলেজের সামনে ফ্লার্ট ( অন্য নামে বললে ইভ টিজিং) করতে। প্রায় সব সিনেমায় ভিলেনদের উদ্দেশ্যে চটকদার শ্রুতিকটু ডায়লগ দিতে, বাহারি স্টাইলে সিগারেট ফুঁকতে, মোটরবাইক চালাতে দেখা যায় আমাদের সিনেমা আইকনদের।
নিম্নবিত্তের প্রতিনিধি আঠারো উনিশ বছর বয়সের একজন মানুষ যখন এইসব কাণ্ড কীর্তি দেখে সিনেমাহল থেকে বের হয় তখন তার মনোজগতে একটা ঋণাত্মক পরিবর্তন অবশম্ভাবি। দু’দিন পর তাকে দেখা যাবে গলায় মোটা চেইন, হাতে কয়েকটা ব্রেসলেট, কানে দুল পরিহিত অবস্থায় পাড়ার চায়ের দোকানে বসে নায়কোচিত ভঙ্গিতে সিগারেট ফুঁকতে। পাশ দিয়ে কোন নারী হেঁটে গেলে সে হেঁড়ে গলায় গান ধরবে ‘চুমকি চলেছে একা পথে...’ । কিছুদিন পর যখন তার রোজগার কুলিয়ে উঠতে পারবে না লাইফ স্টাইলের সাথে তখন আসবে তার মাঝে আরেক পরিবর্তন। ছুরি চাকু বা কোন আগ্নেয়াস্ত্র যোগাড় করে সে শুরু করবে ছিনতাই। এভাবে কিছুদিন চলতে থাকলে তার উপর নজর পড়বে অনেক নেক নজরওয়ালার। নানা মিছিল মিটিঙে ডাক পড়বে তার, আরও লোক সংগ্রহ করার দায়িত্ব পড়বে তার উপর। পাতি নেতাদের সাথে ঘুরে ঘুরে সেই ছেলে ধীরে ধীরে তার ভিতরে তৈরি হতে থাকা ডিলিউশনটাকে কেবল আরও পরিপক্ক রূপ দিবে। তার ডিলিউশন ভুবনে নিজেকে সে আবিষ্কার করবে ‘বস্তির শাহানশাহ’ কিংবা ‘ঢাকার কিং’ হিসেবে।
এখানে আমি একটা ধারাবাহিক পটভূমি তৈরি করে লেখাটাকে এগিয়ে নিয়ে গেছি। বাস্তবে হয়তো আমার লেখার প্রতি লাইন ধরে ঘটনা এগিয়ে যায় না কিন্তু যে ‘সামাজিক বিষক্রিয়া’র কথা আমি বলতে চেয়েছি বাস্তবে তা প্রতিদিন ঘটে চলেছে। আমার মফস্বলে একটা চায়ের দোকানে চা নিয়ে বসলে অথবা সেলুনে চুল কাটাতে গেলে আমি যে তরুণ প্রজন্ম দেখতে পাই তার একটি বড় অংশের কারিগর আমাদের নিম্নমানের, নিম্নরুচির চলচ্চিত্র। অথচ একসময় এই বাংলাদেশে অসাধারণ ছায়াছবি তৈরি হয়েছে, আমাদের দেখে কলকাতার দাদারা কত সিনেমা নকল করেছে অথচ সেই তারাই এখন অটোগ্রাফ, ২২শে শ্রাবণ এসবের মত মানসম্মত সিনেমা উপহার দিচ্ছে। আর আমরা? দিনের পর দিন কেবল পিছিয়েই চলেছি। হলিউড যদি একজন 'আল পাচিনো' উপহার দিয়ে থাকে তবে আমরাও একজন 'হুমায়ূন ফরিদী' পেয়েছিলাম, তারা যদি একজন 'রবার্ট ডি নিরো' কিংবা 'জ্যাক নিকলসন' পেয়ে থাকে তবে আমাদেরও একজন 'রাইসুল ইসলাম আসাদ' আছেন।
জানিনা কবে আমাদের কর্তাব্যক্তিদের বোধোদয় হবে, কবে তারা একটু মনোযোগ দিবে আমাদের চলচ্চিত্রের দিকে! আমি আবার সিনেমা হলে গিয়ে সিনেমা দেখতে চাই। শুধুমাত্র সিনেপ্লেক্সের মুরগীর খাঁচা টাইপের থিয়েটার না বিশাল বড় বড় আন্তর্জাতিক মানের হলে বসে, ১০০% ছারপোকা মুক্ত পরিবেশে প্রথম শ্রেণীর স্বদেশী সিনেমা দেখতে চাই। জানি নিশ্চয়ই আবার ফিরে আসবে আমাদের রুপালী পর্দার সোনালী দিনগুলো ! সেই ক্ষণের অপেক্ষায় আছি।