মেয়েদের প্রতি মানুষের ঘৃণার তীব্রতা দেখে আমি আজকাল হতবাক হয়ে যাই। আমরা তো দিনে দিনে এগিয়ে যাচ্ছি, মেয়েরা পড়ালেখা করছে, কাজকর্ম করছে, এখন আর নারী মানেই নিষিদ্ধ- এজাতীয় কোন বিষয় নেই, ছেলেরা-মেয়েরা পরস্পর বন্ধু হচ্ছে, একসাথে ক্লাসে, ক্যাম্পাসে, কর্মক্ষেত্রে দেখা হচ্ছে, ফেসবুক-মোবাইলের কল্যাণে চাইলেই প্রেম করা যাচ্ছে, তাহলে দৃষ্টিভঙ্গি কেন পালটাচ্ছে না? বিশ্ববিদ্যালয়ের গণ্ডি পেরোনো শিক্ষিত যুবক, দেশপ্রেমের লেবাসে মোড়ানো তরুণ বিপ্লবী, সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষ থেকে শুরু করে নব্য আবির্ভূত ফেসবুক সেলেব্রিটিদের মধ্যে কি সব অসুস্থ চিন্তার লালন পালন!
আপাতদৃষ্টিতে কথাবার্তা শুনলে, দুটো ফেসবুক স্ট্যাটাস পড়লে বোঝা যায়না, কিন্তু একটু নাড়া দিলে নিচের নোংরা তলানিগুলো ভেসে ওঠে, তখন বোঝা যায়, মেয়েদের নিয়ে এদের করা মন্তব্যগুলো কি অকথ্য, আর কি পরিমাণ উদ্ভট কামনা এদের রন্ধ্রে রন্ধ্রে মিশে আছে। কতটা অসুস্থ মানসিকতার হলে কেউ নিজেদের যৌন কার্যকলাপের ভিডিও প্রকাশ করে দিতে পারে, তা আমার মাথায় আসেনা। আর যারা আবার এধরণের ঘটনা দ্বারা "মেয়েটির উচিত শিক্ষা" হল বলে মনে করে আর ফেসবুকে, ব্লগে তা নিয়ে ঝড় তোলে, তাদের কথা আর কি বলব! কিন্তু এরাই তো দেশের শিক্ষিততম অংশ, এরাই যদি এরকম ভাবে তো সাধারণ মানুষের কি অবস্থা?
নারীবিদ্বেষী অনেকরকম দেখেছি, এরা কেউ নারীদের একবাক্যে ঘৃণা করে, কেউ ভাবে মেয়েমানুষকে মাথায় চড়ানো ঠিক না, কারো কাছে নারী শুধুই সুখদুঃখের সঙ্গী, রাত দুপুরে কবিতা শোনাবার যন্ত্র, তবে নারীর নিজস্ব কোন সুখদুঃখ থাকতে নেই, কেউ আবার বয়ান দেয়, মেয়েরা মায়ের জাত, অতএব তাদের শ্রদ্ধা করা চাই (শুধু মায়ের জাত বলে আপনি কাউকে শ্রদ্ধা করবেন? পিতার অবদান কি জীবনে কম? আর যে নারী মা হতে পারবেনা, সে কি মানুষ না? তাকে আপনি কোন কাতারে ফেলবেন?) আর সেই পুরোনো- মেয়ে মানেই শোয়ার বস্তু, সে তো আছেই।
হয়ত কৈশোরে, যৌবনে কোন অপরিপক্ব কিশোরী, যুবতী তার মন ভেঙ্গে দিয়েছিল, হয়ত পরিবারে গাঁথা আছে নারী নির্যাতনের ইতিহাস, বাবার হাতে মাকে প্রহৃত হতে দেখেছে, শিক্ষাদীক্ষা, আত্মসম্মানের অভাবে তলিয়ে যেতে দেখেছে আপন বোনদের, হয়ত ছিল চাপা, অব্যাক্ত যৌন কামনা, যা কখনও প্রকাশ করবার সুযোগ মেলেনি, কারো কারো নারীর সাথে পরিচয়ই ঘটেছে পর্ণছবির মাধ্যমে, স্বমেহনের তালে তালে.... কাকেই বা দোষ দেবো?
sexual liberation- সে এক তীব্র controversial ও ভিন্ন আলোচনার বিষয়, কিন্তু তা বাদ দিয়েও যদি ভাবি, একজন নারীর যেমন ভালবাসার মানুষ, প্রেমিক, স্বামী ইত্যাদি বেছে নেয়ার অধিকার আছে, তেমনি কার সাথে সে শয্যায় যাবে সেটাও তার নিজস্ব বিষয়। যুক্তি অন্তত তাই বলে। নৈতিকটা বিসর্জন দিয়ে কোন নারী যদি কারো শয্যাসঙ্গী হয়েই বসে, তবে তার দায় সম্পূর্ণ ঐ পুরুষ ও নারীর, যদি তারা উভয়েই প্রাপ্তবয়স্ক হয়। কিন্তু বাস্তবে দেখছি তার বিপরীত প্রতিফলন। কোন মেয়ের বিয়ের আগে প্রেমিক থাকলে, তার সতীত্ব হারানোর খবর পাওয়া গেলে সেটা তার জন্য একান্ত কলঙ্কের বিষয়। আর যদি কেউ গোপন ভিডিও ছেড়ে দেয়, তবে একমাত্র উপায় আত্মহত্যা! প্রশ্ন হচ্ছে, মেয়েটি কি প্রেম একা একা করেছিলো? শয্যায় একা গিয়েছিল? আর একান্ত মুহূর্তের ভিডিও প্রকাশ করে দিতে পারে যে কাপুরুষ, তার নৈতিকতার হিসেব কে নেবে? অনেককে বলতে শুনি, ভালই হয়েছে, আকাজ-কুকাজ করার সময় মনে ছিল না? আশ্চর্য বিষয়!! কাজটা কি সে একা করেছে? আর করলেই কি তার শাস্তি এভাবে দিতে হবে?
বেশির ভাগ প্রেমের সম্পর্কেই শারীরিক সম্পর্ক স্থাপনের ক্ষেত্রে মেয়েটির সম্মতি থাকে না। কখনো প্রেমিকের চাপে পড়ে, কখনো বিভিন্ন ব্ল্যাকমেইলের স্বীকার হয়ে মেয়েটি শারীরিক সম্পর্ক করতে রাজি হয়। আর যদি তার সম্মতি থেকেও থাকে, সেক্ষেত্রে মেয়েটিকে অপদস্ত করার কি অধিকার আছে আমাদের? অথচ, আমরা সবাই এরকম দু/একজন ছেলেকে চিনি, যারা শুধু শয্যায় যাওয়ার জন্যই মেয়েদের সাথে সম্পর্ক গড়ে তোলে। কই, তাদের তো আমরা সামাজিকভাবে বয়কট করতে পারিনা?
পুরুষের যৌন কামনার চাপে পড়ে নারী চিরকাল পিষ্ট হয়ছে। আমরা কবে স্বীকার করতে পারবো, নারীরও কামনা রয়েছে? আর তা অনৈতিকভাবে পূর্ণ করতে যাওয়াটা পুরুষ-নারী উভয়ের জন্য লজ্জাজনক? নারীকে মানুষ মনে করুন, মানুষের কাতারে ফেলে তার বিচার করুন। মেয়েরা কোন আলাদা biological species নয় যে, আমাদের প্রদত্ত মনগড়া শাস্তি তাকে সহ্য করতে হবে, আর তা করতে না পারলে পটাপট মরে যেতে হবে। আত্মহত্যার ফলে যে তাজা প্রাণগুলো ঝড়ে যাচ্ছে, তা বন্ধ করতে না পারলে, এত বড় বড় কথা বাদ দিয়ে আমাদেরই মরে যাওয়া উচিত।