আগামী ১৫ নভেম্বর, ২০০৮, ১ অগ্রহায়ণ ১৪১৫, শনিবার `সেলিম আল দীন পাঠশালা'র আয়োজনে অনুষ্ঠিত হবে আলোচনা অনুষ্ঠান `প্রদোষে প্রাকৃতজন'। শওকত আলীর উপন্যাসটি নিয়ে মূল বক্তব্য উপস্থাপন করবেন তরুণ কথাসাহিত্যিক আহমাদ মোস্তফা কামাল।
অনুষ্ঠানে ঔপন্যাসিক স্বয়ং উপস্থিত থাকবেন বলে আশা করা যাচ্ছে। এ আলোচনাসভায় আপনার সতর্ক (তর্ক-মতসহ) উপস্থিতি ও অংশগ্রহণ প্রত্যাশা করছি।
অনুষ্ঠানের স্থান : বি এফ সি অডিটরিয়াম, আজিজসুপার মার্কেট, শাহবাগ
সময় : বিকেল ৫টা
প্রদোষে প্রাকৃতজন নিয়ে আমার কিঞ্চিৎ বাকোয়াজি তুলে ধরছি ব্লগের বন্ধুদের উত্ত্যক্ত করবার জন্য।
প্রদোষে প্রাকৃতজন : আত্মপরিচয়-গাথা
‘প্রদোষে প্রাকৃতজন’ শওকত আলীর, বলা চলে, সব থেকে পঠিত, আলোচিত উপন্যাস। উপন্যাসের পটভূমি হাজার বছর আগের বঙ্গভূমি ও তার জনপদ; যদিও লেখকের দৃষ্টি ও মন বিচরণ করেছে মূলত পুনর্ভবা, আত্রেয়ী ও করতোয়া নদীতীরবর্তী অঞ্চল। আখ্যানের মূল চরিত্র শ্যামাঙ্গ, মৃত্তিকামূর্তি-নির্মাতা, গুরু-কর্তৃক বিতাড়িত হয়ে ফিরে আসছে নিজ গ্রামে---তার সেই ফিরে আসবার পথই আমাদের ফোকাস, কেননা এই প্রত্যাবর্তন-পথেই গল্পের শুরু এবং শেষ। শ্যামাঙ্গ শেষ অব্দি নিজ গ্রামে পৌঁছুতে পারে না---স্বাধীন শিল্পিসত্তার উন্মেষ ঘটতেই যেন মৃত্যু হলো তার। ‘নিরপরাধ হলেই তুমি রক্ষা পাবে---এমন নিশ্চয়তা কি কেউ তোমাকে দেবে’---এই বলে যে উক্তিটি করেছিলো কৃষ্ণা বসন্তদাসকে লক্ষ্য করে, সমগ্র আখ্যানটি সে সুরেই বাঁধা। এই অসহায়ত্ব কার? সকলের নয় নিশ্চয়ই। ‘গৌড়বঙ্গের রাজধানী লক্ষণাবতীতে মহামহিম পরম ভট্টারক শ্রীলণ সেন দেব সিংহাসনে অধিষ্ঠিত। রাজসভায় উমাপতি, ধোয়ী এবং জয়দেবের কাব্যগীতির সুললিত মূর্চ্ছনায় সভাস্থল বিমুগ্ধ। জয়দেবের কৃষ্ণলীলার বর্ণনা শ্রবণে সভাসদবর্গ তুরীয়ানন্দে বিহ্বল, ধোয়ীর পবনদূতের বর্ণনায় কামকলানিপুণা রমণীকুলের উল্লেখে শ্রোতৃবর্গ অহো অহো উল্লসিত স্বর উচ্চারণ করে উঠছেন। স্মার্ত পণ্ডিতের ভাগবত বিশ্লেষণে মুহুর্মুহু প্রতিধ্বনিত হচ্ছে সাধু সাধু রব।... ব্রাহ্মণ সুখী, কায়স্থ সুখী, বৈশ্য সুখী। কেবল ব্রাত্য শূদ্রদের গৃহে অন্ন নেই, দেহে বস্ত্র নেই, মস্তকোপরি গৃহের আচ্ছাদন থাকে না।... ’ তথাপি প্রজাকুল সুখী!
এ সময়েই বাংলায় প্রবেশ করে আল মাহমুদের ‘বখতিয়ারের ঘোড়া’। কবিতার বিজয়ী বীর, ইতিহাসের নিরিখে ত্রাতা-রূপ মানবভ্রাতা, না-কি একান্তই ভাগ্যান্বেষী যোদ্ধা কিংবা রাজনৈতিক দস্যু---সে প্রশ্নে বিতর্কের অবসান ঘটায় ‘প্রদোষে প্রাকৃতজন’। ক্ষমতাচ্যুত বৌদ্ধরা যখন দুর্বল রাজ-প্রতিপক্ষ হিশেবে ইতস্তত বিরাজমান, বৌদ্ধধর্মের সঙ্গে ব্রাহ্মণ্যধর্মের সংঘর্ষ যখন একপেশে রূপ নিয়েছে---সেই কালখণ্ডে তুর্কী সেনাদের আগমন কি নতুন কোনো আশা জাগিয়েছিলো পীড়িত ও পরাজিতের মনে? এ তো সহজেই অনুমেয়, নিরঞ্জনের মতো অনেক তরুণেরই সংগঠিত হবার ও প্রত্যাঘাত করবার প্রত্যাশা তৈরি হবে। যে নিরঞ্জন অতীশ দীপঙ্করের দোহাই দিয়ে বলে, ‘তিনি তিব্বতে বলেছেন, ধর্মকে যে কোনো মূল্যে রক্ষা করতে হবে, সংঘই হবে সমস্ত কিছুর নির্ধারক। প্রয়োজন বোধে সে-ই রাষ্ট্রশক্তির পরিবর্তন করবে।’ কিন্তু নিরঞ্জনের মতো উদ্যমী যুবকের পরিণতি আমরা দেখি, উপন্যাসের শেষ দৃশ্যে, পুণ্ড্রনগরীর বিহারে : ‘তরুণ ভিক্ষুদুটিকে তারা পায় দ্বারদেশেই। যবন সৈন্যদের দিকে তারা সহাস্যে অগ্রসর হয়েছিলো কয়েক পদ। তারপর আর পারে নি। কবন্ধ দেহ দুটি ঐ স্থানেই প্রপাত হয়।’
বিজেতা বোধ করি কখনো ত্রাতা হয় না। যে সাম্প্রদায়িক অস্তিত্ব-রক্ষার অজুহাতে পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্ম, পরবর্তীকালে সেই রাষ্ট্রই আবির্ভূত হয় সাম্প্রদায়িক শক্তি হিশেবে। যে প্রতিরোধ আর মুক্তির লক্ষ্যে, অসহায় জনগোষ্ঠীকে রক্ষার স্বার্থে গঠিত হয় বাংলাদেশ সামরিক বাহিনী, সেই বাহিনীই পরবর্তীকালে স্বাধীন দেশে আদিবাসী জনগোষ্ঠীর সবচেয়ে বড়ো উৎপীড়ক। ‘প্রদোষে প্রাকৃতজন’-এর পটভূমি হাজার বছর আগের জনপদ হলেও কেন পাঠকের মন আকৃষ্ট হলো তাতে---এ প্রশ্নের জবাবেই লেখকেরও উদ্দেশ্য নিহিত বলে মনে হয়। যে প্রধান তিনটি ধর্মচিন্তা-সমবায়ে আমাদের জাতিরাষ্ট্রের উদ্ভব, তার সূচনা-বিন্দুটি একটি অস্থির ও অস্পষ্ট সময়কে নির্দেশ করে। এই সময়েরই একটা নিরপেক্ষ চিত্র, ভাষ্য তৈরি করতে চেয়েছেন লেখক। বহুদিন পর, বহুদূর পথ সরে এসে, অনেকটা যেন আত্মপরিচয় অনুসন্ধান। লেখক তাই সরাসরি পাঠককেই সম্বোধন করে বসেন, ‘যদি কোনো পল্লীবালিকার হাতে কখনো মৃৎপুত্তলি দেখতে পান, তাহলে লেখকের অনুরোধ, লক্ষ করে দেখবেন, ঐ পুত্তলিতে লীলাবতীকে পাওয়া যায় কি-না---আর যদি যায়, তাহলে বুঝবেন, ওটি শুধু মৃৎপুত্তলিই নয়, বহু শতাব্দী পূর্বের শ্যামাঙ্গ নামক এক হতভাগ্য মৃৎশিল্পীর মূর্ত ভালোবাসাও।’
ধর্ম-মন্দিরের বাইরে, ধর্ম-অনুষঙ্গ ছেড়ে মানুষের এই নির্মাণ---এই হলো আবহমানের ধূম্রজাল ছিঁড়ে আজকের সূর্যোদয়। এই হলো আখ্যানের মূল বার্তা। এখানে প্রশ্ন জাগে, তবে কি শ্যামাঙ্গের শিল্পিসত্তা, আধুনিক রুচি ও মননশাসিত লেখকের কল্পনামাত্র? গুরুর সঙ্গে তর্কালাপ---সে কি লেখকের চাপিয়ে দেয়া শিল্পদর্শন, ভাবনা? এর উত্তর দিয়েছেন লেখক নিজেই তার উপন্যাসে। কয়েক শতাব্দী পরে পুনর্ভবা-তীরে এক মন্দিরগাত্রের মৃৎফলকে যে অপরূপ শিল্পসুষমা আমরা ফুটে উঠতে দেখি, তা তো এক দশক বা এক যুগের প্রয়াসমাত্র নয়, কয়েক শতাব্দীর সাধনার ফল। ‘শিল্পী কি ক্রীতদাস? রাজানুগ্রহ ব্যতিরেকে কি শিল্পীর অস্তিত্ব নেই?’---সামন্তুযুগের অবসানে এইসব প্রশ্ন উঠেছিলো বটে, কিন্তু লেখক যখন শ্যামাঙ্গকে এই তর্কে ফেলে দেন এবং তারই হাতে যুক্তি তুলে দেন : ‘ধীমান বীটপাল কি রাজাদেশের দাস ছিলেন?’ ---তখন বিষয়টিকে বড়ো বেশি আপতিক বলে মনে হয় না এবং হারায় না কোনো প্রাসঙ্গিকতাও।
আরেকটি অভিযোগ এ উপন্যাসের বিরুদ্ধে। সে অভিযোগ ভাষা নিয়ে। আমরা লেখকেরই কাছে জানতে চেয়েছিলাম এই সংস্কৃতশব্দনির্ভরতার কারণ। তার মতে, আজকের দিনের পাঠকের সঙ্গে সেদিনের দূরত্ব তৈরি করতেই নিতে হয়েছে এ কৌশল। ‘আমাদের আপত্তিটা অন্যত্র’---আক্রমণ করে বসলাম তাকে, ‘প্রাকৃতভাষার গালি সংস্কৃতে রূপান্তরিত হলে সে কি আর গালি থাকে? কিংবা বাগধারাটাই কি পাল্টে যায় না? বিশেষত শালার পো বা হালার পুতকে শ্যালকপুত্র এবং শুয়োরের বাচ্চাকে শূকরপুত্র বলা আর মাথা চিবানো ও নাক গলানো জাতীয় বাগধারা পাল্টে মস্তকচর্বণ ও নাসিকা অনুপ্রবেশ বললে অর্থ কি ঠিক থাকে ?’ লেখক হেসে বললেন, ‘ব্যাপারটা বোঝা তো যায়।’
চৈত্রের দাবদাহে অশ্বত্থছায়া বড়ই শ্রান্তিহন্তারক।... অতএব হে পাঠক, আসুন, উপন্যাসটি পাঠে আরও একবার প্রবৃত্ত হই।
সর্বশেষ এডিট : ১৪ ই নভেম্বর, ২০০৮ রাত ১:০৯