এই চিন্তা থেকেই ‘সেলিম আল দীন পাঠশালা’র উদ্যোগে অনুষ্ঠিত হচ্ছে তিন দশকের কবিতাপাঠ ও আলোচনার আসর। এ আসর সিরিজ আকারে চলতে থাকবে। ইতোমধ্যে আমরা আহ্বান জানিয়েছিলাম প্রথম দশকের বা শূন্যের দশকের ৫ জন কবিকে। গত ১৮ অক্টোবর কবিতাপাঠ করেছেন নব্বইয়ের দশকের ৫ জন কবি। কবিরা ছিলেন : চঞ্চল আশরাফ, জাফর আহমদ রাশেদ, মুজিব মেহদী, সাখাওয়াত টিপু ও সৈকত হাবিব। আলোচক ছিলেন ড. আজফার হোসেন। ব্লগের বন্ধুদের সঙ্গে তাদের কবিতাগুলো শেয়ার করবার উদ্দেশ্যে, আজ, চঞ্চল আশরাফের স্ব-নির্বাচিত ও স্বকণ্ঠে পঠিত ৫টি কবিতা তুলে দিলাম। পরের কিস্তিতে আরেকজন কবির কবিতা তুলে দিতে পারবো বলে আশা রাখছি (যদি কবির সায় থাকে)।
চঞ্চল আশরাফ
জন্ম : ১২ জানুয়ারি, ১৯৬৯, দাগনভুঁইয়া, ফেনী। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে সম্মানসহ স্নাতকোত্তর। ৪টি কবিতার বই বেরিয়েছে তার : চোখ নেই দৃশ্য নেই (১৯৯৩), অসমাপ্ত শিরদাঁড়া (১৯৯৬), ও-মুদ্রা রহস্যে মেশে (২০০২), গোপনতাকামী আগুনের প্রকাশ্য রেখাগুলো (২০০৮)। গল্পগ্রন্থ দুটি : শূন্যতার বিরুদ্ধে মানুষের জয়ধ্বনি (১৯৯৯), সেই স্বপ্ন, যেখানে মানুষের মৃত্যু ঘটে (২০০৮)। একটি উপন্যাস : কোনো এক গহ্বর থেকে (১৯৯৫)। এছাড়া সাহিত্য, ভাষাবিজ্ঞান, দর্শন ও নন্দনতত্ত্ব বিষয়ে লিখেছেন প্রবন্ধ। আড়াইশ'রও বেশি গ্রন্থের সমালোচনা করেছেন বিভিন্ন সাময়িকীতে।
স্ট্র্যাপ
তার ব্রা-র স্ট্র্যাপ থেকে সেই যে উড়ল
অজস্র রঙিন ঘুড়ি, আমার আকাশ
সেই দিন থেকে উদাসীন,
দোদুল্যমান। আর দ্যাখো, সে
হাসে---সমস্ত লাটাই যেন তার হাতে;
‘নামিব না, নামিব না’ বলে ঘুড়িদল
দোলে, ঘুমের ভেতর
আমাকে পেঁচিয়ে ফেলে গোপনতাকামী
আগুনের সুতোগুলি, যতই প্রকাশ্য
হতে চাই, চাপা পড়ি তার হাসির তলায়
অন্তর্বাস থেকে ছুটি নিয়ে
দ্যাখো, সে কেমন বেরিয়ে পড়েছে---
আর, স্বপ্নে হারিয়ে-ফেলা হাসিসহ
জড়িয়ে ধরেছে তাকে
বিরহলাঞ্ছিত প্রেমিকের দল
পাশ-ফেরার গান-২
উপরে ওঠার কথা কেন যে ভাবো নি তুমি পথটা কি ছিল খুব বাঁকা
পাশ ফিরে চেয়ে দেখো, একটি লোহিত স্রোত হুইসেল দিতে দিতে
মুছে গেল পুরনো রেখায়
আরো চেয়ে দেখো তুমি ঘাট থেকে ছুটি নিয়ে নীল পটভূমি ধরে
উঠে গেল একটি জাহাজ
চাকার ঘষায় পথ কেন যে হয় না ক্ষয়; আরো দানবীয় তার চলা
ঘুমের টানেল ধরে আমরাও এসে গেছি শোণিতের খুব উঁচু পাহাড়চূড়ায়
উপরে ওঠার কথা ভাবো নি বলেই আজ তুমিও তো ভূপাতিত
নিরীহ নদীর তীরে, একা
সুইসাইড-নোট
তোর শ্বাসচাপা চুমু আমি হেমন্তের বনশীর্ষে রেখে
আসি। ধূলির তরঙ্গ থেকে
যাচ্ছি শূন্যে ছুটি নিয়ে---
এমন তো নয়; কিন্তু কোথাও চাই না যেতে, গিয়ে
কী হবে? তার চেয়ে ভালো এই অনিদ্রার বন, আর
লুটিয়ে-পড়া পাতার শব্দ। যত নিঃশ্বাস আমার---
সব গুঁজে দিই এই নিম্নগামী ঢেউয়ে। যত দূর থেকে
আসুক বাতাস, ঝরে-পড়ার আগে ব্যথায় বেঁকে
গেলে তোর মুখ আমিও দেখেছি;
এখন যে-মাছি
ওড়ে ওই চেহারার চারপাশে, তার ডানার কম্পনে
জেগে ওঠে নশ্বরতা; আর অনন্তের বনে
ঘুরে-ঘুরে
সরে যাব এই উপড়ানো হৃৎপিণ্ড নিয়ে, বহু দূরে...
রেললাইন শুধু রেললাইন... (০৪)
নিদ্রা থেকে জাগরণে গিয়ে আমাদের রেলপথ পুনরায়
ঢুকে যায় ঘুমে
মাঝখানে রান্নাঘর, কারুকাজ-ভরা শয়নকুঠুরি আর
তরঙ্গিত আকাশের তল
রাতভর কাঁপে জল, স্থির ঘাটে কাঁপে চালকরহিত নৌকা
আর স্বপ্নের হাওয়াঢেউয়ে নিদ্রিত আমাদের চুল।...
সূর্যের প্রসঙ্গ নেই, তবু ভোর আর গোধূলির টুকরোগুলি
আমাদের পথের দু’পাশে উদাসীন পাথরের মতো
পড়ে থাকে;
নৈঃশব্দ্য থেকে গান, নৈঃশব্দ্যে পুনরায়
গন্তব্যের গাম্ভীর্যকে ছুঁতে চায় আমাদের অন্যতর স্নায়ু...
অসংখ্য স্লিপারে আমরা রেখার ভারসাম্য রচনা করেছি;
তবু পটভূমি জাগরণে চৌচির, নিদ্রায় তলহীন নীল
কখনো-বা অন্ধকার, আর
আমাদের রেলগাড়ি স্টেশনবিমুখ, রাতভর প্রতিধ্বনিকামী
রেললাইন শুধু রেললাইন... (০৭)
মেনেছি প্রহেলিকা দেখেছি রাতভর
মানুষ ডুবেছিল কুয়াশাময় শীতে
প্রদোষ কেটে গেলে প্রয়োজনীয় স্বর
হারিয়ে যেতে থাকে আবহসঙ্গীতে...
ট্রেনের বাঁশি বাজে ঘুমের তীর থেকে;
বালক কান পেতে শুনেছে সেই গান
নিদ্রা নেই তার ব্যাকুল দুই চোখে
কিসের ব্যাকুলতা জানে না দেহযান!
কেন এ-চাকাগুলো এসেছে পুনরায়,
কেন যে প্রাণীদের জীবন সাময়িক?
ঘড়ির কাঁটা বেয়ে ট্রেনটি চলে যায়
স্টেশন নড়ে ওঠে ও-ঢেউ স্নায়বিক...
ফ্রেমের ছবিগুলো অপসৃয়মাণ---
নরম স্নায়ু ছাড়া কে বোঝে এই গান
সর্বশেষ এডিট : ২৫ শে অক্টোবর, ২০০৮ রাত ৯:২৪