থার্টি ফার্ষ্ট নাইট। মোট ২৭ টা উইডস। গাজা , গাঞ্জা , মারিউয়ানা , পট , পোপো , শুকনা , সবজি,জয়েন্ট বিভিন্ন নামে একে ডাকা হয়। অধিকাংশ নামই প্রচন্ড ভালোলাগা ও ভালোবাসা থেকে- এর ভক্তগন রেখেছেন। সেরকম ২৭ টা স্যস্থবান জয়েন্ট, ১২ জন মানুষ আর ২৪ প্যাকেট তেহারি নিয়ে শুরু হল ২০১৫।
১২ টা ১ বাজতেই শুরু হল 'দ্যা ট্রিপ' । তারপর পাগলামি বা মাতলামি যাই বলি। ঘোষনা করা হল, আগামী বছর যদি কেউ মারা যায় যার শরীরের অংগ প্রত্যঙ্গ দান না করা হবে সে একটা শুয়োরের বাচ্চা। আগামী বছরে যে বন্ধুদের প্রতি শ্রদ্ধাশীল না হবে, তার আসন্ন বিপদে মুখ টিপে হাসাহাসি করার অধিকার সবাইকে দেয়া হল। সবাইকে মনে করিয়ে দেয়া হল যে সে একটা মেয়ের গর্ভ থেকে এসেছে ।
সেকারনে, কোন মেয়ের সাথেই যেন কেউ খারাপ ব্যবহার না করে। আড্ডার মাঝপথে সাইকোডেলিক শোনা নিষিদ্ধ করা হল, প্রেমিকা অধ্যায় বাসায় পড়ে আসার জন্য আপামর বন্ধুদের উদ্দেশ্যে আহবান জানালেন এক ব্যর্থ প্রেমিক। এরকম আরও অনেক দফা উন্থাপন করা হল সে রাতে। যদিও এর সবকটি দফা মানা হয়নি, কিন্তু একদম প্রথম ও প্রধান দফা " আত্ম সম্মান বাচাতে- জান দেব " খুব সম্ভবত মানা হয়েছে, কেননা কাউকেই জান দিতে হয়নি শেষ পর্যন্ত।
বছরের প্রথম সকাল থেকেই ভিতরে একরকমের আনন্দ। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির নামে যে এক যুদ্ধের অভিজ্ঞতা আমার হয়েছে, মাত্রই সেই ঘাম শুকিয়েছে। ধর ফর করে ভেঙ্গে গেছে দুস্বপ্ন।
কোচিং সেন্টারের শিক্ষকদের করা খুচরো এবং সস্তা মোটিভেশনে আমার মন ভরত না। আমার মনে হত,অতী সাধারন একটা ব্যস্তবতাকে এরা অতী নাটকিয় করে ফেলে। নাটকিয়তা থিয়েটারে ভালোলাগে, ব্যস্তব চরিত্র ওরকম আচরন করলে হাসি আসে। বিরক্ত লাগে। আর কিছুদিন পরেই যখন বুঝতে পারলাম- এই ছোট্ট ফার্মগেট এলাকায় কোচিঙ্গের নামে যে জঘন্য প্রোপাগান্ডা গড়ে উঠেছে- তখন একটু ভয় লেগেছিল। এখানে পড়তে আসা প্রতিটি তরুন-তরুনি এক অদ্ভুদ পরিকল্পনার অংশ। একটা বলয়ে পাক খাচ্ছে। এখান থেকে যখন এরা বের হয়ে যাবে, তখন যদি সঠিক শিক্ষা না পায় তবে এই প্রজন্ম হবে, বাঙালি জাতীর ইতিহাসে সবথেকে ভয়ংকর।
আমি যে দেশটাকে দুচোখে দেখতে পারিনা, খুব পজেটিভ মন নিয়েও যে দেশের কথা শুনতে আমার বিরক্ত লাগে, সে দেশের জাতীয় ভাষার উপর অনার্স করার সুযোগ হল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। এ এমন এক অদ্ভুদ ভাষা যার নাম শুনলেই আমি এদিক ওদিক কি যেন একটা খুজি !
তাছাড়া জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে সাংবাদিকতা বিভাগেও চ্যন্স হয়ে গেল। সাংবাদিকরা সাংঘাতিক। সাংবাদিক হল জাতীর বিবেক। এবং ঐ একটা জায়গায় চেতনার মূল্য আছে। এই সই।
গতবছর শেষ হয়েছে ক্ষত দিয়ে- ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অংশ হতে পারিনি দেখে সাময়িকভাবে ভেঙ্গে পড়েছিলাম। কিন্তু তার প্রভাব আমার ব্যক্তিত্ত্বে পড়তে দেইনি কখনও। মন খারাপ করা আমার একটা গোপন বিলাসীতা। বিভিন্ন ব্যস্ততার ফাকে যদি কিছুক্ষন মন খারাপ করে থাকি তাতে কারও নিশ্চয়ই কিছু যায় আসে না। ওইসময়ে অবশ্য, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতি নয় বরং এই অদ্ভুদ পরীক্ষা পদ্ধতির প্রতি আমার কিছুটা বিদ্বেষ জন্মায়। তাছাড়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি না হলে আমার অধিকার কমে যাচ্ছেনা। সেখানে আমার প্রান প্রিয় বন্ধু-বান্ধবিরা যাচ্ছে। দু একজন সিনিয়র গোছের শীল্পমনা মানুষ আছে। তাছাড়াও রয়েছে অসংখ্য পরিচিত মুখ। ঠিক ঐ মুহুর্তে আমার মনে হয়েছিল, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের থেকে সাংবাদিকতা বিষয়টা বেশী জড়ুরি। এবং শেষমেশ অনেকের বারন আমাকে উপেক্ষা করতেই হল। থাকতে হল জীবনের প্রতি কিছুটা উদাসীন।
সবেমাত্র বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছি। প্রথম ক্লাসটা হবে ৮ জানুয়ারি। কিন্তু বাংলাদেশে এই বছরটা শুরুই হয় প্রচণ্ড রাজনৈতিক উত্তাপ দিয়ে। পর পর হরতাল। বিশ্ববিদ্যালয়ের দরজায় কপাট। গাড়ি পুড়ছে, বাস পুড়ছে। দু একদিনের ব্যবধানে একজন ছাত্র এবং ছাত্রী যথাক্রমে আগুনে পুড়ে কাবাব হয়ে গেল। মোড়ে মোড়ে প্রতিবাদ বেড়ুচ্ছে। রাজনীতির নামে চলছে হত্যা-খুন।
৫ই জানুয়ারি ঢাকায় একটি বড় সমাবেশকে কেন্দ্র করে তার দুদিন আগে থেকে প্রশাসন কার্যত অবরুদ্ধ করে রাখে বিএনপি প্রধান খালেদা জিয়াকে। গুলশানের অফিস থেকে বের হতে না পেরে খালেদা জিয়া অব্যাহতভাবে একটি অবরোধ কর্মসূচি চালানোর ঘোষণা দেন। শুরু হয় দেশ জুড়ে টানা অবরোধ, সহিংসতা। খালেদা জিয়া গুলশানের কার্যালয়ে দিবারাত্রি অবস্থান করতে থাকেন। একপর্যায়ে ভবনটি থেকে পুলিশ অবরোধ তুলে নিলেও খালেদা জিয়া সেখান থেকে বেরিয়ে আসতে অস্বীকৃতি জানান। টানা বিরানব্বই দিন সেখানে তিনি অবস্থান করেন। পুরো সময়টা বাংলাদেশ কার্যত অচল হয়ে পড়ে। রাজনৈতিক সহিংসতায় প্রাণ হারায় শতাধিক মানুষ।
অনিশ্চিত কালের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় স্বঘোষিত বন্ধ। সময় টিভি বলছে ক্যাম্পাস খোলা। কিন্তু গেলে কাউকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছেনা। সিনিয়র এসে কথা বলছেন- তাদের দলে যোগ দিতে আহবান জানাচ্ছে। প্রচন্ড শীতে চা খাওয়াচ্ছিলেন এটা একটা ইতিবাচক দিক। একদিন অবশ্য একটা ক্লাস কিভাবে যেন হয়ে গেল- সেদিন র্যাগ দেখলাম প্রকাশ্য। বাধনকে যখন নাচতে বলা হল, ও এতটাই নার্ভাস হয়ে গেলো যে, বেঞ্চ থেকে উঠতে পারছিল না। বৃষ্টির নাকের নিচে ঘামছিল। নিঝুমের নিশ্বাস ঘন হয়ে এল। তাজ জালনা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আছে। ইমরান কৌতুহলি চোখে ভাইয়াদের দেখছে।
আমার ডাক পড়ল। হাটু গেড়ে বসে- সিনিয়র আপুকে প্রপৌজ করতে হবে। শর্ত আছে, আপু যদি প্রপৌজে রাজি না হয় তবে আপাতত উল্লেখ করা যাবেনা এরকমের শাস্তি আছে। আর যদি রাজী হয়, তবে টিএসসিতে ওই আপু আমার সাথে চা খাবে। কফি উইথ কানিজ সামথিং আপু।
নাথিং লাষ্ট ফরএভার
উইল ইউ বি মাই নাথিং ?
আমি জানিনা সে কি বুঝেছিল। কিন্তু ইয়েস করে দিল। আমার গায়ে তখন অষ্ট্রেলিয়া থেকে আসা একটা ব্লেজার। দাম ৯২ ডলার। আপাতত আমি কোন প্রেম করছিনা, প্রেম করা মানে শরীরের কাছে, মনের কাছে, নিজের বহুমুখি ব্যক্তিত্ত্বের কাছে আত্মসমর্পন করা। সিনেমা ছাড়া কোন কিছুর প্রতি আত্মসম্পর্ন করার কোন ইচ্ছে আমার তখন তৈরী হয়নি। কোন মেয়ে যেন সেই চেষ্টা না করে- তাহলে ভুল হবে। সিনেমার থেকে সেক্সি এবং স্মার্ট মেয়ে বাংলাদেশে নেই। পাশে যদি প্রিয় সিনেমা চলে তবে আমি ৭০ টা হুর প্রত্যাখ্যান করতে পারি। এসব নিয়েই চা খেতে খেতে টিএসসিতে কথা হচ্ছিল। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম আড্ডাতেই- সিনেমার প্রতি আমার ভালোবাসা ক্ষতিকররকমের বেশী, তাছাড়া আমি অনেক উগ্র - এবং য়ামার কথায় অতিরিক্ত আমিত্ত্ব আছে বলে অভিযোগ আসল।
বিভিন্নরকম পার্টি থেকে অফার আসল। কিন্তু সরকারি পার্টির তোড়জোড়ে সেসব কিছু টিকলই না। সরকারি পার্টির মধ্যে আবার ভাগ হয়ে গেল। আঞ্চলিক রাজনীতির স্পষ্ট উদাহরন। গোপালগঞ্জের পার্টি সবথেকে ক্ষমতাশীল। এখন তারা ছোট্ট একটা টি এস সি দখল করেছে- অর্ধেক ভাড়া দিয়েছে চড়া টাকায়। তাছাড়া জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক জমি সন্ত্রাসীদের দখলে আছে। তা থেকে মুক্ত করার জন্য কয়েকবার আন্দোলনও হয়েছে। ছাত্ররাও যে হেরে যেতে পারে তার জলন্ত প্রমান নিয়েই বুড়িগঙ্গার তীরে দাঁড়িয়ে আছে দেশের তৃতীয়স্থানীয় বিশ্ববিদ্যালয়। দেশের সবথেকে প্রাচীন ইতিহাসের সাক্ষি যে- তার এরকম বিমর্ষ টিকে থাকা আমাকে ব্যাথা দেয়। কিন্তু ঐযে প্রথমেই বললাম- পৃথিবির সবথেকে বেশি সুখ হল বেচে থাকাটা।
সিনেমাকে ছাপিয়ে যেতে পারিনি কিন্তু সিনেমার সতীন হতে পারে এরকম একটা মেয়ের দেখা আমি পেয়ে গেলাম। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চ্যন্স না পাবার ক্ষত মেয়েটার এখনও শুকোয় নি। চঞ্চলতার মধ্যেও একরকমের আড়ষ্টতা। সাউথ কোরিয়ান মেয়েদের মত আচরন , রুশ মেয়েদের মত মানসিকতা আর পোশাক আশাকে ভারতিয় প্রভাব মেয়েটার আষ্টেপিষ্টে জড়ান। এরকম একটা মেয়ের সাথে যদি জীবনের একটা গল্প তৈরী হয় তাহলেতো খুব ভালো হয়। সেই তাড়নায়, আমাকে নিজের থেকে এগিয়ে গিয়ে গল্পটা শুরু করতেই হল, যদিও শেষটা খুব অবিবেচকের মত হয়েছিল।
চলবে......