পাপ্পু ভাই আমাকে বেশ কিছু বাংলা ছবি কিনে গিফট করেছিলেন। তার মধ্যে একটা শত্রু ভয়ংকর। এই ছবি দেখার প্লান আমার ছিলনা। পাপ্পু ভাইয়ের কথা মতো প্লান সাজিয়েছিলাম একসময়ের জনপ্রিয় পরিচালক দেওয়ান নজরুলের দুটি ছবি দেখবো। " ওস্তাদ সাগরেদ" ও "মাস্তান রাজা "। এতে নজরুলের ভাও বোঝা যাবে। আর যদি ভালোলাগে তবে রিভিউ হবে। কিন্তু একটা কি এক বিশেষ কারনে জসিম কালেকশনের ডিভিডিটা সাপোর্ট করানো যাচ্ছে না। অনেক কষ্টে মাস্তান রাজাটা উদ্ধার করা সম্ভব হলো কিন্তু ওস্তাদ সাগরেদ পেলাম না। তাই পাপ্পু ভাই দুটো দেখতেই নিষেধ করলেন, আগে দেখতে বললেন খোকনের শত্রু ভয়ংকর। দেখলাম এক অসাধারন সামাজিক-একশন ছবি------- শত্রু ভয়ংকর।
ছবির প্রথম দিকেই হুমায়ুন ফরিদীকে প্রদর্শন। আর সেই ভয়ানক, ঐতিহাসিক অভিনয় দ্বারা মুগ্ধ হলাম আর একবার। আর স্পেশালি পরিচালক খোকন আমাকে চমকে দিল। খোকনের প্রশংসা অনেক শুনেছি কিন্তু এবার সত্যিকার অর্থে অবাক হলাম। হুমায়ুন ফরিদী একজন সৎ ও সত্যবাদী ন্যায়ের পথে চলতে থাকা একজন ভদ্রলোককে খুন করে, অস্ত্র হলো বরফ। বরফের চৌকশ একটা টুকরো, টুকরোটা পেটে ঢুকিয়ে খুন করা হলো। কিছুক্ষন পর এই বরফের খন্ড রক্তের উত্তাপে গলে যাবে ফলে ফিঙ্গার প্রিন্টের কোন ব্যবস্থাই থাকবে না। এবং এই খুনের মাধ্যমেই প্রকাশিত হয়ে গেল, আগামীতে আরও কিছু চমকিত খুন অপেক্ষা করছে দর্শকের জন্য। এটা খুবই ভালো, বাংলা ছবির দিক থেকে এটা উচ্চ প্রশংসা পাবে।
ছবির গল্পটাও বেশ ভালো। বর্তমান বাংলাছবি এর কাছে কিছুই না।
গজব আলী ( হুমায়ুন ফরিদী ) একজন সৎ পুলিশকে হত্যা করে। সেই দৃশ্য সরাসরি দেখে পুলিশের ছোট ছেলে । সে সবাইকে বলে কিন্তু কেউ বিশ্বাস করেনা। কেননা সেটা একরকমের অসম্ভব । হুমায়ুন ফরিদী ঘটনার দিন খুন করতে পারেনা কেননা এর আগেরদিন-ই তার অনেক লোকের সামনে ফাসী হয়ে গেছে।
তারপর অনেকদিন পর এই পুলিশ অফিসারের দুই সন্তান একজন হয় নিতীবান পুলিশ ( সোহেল রানা)। আর অন্যজন পড়াশুনা শেষ করা বেকার ( রুবেল)। দুই ভাইয়ের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য অন্যরকম হলেও মিলটা একটাই দুইজনের একজনও অন্যায় সহ্য করতে পারেনা। বিভিন্নরকমের অন্যায়ের প্রতিবাদ করে বলে রাজাকে তার আদরের,মায়ের মতো ভাবি( শাবানা) একদিন মারধোর করে এবং উপার্জন করতে বলে। পরে রাজা চাকরি নেয় এক জনদরদী নেতার কাছে। এরপর ঘুরে যায় সিনেমার দৃষ্টিকোন।
পুরো ছবি জুড়েই আমি শুধু খোকনের নানা ধরনের পরিচ্ছন্নতার প্রমান পেয়েছি। ভদ্রলোক সত্যিকার অর্থে গুনি পরিচালক। প্রত্যেকটা দৃশ্য নিয়ে না ভাবলেও খোকন যে পুরো গল্পটা নিয়ে বেশ ভাবতেন তা বোঝা যায়। আমি বলতে চাচ্ছি, সাধারনত বাংলা ছবি দেখতে গেলে আমি কিছু হাস্যকর রহস্যের দেখা পাই যেরকম নায়ক উপস্থিত হলো কোথা থেকে? গুলি লাগলো পেটে তবে পিঠে রক্ত কেন? ঠিক এইসময়ে ওইসব জিনিষ পেল কোথায়, এই জায়গাটা আবার কোথায়, সাতদিনের কাজ করার কথা, দিনদিনে হয়ে গেল? ইত্যাদি বিভিন্নরকমের যে বোকাবোকা ভু্লগুলোর সাথে আমরা পরিচিত সেই ধরনের একটা ভুলও এই ছবিতে আমি পাইনি। আর এই ভুল না থাকার জন্য ছবিটিতে এসেছে একটা নতুন প্রান।
বরাবরের মতো মাতৃরুপী মায়ের চরিত্রে শাবানা খাপে খাপ। এবং একটা অসাধারন হলো, কিরকম একটা নতুন শাবানাকে দেখলাম বলে মনে হলো। ১৯৯২ সাল, ছবিটার মুক্তির সময়,এই সময়টাতে মনে হয় শাবানা "ইড্রাস্টি ছেড়ে যাব যাব " করছে।
সম্প্রতি সোহেল রানার প্রথম দিকের একটা ছবি " জারকা" দেখে এতটাই রাগ হচ্ছিলো যে অনশন নিব ভেবেছিলাম। "সিনেমা অনশন" হলো কোন বিষয়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়ে ৩ দিন নতুন কোন ছবি না খাওয়া। সারাজীবন ভেবেছি কিন্তু কখনোই "সিনেমা অনশন" নিতে পারিনি। কিন্তু এইখানে সোহেল রানাকে দেখে "রুট ভিউ" টা পরিষ্কার হয়ে গেল। কিন্তু যুক্তির গুটি ঘুরে ফিরে পরিচালকে দিকে যাচ্ছে। সোহাল রানার ভিতরে একরকমের স্টাইল ছিল। নায়ক নায়ক।
রুবেল এই সিনেমায় ফাটিয়েছে। একধরনের নতুন হেয়ার-কাট। একটু ভারি ভারি শরীর ঠিক আছে। রুবেলের ঝুলিতে গেল উচ্চ প্রশংসা তার মার্শাল-আর্ট জ্ঞানের জন্য। রুবেলের অন্যরকমের একটা বডি-লাঙ্গুয়েজ আছে। ওটা আমার ভালোই লাগে।
নায়িকা সাথিকে দেখে যার বমি না আসবে তার দিকে আমি অবাক হয়ে তাকাবো। খোকন কিরকম করে এই বস্তার মতো একটা মেয়েকে রুবেলের বিপরীতে কাষ্ট করলো ? মেয়ের না সুন্দর কন্ঠ, না সুন্দর তার শরীর, না সুন্দর তার চেহারা। মানে এইটা একটা জন্তু। এরকম কারনগুলোর জন্যই মানুষ বাংলা ছবি কমিয়ে দেখে। পরে আর দেখেই না। এরকম সাজানো-গোছানো একটা ছবিতে এইরকমের একটা " নায়িকা-ধাক্কা" দেওয়ার মানে কি ? একটা বিশেষ ভুল, বাংলা সিনেমার প্রতি একটা এলার্জিকাল আইটেম না থাকলে সিনেমা বানানোটাকে সার্থক মনে করেনা আমাদের পরিচালকরা। মাঝে মাঝে এদের বোকামিটা এতটাই উপরের আঘাত করে যা, এদেরকে গুনি বলতে গিয়েও বাধে, যে পরিচালক এইরকম একটা নায়িকা নিতে পারে সে এত সুন্দর সিনেমা বানালো? কপি-পেষ্ট নাতো ?
হুমায়ুন ফরিদী বরাবরের মতো "ফরিদীয়" অভিনয় দিয়ে মাতিয়ে দিলেন। ফরিদীর প্রতিটি সিনেমাতে ছিল তার একটা আলাদা " আউট- লুক "। একেরবার একেক রকমভাবে নিজেকে উপস্থাপন। এই ছবিতে ফরিদীর চরিত্রটা না ভালোলেগে পারবেনা। অসাধারন। সংলাপগুলোতে যথেষ্ট পরিমান "সেন্স অফ হিউমার" পাওয়া যায় । আর খোকন কিছু নিষ্ঠুরতা " আড " করে চরিত্রটিকে অন্যরকম একটা অন্যরকম লুক দিয়েছে। নায়িকার গায়ে মিষ্টি মিশ্রিত পানি ঢেলে তার পায়ের কাছে বিষ পিপড়া রেখে দেওয়াটা সত্যিকার অর্থে জঘন্য নিষ্ঠুরতার প্রকাশ। "সমাপ্ত"-এ নায়িকাকে পাওয়া যায় পরিত্যক্ত অবস্থায় পরে আছে, সারা গায়ে গোটা-গোটা। দেহে প্রান নেই, বিষ পিপড়ার কামরে মারা গেছে। ওই দৃশ্যটা অসাধারন।
আবুল হায়াৎ এর অভিনয় আমার সবথেকে বেশী ভালোলেগেছে। জনদরদী নেতার চরিত্রে একদম "ডিরেক্ট" অভিনয়। আবুল হায়াৎ এর অভিনয় দেখছিলাম আর আমার মনে পরছিল বর্তমান সময়ের জনপ্রিয় টিভি সিরিজ " স্পার্টাকাস" এর ডোমিনাস বাটিয়াকাস এর কথা। দুজনের চরিত্রে কিরকমের যেন একটু মিল আছে।
গান করেছে আলম খান। গুনি লোক, কিন্তু এর গানগুলো সেরকম কিছুই মনে হলোনা। কিন্তু সময়ের পেক্ষিতে অবশ্যই স্মার্ট সুর এবং আদর্শ দৃশ্যায়ন। গান গেয়েছেন তিনজন। ওইযে যে তিনজন আছে না সারাজীবন যারা গান-ই গেয়ে গেল। এন্ড্রু- সাবিনা-রুনা।
আমারতো ভালো লেগেছে।আমার দেখা সেরা বাংলা ছবিগুলোর মধ্যে একটা। এবং সামাজিক-একশন জেনারের সেরা ছবি "এখন পর্যন্ত" এটাই। খোকনের কাজ ভালোলেগেছে শুধুমাত্র "নায়িকা চয়ন" ছাড়া। খোকন জেমসবন্ড ফিল্মের খুব ফ্যান ছিলেন। বাংলাছবিতে ওইসব গ্যেজেট ব্যবহারের চেষ্টাও চালিয়েছিলেন। এবং খোকন স্বার্থক। ১০০% স্বার্থক। আমি একবসায় ছবিটা দেখেছি, "নায়িকা বিভ্রাট " থাকা স্বত্তেও প্রতিটা গান উপভোগ করেছি। এইযে বসিয়ে রাখার শক্তিটা এইটাই খোকনের ছিল হাতিয়ার। একটা বেশী কথা নেই, একটা বেশী দৃশ্য নেই। যা দেখানো হলো সিনেমার সার্থে। গল্পের সার্থে।
সংলাপের দিক থেকেও ভালো মানের ছবি এটা। আবুল হায়াৎ জনদরদী নেতা ( তলে তলে সন্ত্রাস দামে ক্ষমতা কিনতে চায় )। তার সাথে রুবেলের একসময়ের সংলাপ। আবুল হায়াৎ রুবেলকে বলছে............
তোমার কি দোষ? সারাদেশে দেশপ্রেমিকের ছদ্মবেশে মন্দলোকেরা ঘুরে বেড়াচ্ছে। মানুষ তাদের ক'জনকে চিনতে পারে।তোমার সেদিনকার ঘটনা, কোন ভুল না, মাই সন। এটা, এটা একপ্রকারের যুদ্ধ ঘোষনা। তোমরা নতুন প্রজন্মের সাহসী যোদ্ধারাইতো খুজে বের করবে দেশের আসল শত্রুদের। আর সেই মহৎ কাজটি করতে গিয়ে যদি একটু-আধটু ভুল হয়েও যায় । ক্ষতি কি ?
কিরকম যেন মনে হলো শাহবাগীদের উদ্দেশ্যে কথাটা বলা ।
ছবির নামঃ শত্রু ভয়ংকর
মুক্তির সালঃ ১৯৯২
অভিনয়েঃ হুমায়ুন ফরিদী,শাবানা, সোহেল রানা, রুবেল,সাঠি,আবূল হায়াৎ
পরিচালকঃ শহিদুল ইসলাম খোকন
রেটিং: ১০ এ ৭
শত্রু ভয়ংকর মুভির ডাউনলোড লিঙ্কঃ
ইউটিউব ১
ইউটিউব ২
বাংলা ছবি হিসেবে ছবিটা এ গ্রেডের। এইজন্য-ই এর রিভিউ করা। আমার চাওয়া হল মানুষের সামনে কিছু ভালো বাংলা ছবি ফোকাশ করা যাতে করে সে বাংলা ছবি দেখতে শুরু করে এবং একসময় ভালোবেসে ফেলে। আমার মনে হয়েছে এটা সেরকম একটা ছবি, তাই রিভিউ করে পোষ্ট করলাম। দেখলেই হয় এখন।
বাংলা চলচিত্র রিভিউ - ০০১: ভন্ড ( রুবেল,তামান্না,হুমায়ুন ফরিদী )
বাংলা চলচিত্র রিভিউ - ০০২: মরনের পরে ( অবশ্যই বাংলাদেশের আলোচিত এবং প্রশংসিত ছবিগুলোর মধ্যে অন্যতম।
বাংলা চলচিত্র রিভিউ - ০০৩: দেহরক্ষী ( হলের মধ্যে যারা উল্লাস করেছেন, আনন্দে সিটি দিয়েছেন আমি তাদের মধ্যে একজন)