[পূর্বকথা - পাণ্ডবরা রাজসূয় যজ্ঞ করে পিতাকে রাজা হরিশচন্দ্রের মত ইন্দ্রের স্বর্গে স্থান করে দিতে চায় ........কৃষ্ণ প্রথমে জরাসন্ধ বধের কথা বলেন ....ভীমার্জুনকে সাথে নিয়ে কৃষ্ণ গিরিব্রজে রওনা দেন ..ভীম যুদ্ধে জরাসন্ধকে বধ করেন]
অর্জ্জুনের দ্বিগ্বিজয় যাত্রাঃ
কৃতাঞ্জলি করে মহাবলী পার্থ অর্জুন রাজা যুধিষ্ঠিরকে বলেন –মহারাজ, আজ্ঞা করুন রাজসূয় যজ্ঞের আয়োজন করি।
অতুল কার্মুক(ধনুক), গান্ডীব ধনুক, অক্ষয় তূণ, কপিধ্বজ রথ, দেব দত্তাম্বুজ(অম্বুজ-পদ্ম), সুচারু তুরঙ্গম(ঘোড়া) বল নিয়ে আমরা রাজকোষের ধনবৃদ্ধি করব। অগম্য পথে উত্তরে গিয়ে আমি সকল রাজ্য জয় করব, সব রাজাদের বশ্যতা আদায় করব।
অর্জুনের কথা শুনে যুধিষ্ঠির তাকে স্নেহালিঙ্গনে সম্মতি জানালেন।
শুভক্ষণ দেখে ব্রাহ্মণদের মঙ্গলবচনের মাধ্যমে কৃষ্ণ-মাধবের স্মরণ নিয়ে যাত্রার আয়োজন হল। রথ, গজ, বাজী(অশ্ব), সেনারা সেজে উঠল।
উত্তরে অর্জুন গেলেন, পূর্বে ভীম, পশ্চিমে নকুল এবং কনিষ্ঠ ভাই সহদেব দক্ষিণ বিজয়ে বেরলেন।
অর্জুনের সেনা শ্বেত, পীত(হলুদ) নানাবর্ণে সেজে, বিবিধ বাজনা বাজিয়ে এগোতে থাকে। শঙ্খনাদ, হাতির গর্জন এবং বিবিন্ন শব্দে ক্ষিতি কেঁপে কেঁপে উঠল।
অর্জুন প্রথমে কুলিন্দ দেশে প্রবেশ করে অনায়াসে তাদের জয় করলেন।
কালকূট(বিপদসঙ্কুল) বর্ত্ম(পথ) পেরিয়ে সহজেই আনর্ত দেশের রাজাকে জয় করলেন।
শাকল সুদ্বীপ, প্রতিবিন্ধ্য রাজ্যও অনায়াসে জয় করলেন।
এরপর প্রাগ্জ্যোতিষ রাজ্যে এলেন।এই রাজ্যের রাজা ভগদত্ত ভুবন বিখ্যাত। তার অগণিত সেনা-যারা কিরাত(ব্যাধ) কাননবাসী। এই বন্য সৈনিকদের অসীম ধৈয্য। তাদের হাতে ধনুক, গুঞ্জহারের(কুঁচফলের) মালায় সজ্জিত, উঁচু করে ঝুঁটি বাঁধা, শরীরে বৃক্ষলতা বেষ্টিত। তারা পরম হরষে যুদ্ধ করতে লাগল। এভাবে উভয় পক্ষের সাঙ্ঘাতিক যুদ্ধ হল।
ভগদত্ত রাজা পুরন্দরাত্মজ(ইন্দ্রপুত্র) অর্জুনের সাথে সামনাসামনি যুদ্ধ করলেন। নানা অস্ত্রে, ধনুকে তারা তাদের সকল শিক্ষা প্রয়োগ করতে লাগলেন। মারুত(বাতাস), অনল(অগ্নি), সূর্য, বসু, জল-বিবিধ মন্ত্র শিক্ষা প্রয়োগ হল। আটদিন ক্রমাগত বিশ্রাম না নিয়ে উপবাসে দুই বীর যুদ্ধ করতে লাগলেন।
শেষে ভগদত্ত হেসে অর্জুনকে বলেন – হে মহামত্তবীর এবার রণে নিবর্ত হও। তুমি আমার সখা পুরুহূতের(ইন্দ্রের) যোগ্য পুত্র। তোমার শক্তি সম্পর্কে ধারনা ছিল না। এতদিনে তোমার যোগ্যতা জেনে খুশি হচ্ছি। কিসের কারণে তুমি এই যুদ্ধ করছ! কি চাও দয়া করে আমায় বল।
অর্জুন বিনয়ের সাথে বলেন –ধর্মপুত্র যুধিষ্ঠির কুরুকুলের রাজা হলেন। তিনি রাজসূয় ক্রতু(যজ্ঞ) করতে চান। আপনি যদি আমার উপর প্রীত হন তবে দয়া করে কিছু করদান করুন।
প্রাগ্জ্যোতিষের ভগদত্ত রাজা আনন্দ মনে বহু ধন দিয়ে অর্জুনের পূজা করলেন।
এরপর অর্জুন আবার আরো উত্তরে দিগ্বিজয়ে বেরলেন। বিভিন্ন পর্বতে শত শত রাজাদের হারিয়ে তাদের বশ্যতা নিলেন। কেউ আনন্দে ধন দিলেন, কেউবা সংগ্রাম করল।
উলূক(ইন্দ্র)পুত্রের সঙ্গে বৃহন্ত নৃপের অনেক যুদ্ধ হল।
মোদাপুরে দেবকসুদাম বহু ধন দান করল।
পৌরব পর্বতের রাজা সেনাবিন্দু অর্জুনের হাতে রত্নসিন্ধু তুলে দিল।
লোহিতদেশের মহাবল রাজা অর্জুনের অনেক পূজা করলেন।
ত্রিগর্তের রাজাকে অনায়াসে জয় করা গেল।
সিংহপুরের সিংহরাজ বশ্যতা জানাল।
বাহ্লীক, দরদ জয় হল।
রাজা কোকনদ, যিনি কামগিরির মাঝে বাস করেন, তার রাজ্যটি অপূর্ব সুন্দর। অশেষ ঘোটক(ঘোড়া), শুক্ল(সাদা) ময়ূর আনন্দে সারা দেশে ঘোরে। এই রাজাও অর্জুনকে আনন্দিত করলেন।
নৃপতি জীবন অর্জুনের সাথে মহারণ করলেন। শেষে হেরে পার্থের ভজনা করতে লাগলেন। এখান থেকেও পার্থ নানা বর্ণের রাশি রাশি ধনরত্ন পেলেন।
এভাবে একে একে সব দেশ জয় করে অর্জুন হেমন্তগিরিতে উঠলেন। সেখানেও অভেলে গন্ধর্ব দানবপুরী জয় করলেন।
কৈলাস পর্বতে কুবেরের বাসস্থান, সেখানে কোটি কোটি যক্ষ রক্ষের বাস। সেখানেও যুদ্ধ হল। শেষে কিরীটীর(অর্জুনের) জয় হল। ইন্দ্রের কুমার ইন্দ্রের সমান যুদ্ধ করে বহু যক্ষ মারতে লাগলেন। তারা ভয়ে পালিয়ে কুবেরের কাছে এসে বলে দেশে শত্রুর আক্রমণ ঘটেছে। শুনে বৈশ্রবণ(বিশ্রবা মুনির পুত্র-কুবের) বহু ধন নিয়ে পান্ডুপুত্রকে উপহার দিয়ে স্নেহের সাথে বিদায় জানালেন।
হাটক নগর, সেখানের গুহ্যকনিবাসীদের জয় করে অনেক ধন আহোরণ হল।
এভাবে বহু ধন রত্ন নিয়ে অর্জুন আনন্দ মনে আরো এগোতে লাগলেন।
মানসসরোবর দেখে পার্থ খুব সুখী হলেন। এই অমরনগরী কোটি কোটি শশিমুখী অপ্সরা কিন্নরী পূর্ণ। জিতেন্দ্রিয় ধীর পার্থ মহাবীর কারো পানে দৃষ্টি দেন না। সেই সরোবরে বহু ঋষি বাস করতেন, তারা অর্জুনকে অনেক আশীর্বাদ করলেন। সেখান থেকে কৌতুহল নিয়ে পার্থ আরো উত্তরে দ্রুত যেতে থাকলেন। সকল স্থানে তেজময় মার্তণ্ডের(সূর্যের) মত ঘুরে পার্থ ভারত জয় করতে লাগলেন।
আরো উত্তরে তিনি হরিবর্ষ নামে এক স্থানে এলেন। তাকে দেখে দ্বারপালরা লৌহদণ্ড নিয়ে তেড়ে এলো। জীবন্ত মানুষ দেখে তারা বিস্মিত হয়ে অর্জুনকে বলে –তোমার দেখছি খুব সাহস! মানব শরীরে এখানে উপস্থিত হয়েছ! এর আগে এমন কখনও দেখিনি। এবার নিজেকে নিবৃত কর। এস্থান কেউ জয় করতে পারে না। এই উত্তরপুর কুরুর নগর-এখানে কি কারণে এসেছ! এখানে তো কাউকে দেখতে পাবে না, জীবন্ত এখানে কেউ থাকে না, কার সাথে তুমি যুদ্ধ করবে!
কুন্তীপুত্র পার্থ দ্বারীদের বলেন –ধর্মপুত্র যুধিষ্ঠির ক্ষত্রিয় শ্রেষ্ঠ। আমি তার কিঙ্কর দাস মাত্র। তোমাদের লঙ্ঘন করে আমি পুরীতে প্রবেশ করব না, কথা দিচ্ছি। তবে তোমরা আমায় কিছু কর প্রদান কর।
একথা শুনে দ্বারপালরা বহু রত্ন এনে ধনঞ্জয়ের হাতে তুলে দিল। ধন পেয়ে পার্থ সানন্দ হৃদয়ে দক্ষিণে মুখ ফেরালেন।
ফেরার পথেও বহু মহীপালকে জয় করে কর আদায় করলেন।
শেষে বহু বাদ্য বাজিয়ে চতুরঙ্গে নিজ নগরে প্রত্যাবর্তন করলেন। তিনি বহু মণি, মরকত, কনক, রজত, মুক্তা, প্রবাল রাশি, বিবিধ বসন, গো আদি বাহন ও বহু দাসদাসী সঙ্গে আনলেন। জয় জয় শব্দে, শঙ্খের নিনাদে পার্থ ইন্দ্রপ্রস্থে প্রবেশ করলেন।
ইন্দ্রের আত্মজ পার্থ সজ্জা পরিবর্তন করে ধর্মপুত্রের সামনে উপস্থিত হলেন। মাটিতে দণ্ডবৎ হয়ে করজোড়ে যুধিষ্ঠিরকে প্রণাম জানালেন। ধিরে ধিরে তার অভিযানের সব কথা যুধিষ্ঠির শুনতে লাগলেন।
সব শেষে অর্জুন বলেন –উত্তরদিকের সকল নৃপ আপনার বশ্যতা মেনে নিয়েছেন। সকলে কর প্রদান করেছেন, দেখুন নৃপবর!
আনন্দে যুধিষ্ঠির অর্জুনকে আলিঙ্গন করলেন। অনেক ভাবে ভাইকে তুষ্ট করলেন। পার্থ যা যা এনেছিলেন সব রাজকোষে সঞ্চিত রেখে নিজ নিবাসে ফিরে গেলেন।
......................................
উৎসর্গ: সকল ব্লগার বন্ধুকে
.....................................
আগের পর্ব:
কথাচ্ছলে মহাভারত - ১২৮ Click This Link