এটা ঠিক আজকাল প্রায় প্রতিটি পত্রিকায় অণুগল্প লেখা হচ্ছে। অণুগল্পের বই বের হচ্ছে। খুবই ভাল খবর। বাংলা সাহিত্যের একটা দিক।
এই অণুগল্প কবে লেখা শুরু হয়েছিল, কে শুরু করেছিল, কোন লেখা অণুগল্প, কোন লেখা অণুগল্প নয় - এসবের চেয়ে খুব জরুরী যেটা সেটা হল এই অণুগল্পকে কিভাবে আরও ভালভাবে বেশি দিকে দিগ্বিদিকে ছড়িয়ে দেওয়া যায়। কিভাবে সাহিত্যধারায় সম্পৃক্ত করা যায়। কিভাবে সাহিত্যধারায় স্পষ্ট উচ্চারিত করা যায়। সেই বিষয়ে ভাবনা চিন্তা করা উচিত। তার জন্য যারা অণুগল্প লিখছে তাদের দায়িত্ব নিতে হবে সবচেয়ে বেশী।
এই অণুগল্প লিখিয়েদের লেখায় বহু এক্সপেরিমেণ্ট দেখা যাচ্ছে। এই এক্সপেরিমেণ্ট অনেক পাঠকের বোধগম্যের বাইরে চলে যাচ্ছে। আবার সেই লেখা কিছু পাঠক বলছে অসাধারণ, এটাই হল আসল অণুগল্প।
উভয় ক্ষেত্রে লেখকই কিন্তু পাঠক। যারা শুধু পাঠক তারা এ রকম 'গল্প নয় অথচ অণুগল্প'কে পাশ কাটিয়ে যাচ্ছে। অথবা পড়ছে না মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে।
আবার সেইসব শুধু পাঠক ছোট ছোট লেখা, দীপ্ত লেখা, মনগ্রাহী লেখা, অন্যভাবনার লেখা, ভাল বিষয় ভাবনার লেখা ঠিক পড়ছে। প্রশ্নোত্তর করছে। সেগুলো অণুগল্প কি না, গল্পের ফরম্যাটে আছে নাকি অণুগল্পের নিয়ম মানছে না, অণুগল্পের নিয়মটা কি ইত্যাদি নিয়ে সেইসব সাধারণ পাঠক বা শুধু পাঠক মাথা ঘামাচ্ছে না। তারা শুধু ভাল লাগা দেখছে।
কবিতার ক্ষেত্রে যেদিন থেকে জটিলতা, গদ্যের ঝলক, শব্দের ধাঁধা ইত্যাদি এল সেদিন থেকে কবিতার দিক থেকে অনেক পাঠক মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। সেরকম ভাবে অণুগল্পের ক্ষেত্রে গল্প কিন্তু গল্প নয় এটা অণুগল্প, আখ্যান কিন্তু আখ্যান নয় এটা অণুগল্প, এটি গল্পের মত বলেছি কিন্তু হাজার দিকের কথা বলা আছে তাই এটা অণুগল্প - ইত্যাদি গোলকধাঁধাঁয় পাঠক হাবুডুবু খেতে চায় কি?
যদি এই গোলকধাঁধাঁয় সে এখন হাবুডুবু খায়ও এক সময় সে যে মুখ ফিরিয়ে নেবে না তার নিশ্চয়তা কোথায়? যেমন কবিতার ক্ষেত্রে অনেক পাঠক মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। তার জন্য অবশ্য অনেক লেখক পাঠককেই দায়ী করে। তাতে সাহিত্যের কি লাভ?
মোদ্দা কথা হল সহজ সরল সাধারণ লেখাই আসল লেখা। সহজের মধ্যে সবচেয়ে বেশি মগজমারি। সে লেখকের দিক থেকে যেমন পাঠকের দিক থেকে তেমনি।
ছোট কিন্তু সহজ সরলভাবে সুনির্দিষ্ট বিষয়কে সামনে রেখে ভাবনার আড়ালে তুলে ধরার চেষ্টাই সাহিত্য। পড়ার সময় যেন সমস্ত শ্রেণির পাঠকের বুঝতে কোন অসুবিধা না হয়। আবার পড়ার পরে বিষয়ের গভীরে পাঠক যেন সহজেই ঢুকতে পারে। সেই লেখাই সাহিত্য। না হলে পড়তে পড়তে কিছুই বুঝতে পারলাম না আবার পড়ে তবে বুঝতে হবে তাহলে পাঠক সে লেখা আর পড়বে কি?
এক পাঠক কবিতা বুঝতে পারে নি বলে শ্রীজাত বলেছেন - "অসুবিধে নেই কিছু। আমিও মেটাফিজিক্স বুঝি না।"(ফেসবুক থেকে)।
অণুগল্পের লেখকও এমন বলতে পারেন। কিন্তু ওই যে মুখ ফিরিয়ে নেওয়া পাঠক কি আর ফিরবে?
তাই অণুগল্পের ক্ষেত্রে সমস্ত এক্সপেরিমেনণ্ট একটা অবস্থানে জুড়ে যাক যেটা হল সমস্ত শ্রেণীর পাঠকের কাছাকাছি হওয়া। অণুগল্পের অস্তিত্বকে আরও পাঠকের দরবারে পৌঁছে দেওয়া।
যে কোন অবস্থানে গল্প উপন্যাস প্রবন্ধ সাহিত্যধারায় আজও সমান জনপ্রিয়। কেন না তার সহজতা সরলতা পাঠকপ্রিয়তা। খুব বেশী এক্সপেরিমেণ্ট, খুব বেশি এটা নয় ওটা দারুণ, এটা অণুগল্প নয়, ওটাতে আপনি এটা দেন নি, এ করেন নি ও করেন নি ইত্যাদি (এসব তো চলতেই থাকবে) ভাবার চেয়ে বলার চেয়ে গভীর কিছু সহজ করে সাধারণভাবে সবাই লিখুক সবাই পড়ুক। সবগুলোই হোক অণুগল্প কিংবা অণুগল্প নয়।
লেখক নিজের শিক্ষা নিজে শিখুক। পাঠকের কাছে পৌঁছে যাক। সাহিত্য পাঠ করার সময় পাঠক কি ভাবে? এটা গল্পের মত পড়ব বা পড়েছি, এটা উপন্যাসের মত পড়ব বা পড়েছি, এটা প্রবন্ধের মত পড়ব বা পড়েছি, এটা কবিতার মত পড়ব বা পড়েছি কিংবা এটা অণুগল্পের মত পড়ব বা পড়েছি। তা কিন্তু পাঠক ভাবে না। পাঠক বিষয় ভাবনায় ডুবে যায়, ভাবনার আবেশে আবেশিত হয়, বিষয় ভাবনায় উদ্বেলিত হয়। সহজ পাঠের গভীর উপলব্ধিতে আরও সাহিত্য জীবন গড়ে তোলে। আরও বেশি সাহিত্য পাঠ করার আকাঙ্খা খুঁজে পায়।
তাহলে? সেই আরও বেশি সাহিত্য জীবনে, আরও বেশি সাহিত্য আকাঙ্খায় অণুগল্প তার অবস্থান আরও প্রসারিত করুক। সেই ভাবনাকে সামনে রেখে লেখা হোক আরও আরও অনেক অনেক অনেক অণুগল্প।