আমাদেরকে বলা হলো, গ্যাস সংকট সমাধান করা সম্ভব নয়, ফলে দ্রুত বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়ানোর জন্য তেল-ভিত্তিক কুইক রেন্টাল পাওয়ার প্ল্যান্ট বসানো ছাড়া কোন উপায় নেই। বলা হলো, কুইকরেন্টাল প্ল্যান্ট যেহেতু ৩ থেকে ৬ মাসের মধ্যে চালূ করা যাবে তাই বিদ্যুৎ সমস্যার সমাধানও কুইক হবে। ৩ থেকে ৬ মাসের কথা বলা হলেও কোন কুইক রেন্টালই সময় মতো চালু হয়নি এবং পরে যাও চালূ হয়েছে, নষ্ট ও পুরাতন যন্ত্রপাতি ব্যাবহার করার কারণে ঘোষিত উৎপাদন ক্ষমতার চেয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন সবসময়ই কম হয়েছে। এভাবে বেশি দামে কুইক রেন্টাল থেকে যে পরিমাণ বিদ্যুৎ অনিয়মিত ভাবে পাওয়া যাচ্ছে তার চেয়ে বেশি বিদ্যুৎ নষ্ট ও পুরাতন বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো মেরামত করলেই পাওয়া সম্ভব হতো।
নষ্ট বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো মেরামত করা হলে কুইক রেন্টালের চেয়ে বেশি বিদ্যুৎ সস্তায় পাওয়া যেতো:
গত ১২ জুন ২০১২ এর জেনারেশান রিপোর্ট অনুসারে পিক আওয়ারে সর্বোচ্চ বিদ্যুৎ উৎপাদিত হয় ৫,৫৫৪ মোগাওয়াট এবং সর্বোচ্চ চাহিদা ছিল ৬,০০০ মেগাওয়াট। অর্থাৎ সরকারি হিসেবে ঘাটতি ছিল প্রায় ৪৪৬ মেগাওয়াট যদিও এই হিসেব প্রকৃত ঘাটতির চেয়ে অনেক কম মনে হওয়াই স্বাভাবিক। বেসরকারি হিসেবে বিদ্যুৎ ঘাটতির পরিমাণ আরো বেশি- দেড় থেকে দুই হাজার মেগাওয়াট। পিডিবি’র জেনারেশন রিপোর্ট থেকে দেখা যায়, গ্যাসের কারণে বিদুৎ ঘাটতি ছিল মাত্র ২৮৩ মেগাওয়াট, তেলের সংকটের কারণে ৫৮৮ মেগাওয়াট এবং বিদ্যুৎ কেন্দ্রের বিভিন্ন ধরণের ত্রুটি ও সমস্যার কারণে উৎপাদন ক্ষমতার চেয়ে কম উৎপাদিত হয় ১৩৭৫ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ যার মধ্যে বেশিরভাগই রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন বিদ্যুৎ কেন্দ্র। এক দিকে হাজার হাজার কোটি টাকার ভর্তুকীর কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র বেড়েছে অন্যদিকে সস্তায় বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে সক্ষম রাষ্ট্রীয় বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো অচল হয়েছে।
এখন কুইক রেন্টাল কেলেংকারি করে দেশের অর্থনীতির বারোটা বাজানোর পর, সরকার দ্বায়িত্ব নেয়ার সাড়ে তিন বছরের মাথায় ১৫টি পুরানো বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ২৬টি ইউনিট সংস্কারের উদ্যোগ নেয়ার কথা বলছে সরকার যার মাধ্যমে ১৬০৯ মেগাওয়াট বাড়তি বিদ্যুৎ পাওয়া যাবে। বিডিনিউজ২৪ এর রিপোর্ট অনুসারে কেন্দ্রগুলো হলো:
গ্যাসনির্ভর ঘোড়াশাল স্টিম টারবাইন কেন্দ্রের ৫৫ মেগাওয়াটের ২ নম্বর, ২১০ মেগাওয়াট করে ৩, ৪, ৫ নম্বর ইউনিট, হরিপুর গ্যাস টারবাইনের ৩২ মেগাওয়াট করে ১, ২, ৩ নম্বর ইউনিট, চট্টগ্রাম (রাউজান) স্টিম টারবাইনের ২১০ মেগাওয়াটের ২ নম্বর ইউনিট, শিকলবাহা স্টিম টারবাইনের ৬০ মেগাওয়াটের ১ নম্বর ইউনিট, ফেঞ্চুগঞ্জ কম্বাইন্ড সাইকেল গ্যাস টারবাইন-১ এর ৩২ মেগাওয়াটের ১ নম্বর ইউনিট, ফেঞ্চুগঞ্জ কম্বাইন্ড সাইকেল গ্যাস টারবাইন-২ এর ৩২ মেগাওয়াটের ১ নম্বর ইউনিট, ফেঞ্চুগঞ্জ কম্বাইন্ড সাইকেল স্টিম টারবাইনের ৩৩ মেগাওয়াটের ১ নম্বর ইউনিট, সিলেট গ্যাস টারবাইনের ২০ মেগাওয়াটের ১ নম্বর ইউনিট এবং বাঘাবাড়ি গ্যাস টারবাইনের ৭১ মেগাওয়াটের ১ নম্বর ইউনিট।
এছাড়া ফার্নেস অয়েল নির্ভর খুলনা স্টিম টারবাইনের ৬০ ও ১১০ মেগাওয়াটের ১ ও ২ নম্বর ইউনিট এবং ডিজেলনির্ভর বরিশাল গ্যাস টারবাইনের ২০ মেগাওয়াট করে ১, ২ নম্বর ইউনিট, ভেড়ামারা গ্যাস টারবাইনের ২০ মেগাওয়াটের ১, ২, ৩ নম্বর ইউনিট, রংপুর গ্যাস টারবাইনের ২০ মেগাওয়াট ১ নম্বর ইউনিট এবং সৈয়দপুর গ্যাস টারবাইনের ২০ মেগাওয়াটের ১ নম্বর ইউনিট।
কর্ণফুলী জল বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ৪০ মেগাওয়াটের ১, ২ নম্বর এবং ৫০ মেগাওয়াটের ৩ নম্বর ইউনিটও সংস্কার করা হবে।
অথচ আমরা শুরু থেকেই দ্রুত বিদ্যুৎ উৎপাদনের বাড়ানোর উপায় হিসেবে পুরোনো বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো মেরামত করার কথা বলে আসছি।কিন্তু বিদ্যুৎ সংকট সমাধানের বদলে লুটপাটকে প্রাধান্য দেয়ার ফলে সরকার সে দিকে নজরই দেয় নি যার ফলাফল হলো আজকের তীব্র বিদ্যুৎ সংকট। গত ১২ই জুন ২০১২ তারিখের পিডিবি’র জেনারেশান রিপোর্ট অনুসারে মোট উৎপাদিত ৫৫৫৪ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ এর মধ্যে রেন্টাল ও কুইকরেন্টালের অবদান ছিল ১৩৩৫ মেগাওয়াট অথচ মোট স্থাপিত ক্ষমতা বা ইনস্টল্ড ক্যাপাসিটি ২০৩৪ মেগাওয়াট। সরকারের ২৬টি ইউনিট সংস্কারের ঘোষণা থেকেই স্পষ্ট যে নষ্ট ও পুরাতন বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো মেরামত করলে ১৬০৯ মেগাওয়াট বাড়তি বিদ্যুৎ সস্তায় অনেক আগেই পাওয়া যেত যা কুইক রেন্টালের মাধ্যমে উৎপাদিত ১৩৩৫ মেগাওয়াটের চেয়ে ২৭৪ মেগাওয়াট বেশি । সেই সাথে ২০৩৪ মেগাওয়াটের জন্য রেন্টাল ফি পরিশোধ করে মাত্র ১৩৩৫ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ অতি উচ্চ মূল্যে কেনা লাগতো না।
কুইক রেন্টালগুলো প্রায়ই বন্ধ রাখা হলেও মালিকরা ঠিকই “ভাড়া” পাচ্ছে:
কুইক রেন্টাল বিদ্যুত কেন্দ্রে বাড়তি ভর্তুকী সামাল দেয়ার কথা বলে বিদ্যুতের দাম বাড়িয়ে এখন কুইক রেন্টাল বিদ্যুত কেন্দ্রের বেশির ভাগই বন্ধ রাখা হচ্ছে। যেমন: গত ২১ এপ্রিল উতপাদন ক্ষমতার চেয়ে কম বিদ্যুত উতপাদিত হয়েছে প্রায় ৩ হাজার মেগাওয়াট(২৯৯৪ মে:ও) যার মধ্যে গ্যাস সংকটের জন্য ৩২৩ মে:ও:, তেল ভিত্তিক রেন্টাল পাওয়ার প্ল্যান্ট বন্ধ রাখার কারণে ১৪২৪ মে:ও:, পানির সংকটের জন্য পানি ভিত্তিক ৭১ মে:ও: এবং বিদ্যুত কেন্দ্র নষ্ট থাকার কারণে ১১৭৬ মে:ও বিদ্যুত কম উতপাদিত হয়েছে। পিডিবি’র ওয়েবসাইটের ডেইলি জেনারেশান আরকাইভ থেকে দেখা যায়, এভাবে প্রতিদিন গড়ে ১৩০০/১৪০০ মে:ও: বিদ্যুত কম উতপাদিত হচ্ছে তেল ভিত্তিক রেন্টাল পাওয়ার প্ল্যান্টে তেল সরবরাহ না করার জন্য। এর ফলে একদিকে জনগণ বিনা কারণে বিদ্যুৎ না পেয়েই ইউনিট প্রতি বাড়তি মূল্য পরিশোধ করছে(এত বড় লুটপাট!) এবং বাড়তি মূল্য দিয়েও লোড শেডিং এর যন্ত্রণা ভোগ করছে/করবে অন্যদিকে কুইক রেন্টাল প্ল্যান্টগুলোকে বসিয়ে রাখার জন্য সরকারকে জনগণের অর্থে কুইক রেন্টালের মালিকদের কাছে জরিমানা বাবদ রেন্টাল ভাড়া ঠিকই গুনতে হচ্ছে।
উৎপাদন ক্ষমতার চেয়ে কম বিদ্যুৎ উৎপাদন হওয়ার ঘটনাটা শুধু ১ দিনের না, আমরা যদি এ বছরের গোটা এপ্রিল মাসের তেল ভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর জেনারেশান রিপোর্ট দেখি, তাহলে দেখা যায় ফার্নেস ওয়েল ভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর ইন্সটল্ড ক্যাপাসিটি ১১৪৪ মেগাওয়াট হলেও এ মাসে দিনের সর্বোচ্চ উৎপাদন ছিল গড়ে ১২৭ মেগাওয়াট যা উৎপাদন ক্ষমতার মাত্র ১১% এবং সন্ধ্যা বেলা সর্বোচ্চ উৎপাদন ছিল গড়ে ৬৩২ মেগাওয়াট যা উৎপাদন ক্ষমতার মাত্র ৫৫%। একই ভাবে ডিজেল ভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর ইন্সটল্ড ক্যাপাসিটি ৬৫৭ মেগাওয়াট হলেও এ মাসে দিনের সর্বোচ্চ উৎপাদন ছিল গড়ে ১৪৭ মেগাওয়াট যা উৎপাদন ক্ষমতার মাত্র ২২% এবং সন্ধ্যা বেলা সর্বোচ্চ উৎপাদন ছিল গড়ে ২০০ মেগাওয়াট যা উৎপাদন ক্ষমতার মাত্র ৩০% অথচ বিল পরিশোধ করার সময় বিদ্যুৎ কেন্দ্রের মালিককে পুরো উৎপাদন ক্ষমতার হিসেবেই "রেন্টাল ফি" বা ভাড়া পরিশোধ করতে হয়েছে।
কুইক রেন্টাল চুক্তি অনুসারে, বিদ্যুতের ক্রয় মূল্য "রেন্টাল" এবং "এনার্জি" এই দুই ভাগে বিভক্ত। প্রতি ইউনিট বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য ইউনিট প্রতি যে মূল্য পরিশোধ করা হয় সেটা হলো "এনার্জি প্রাইস", বিদ্যুৎ কম উৎপাদিত হলে "এনার্জি প্রাইস" কম পাবে বিদ্যুৎ কেন্দ্রের মালিক। কিন্তু "রেন্টাল প্রাইস" হলো স্থাপিত উৎপাদন ক্ষমতার ভাড়া যা মাসিক ভিত্তিতে পরিশোধ করা হয়। এটাকে "ক্যাপাসিটি চার্জ" ও বলা যেতে পারে। একটি ফার্নেস ওয়েল ভিত্তিক রেন্টাল পাওয়ার প্ল্যান্টের চুক্তির খসড়া থেকে দেখা যাচ্ছে, মাসে প্রতি কিলোওয়াট উৎপাদন ক্ষমতার জন্য সরকারকে ভাড়া গুনতে হবে ১৫.৯ ডলার। এভাবে ৫০ মেগাওয়াট ক্ষমতার একটি ফার্নেস তেল ভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র বসানো হলেই যদি এক ইউনিট বিদ্যুৎ ও এখান থেকে উৎপাদিত না হয়, যদি মেরামত বা জ্বালানির সংকটের কারণে বিদ্যুৎ উৎপাদন একেবারে বন্ধ থাকে বা কম উৎপাদিত হয় তাহলেও কিলোওয়াট প্রতি মাসে ১৫.৯ ডলার হারে ৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্য সরকারকে ভাড়া গুণতে হবে সাড়ে ৬ কোটি টাকা! চুক্তিতে এ বিষয়ে বলা হয়েছে:
"কোন কারণে বিপিসি যদি ভাড়া বিদ্যুৎ কোম্পানিকে জ্বালানি তেল সরবরাহ করতে ব্যর্থ হয় তাহলে কোম্পানি বিদ্যুতের দামের রেন্টাল বা ভাড়ার অংশটুকু পাবে। "(আর্টিক্যাল ২৬, তরল জ্বালানি সরবরাহ)
“Any failure of BPC to supply and deliver liquid fuel to the Rental Power Company shall entitle the Company to receive the Rent part of the tariff…” (Article 26 Delivery and Supply of Liquid Fuel)
ফলে কুইক রেন্টাল সারা বছর পূর্ণ উৎপাদন ক্ষমতায় না চললেও ভাড়াবিদ্যুৎ কেন্দ্রের মালিকদের কোন ক্ষতি নেই! আর এ কারণেই রেন্টাল কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে কাঙ্খিত বিদ্যুৎ উৎপাদিত না হলেও, সরকার তেল সরবরাহ করতে ব্যার্থ হলেও, অর্থের অভাবের কথা বলে কেন্দ্রগুলো বন্ধ করে রাখলেও বেসরকারি খাতে এ ধরণের বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন বন্ধ হচ্ছে না। বিডিনিউজ২৪ ১৫জুন এর সংবাদ অনুসারে তেলভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র চালাতে গিয়ে আর্থিক সংকটে পড়লেও একই ধরনের আরো ২৭টি কেন্দ্র চালু হতে যাচ্ছে এবছরের মধ্যে যার মধ্যে মধ্যে বেসরকারি খাতে ঢাকার গাবতলীতে ৫০ মেগাওয়াট, কেরানীগঞ্জের বসিলায় ১০৮ মেগাওয়াট ও ৫২ দশমিক ০৫ মেগাওয়াট, জামালপুরে ১০৮ মেগাওয়াটের পিকিং পাওয়ার প্ল্যান্ট, খুলনায় ৯৫ মেগাওয়াটের পিকিং পাওয়ার প্ল্যান্ট, চট্টগ্রামের পতেঙ্গায় ১০০ মেগাওয়াট, রাজশাহীতে ১০৮ মেগাওয়াট, কুমিল্লার হোমনায় ৫২ মেগাওয়াট, মুন্সিগঞ্জের কাঠপট্টিতে ৫২ দশমিক ০৫ মেগাওয়াট, টাঙ্গাইলে ১০৮ মেগাওয়াট ও নারায়ণগঞ্জে ৫০ মেগাওয়াট ক্ষমতার কেন্দ্র নির্মাণ করা হবে।
পুরাতন বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর ইফিসিয়ান্সি বাড়ানোর মাধ্যমেও বিদ্যুৎ সংকটের সমাধান হতো পারতো:
নষ্ট ও বন্ধ হয়ে যাওয়া বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর মেরামত করার পাশাপাশি পুরাতন বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোকে আধুনিকায়ন করে থার্মাল ইফিসিয়ান্সি বা তাপীয় কর্মদক্ষতা বাড়ানো জরুরী। প্রতিবছর একটি তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের ইফিসিয়ান্সি ০.২% করে কমতে থাকে। ফলে বিদ্যুৎ কেন্দ্র পুরাতন হয়ে গেলে ব্য়লার, টারবাইন, জেনারেটর ইত্যাদির মেরামত ও আধুনিকায়নের মাধ্যমে যেমন ইফিসিয়ান্সি বাড়ানো যায় তেমনি সিম্পল সাইকেল বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোকে কম্বাইন্ড সাইকেল বিদ্যুৎ কেন্দ্রে পরিণত করে নির্গত তাপকে পুনরায় বিদ্যুৎ উৎপাদনের কাজে ব্যাবহার করা যায়। এভাবে একটি গ্যাস ভিত্তিক সিম্পল সাইকেল তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্রের গ্যাস টারবাইন হতে নির্গত তাপকে হিট এক্সচেঞ্জারের মাধ্যমে আরেকটি স্টিম টারবাইনে চালনা করে একই পরিমাণ জ্বালানিতে আগের চেয়ে ১৫-২০% বেশি বিদ্যুৎ উৎপাদন করা যায়। একটা উদাহরণ দেয়া যাক। উদাহরণটি পিডিবির চেয়ারম্যানের দেয়া তথ্য থেকেই দেয়া হচ্ছে। ঘোড়াশাল গ্যাস ভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রে মোট ৬ টি ইউনিট আছে যার মধ্যে ৪টি ২১০ মেগাওয়াট ক্ষমতার। এরকম একেকটি সিম্পল সাইকেল ইউনিট থেকে ২১০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে হলে গ্যাস লাগে ৫০ মিলিয়ন ঘনফুট। এই ইউনিটগুলোর ইফিসিয়ান্সি মাত্র ৩৩%। এখন একেকটি ২১০ মেগাওয়াটি প্ল্যান্টকে যদি কম্বাইন্ড সাইকেলে রুপান্তর করা যায় তাহলে ইফিসিয়ান্সি বেড়ে ৫০% এরও বেশি হবে এবং বাড়তি মাত্র ৪০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ করে বাড়তি ৪০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ অথাৎ মোট ৬১০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করা সম্ভব। এভাবে চারটি ইউনিট থেকেই এতদিনে বাড়তি আরো ১৬০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ পাওয়া সম্ভব হতো যদি সরকার শুরুতেই এই উদ্যোগটি গ্রহণ করতো। তিন বছর পার করে এসে তারা এখন চামড়া বাচানোর জন্য এই ধরণের উদ্যোগের প্রয়োজনীয়তার কথা বলছে যা সরকারের মেয়াদে আদৌ বাস্তবায়ন হবে কিনা সন্দেহ আছে। এগুলো যে শাসক গোষ্ঠীর অজানা তা নয়, দেখা যাচ্ছে এডিবি'র Industrial Energy Efficiency Finance Program (RRP BAN 45916) নামের একটি স্টাডিতে বলা হয়েছে বাংলাদেশের ৭৭% গ্যাস ভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রই পুরোনো ইনইফিসিয়ান্ট যন্ত্রপাতি ও প্রযুক্তি ব্যাবহার করে চলছে। কিন্তু বিদ্যুৎ সংকটকে কাজে লাগিয়ে শাসক গোষ্ঠী কুইক রেন্টালের মাধ্যমে লুটপাটের দিকে মনোযোগ দেয়ার ফলে বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর আধুনিকায়নের দিকে সময় মতো কোন মনোযোগ বা উদ্যোগ নেয় নি।
সময় মতো গ্যাস উৎপাদন বাড়িয়েও বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়ানো যেত:
কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র বসানো মাধ্যমে ৩ মাস বা ৬ মাস তো দুরের কথা গত ৩ বছরেও কুইক রেন্টাল দিয়ে বিদ্যুৎ সমস্যার সমাধান হয় নি উল্টো অযত্ন ও অবহেলায় সস্তায় বিদ্যুৎ উৎপাদনক্ষম বড় বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো একটার পর একটা নষ্ট হয়েছে, হাজার হাজার কোটি টাকার ভর্তুকী দিতে হয়েছে, ভর্তুকী কমানোর অযুহাতে বিদ্যুৎ-গ্যাস-জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানো হয়েছে। অন্যদিকে অর্থের অভাবের কথা বলে বাপেক্সকে সময় মতো গ্যাস অনুসন্ধান ও উত্তোলণের অর্থ বরাদ্দ দেয়া হয়নি। ফলে নিশ্চিত পাওয়া যাবে এমন বিপুল গ্যাসও সময় মতো উত্তোলন করতে পারেনি বাপেক্স। আর এইভাবে গ্যাস সংকটকে জিইয়ে রেখে গ্যাস ভিত্তিক বড় বিদ্যুৎ কেন্দ্রের পরিকল্পনা করা হয়নি এবং যেগুলো করা হয়েছে সেগুলোতে কোন অর্থ বরাদ্দ দেয়া হয় নি।
সরকার ক্ষমতায় আসার পরপর গ্যাস সংকট সমাধানের জন্য বাপেক্সের মাধ্যমে নতুন কূপ খনন ও পুরোনো কুপ সংস্কারের উদ্যোগ নিলে আমরা এতদিনে আরো ৩০০ মিলিয়ন ঘনফুট বাড়তি গ্যাস পেতাম। অথচ বাপেক্সকে দিয়ে কূপ খননের বদলে দ্রুত কুপ খননের কারণ দেখিয়ে বিদেশী কোম্পানিকে দিয়ে কুপ খননের জন্য সরকার "ফাস্ট ট্র্যাক প্রোগ্রাম" হাতে নেয়। পরিকল্পনা অনুসারে প্রোগ্রামটি ২০০৯ সালের অক্টোবর মাসে শুরু হয়ে ২০১২ সালের ডিসেম্বরে শেষ হওয়ার কথা।আমরা দেখলাম টেন্ডারে নির্বাচিত কোম্পানির মামলা মোকদ্দমা এবং নির্বাচিত কোম্পানির কাজ করতে অস্বীকৃতি ইত্যাদি নাটকের মাধ্যমে আড়াই বছরেরও বেশি সময় নষ্ট করার পর গত ২৬ এপ্রিল ২০১২ তে কোন ধরণের দরপত্র আহবান ছাড়াই ২০ মাসে কাজ সম্পন্ন করার কথা বলে কূপ প্রতি বাপেক্সের চেয়ে ৩গুণ বেশি খরচ করে মোট ১০টি কুপ খননের চুক্তি করা হলো রাশিয়ার কোম্পানি গ্যাজপ্রমের সাথে।অথচ ক্ষমতায় আসার সাথে সাথে বাপেক্সকে এই ১০টি কুপ খননের দ্বায়িত্ব প্রদান করে সময় মতো অর্থ সরবরাহ করা হলে এতদিনে ৩০০ মিলিয়ন ঘনফুট জাতীয় গ্রিডে যুক্ত হয়ে যেত যার মাধ্যমে ১৫০০ মেগাওয়াট ক্ষমতার নতুন গ্যাস ভিত্তিক কম্বাইন্ড সাইকেল বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ করা যেত।
মোট কথা,কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের সাথে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সমস্যা সমাধানের কোন সম্পর্ক নেই,কুইক রেন্টাল যদি অপরিহার্য হয় তবে সেই অপরিহার্যতা লুটপাটের অপরিহার্যতা, বিদ্যুৎ সংকট সমাধানের নয়।সময় মতো পুরাতন নষ্ট বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো মেরামত করা হলে,পুরাতন বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর ইফিসিয়ান্সি বাড়ানো হলে এবং বিদ্যমান ও নতুন গ্যাস ক্ষেত্রগুলো থেকে বাপেক্সের মাধ্যমে দ্রুত বাড়তি গ্যাস উত্তোলণ করে গ্যাস ভিত্তিক বড় বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ করা হলে অনেক কম খরচে কম সময়ে এতদিনে বিদ্যুৎ সমস্যার সমাধান হয়ে যেতে পারতো।