ভারতের একটি খবর:
গত ৮ অক্টোবর ২০১০ তারিখে ভারতের দ্যা হিন্দু পত্রিকায় একটি খবর প্রকাশিত হয়, শিরোনাম: ”মধ্যপ্রদেশে এনটিপিসি’র কয়লা ভিত্তিক প্রকল্প বাতিল”। খবরে বলা হয়: জনবসতি সম্পন্ন এলাকায় কৃষিজমির উপর তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্র গ্রহন যোগ্য হতে পারে না বলে ভারতের কেন্দ্রিয় গ্রীন প্যানেল মধ্যপ্রদেশে ন্যাশনাল থারমার পাওয়ার করপোরেশন(এনটিপিসি) এর ১৩২০ মেগাওয়াটের একটি বিদ্যুৎ উৎপাদন প্রকল্পের অনুমোদন দেয়নি। ভারতের সরকারি এই প্রতিষ্ঠানটি নরসিঙ্গপুর জেলার ঝিকলি ও তুমরা গ্রামের ১০০০ একর জমির উপর একটি ২X৬৬০ মেগাওয়াটের বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের প্রস্তাব দিয়েছিল।
সম্প্রতি পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের এক্সপার্ট এপ্রাইজাল কমিটি(ইএসি)’র এক সভায় বলা হয়, বিদ্যুৎ কেন্দ্রটির জন্য নির্ধারিত স্থানটি মূলত কৃষিজমি প্রধান এবং এ বিষয়ে প্রকল্পের স্বপক্ষের লোকদের দেয়া তথ্য যথেষ্ট নয়। বলা হয়, ”এই স্থানটির বিশাল অংশ জুড়ে রয়েছে দো’ফসলি কৃষি জমি, যা মোটেই গ্রহণযোগ্য নয়।”
কমিটি আরো মনে করে, গাদারওয়ারা শহরের এত কাছে এরকম একটি বিদ্যুৎ কেন্দ্র কাঙ্খিত নয়। তাছাড়া, নরমদা নদী থেকে প্রকল্পের জন্য ৩২ কিউসেক পানি টেনে নেওয়াটাও বাস্তবসম্মত নয় যেহেতু রাজ্য সরকার ইতোমধ্যেই আরো অনেক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্য এই নদীর পানি বরাদ্দ দিয়ে বসে আছে।
সূত্র: NTPC’s coal-based project in MP turned down
বাংলাদেশের খবর:
বাংলাদেশ ভারত জয়েন্ট ভেঞ্চারে বাগেরহাটের রামপালে ১৩২০ মেগাওয়াটের(২*৬৬০) একটি বিদ্যূৎ কেন্দ্র স্থাপিত হতে যাচ্ছে। বাংলাদেশের বিদ্যুৎ উন্নয়ণ বোর্ড(পিডিবি) ও ভারতের ন্যাশনাল থার্মান পাওয়ার কোম্পানি(এনটিপিসি) যৌথ অর্থায়নে প্রায় এই বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি নির্মাণের চুক্তি স্বাক্ষরিত হচ্ছে আজ ২৯ জানুয়ারি ২০১২। বিদ্যুতের দাম, কয়লার উৎস নির্ধারণ না করেই এবং কৃষি জমি নষ্ট ও পরিবেশগত প্রভাব বিষয়ক আপত্তি উপেক্ষা করেই এই চুক্তিটি স্বাক্ষরিত হতে যাচ্ছে। রামপাল উপজেলার সাপমারি, কাটাখালি ও কৈগরদাসকাঠি মৌজায় বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের জন্য ভূমি মন্ত্রণালয় ইতোমধ্যে ১,৮৩৪ একর ভূমি অধিগ্রহণের কাজ শুরু করেছে।
সূত্র: Indo-Bangla power deal today
কোথা থেকে কয়লা আসবে বিদ্যুৎ এর দাম কত হবে অনিশ্চিত
সুন্দরবনের পাশে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র না করার দাবি
জরুরী প্রশ্ন:
তাহলে দেখা যাচ্ছে কৃষিজমি, নিকটবর্তী জনবসতি ও শহর থাকা, নদীর পানি স্বল্পতা, পরিবেশগত প্রভাব ইত্যাদি নানান বিবেচনায় যে এনটিপিসি’র মধ্যপ্রদেশে প্রস্তাবিত কয়লা ভিত্তিক তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র ভারতের পরিবেশ মন্ত্রণালয় বাতিল করে দিয়েছে, সেই এনটিপিসি-ই বাংলাদেশের সাথে কথিত যৌথ বিনিয়োগে একই রকমের একটি বিদ্যুৎ কেন্দ্র বাগেরহাটের রামপালে নির্মাণ করতে যাচ্ছে। এখন প্রশ্ন হলো, যে যে বিবেচনায় এনটিপিসি নিজের দেশে বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ করতে পারে নি, বাংলাদেশে বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের সিদ্ধান্ত ও অনুমোদনের বেলায় কি সেই বিষয়গুলো বিবেচনা করা হয়েছে? বিদ্যুৎ কেন্দ্রটির সম্ভাব্য অর্থনৈতিক-সামাজিক-পরিবেশগত প্রভাব যাচাইয়ের লক্ষে অর্থনৈতিক-সামাজিক ফিজিবিলিটি স্টাডি কিংবা পরিবেশ গত সমীক্ষা(ইএসি) করার পরই কি এ সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে? পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত খবর অনুসারে ২০১০ সালের সেপ্টম্বর মাসে পিডিবির দেয়া ২ লক্ষ ৫০ হাজার ডলারের বিনিময়ে ভারতের এনটিপিসি একটি ফিজিবিলিটি স্টাডির কাজ শুরু করে এবং গত এপ্রিল,২০১১ তে পিডিবি’র কাছে জামা দেয়ার কথা। কিন্তু সেই রিপোর্ট এখন পর্যন্ত অপ্রকাশিতই রয়েছে এবং আমরা জানিনা পরিবেশ, সামাজিক , অর্থনৈতিক ফ্যাক্টরগুলো আদৌ কোন বিচার বিবেচনা হয়েছে কিনা চুক্তি করার আগে। বিষয়টি গুরুতর, কারণ প্রকল্পের স্থানটি মূলত কৃষিজমির উপরে, জনবসতিপূর্ণ এলাকায় এবং সবচেয়ে বড় কথা সুন্দরবনের মতো একটি সংরক্ষিত বনাঞ্চলের একেবারেই নিকটে- ৯ কিমি এর মধ্যে।
পরিবেশগত বিবেচনা কেন জরুরী:
সুন্দরবনের একেবারেই নিকটে, আবাসিক এলাকায় এবং কৃষিজমির উপরে ১৩২০ মেগাওয়াটের বিশাল কয়লা ভিত্তিক বিদুৎ কেন্দ্র নির্মাণের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করতে যাওয়াটা কি ভয়ংকর একটি কাজ সেটা অনুধাবন করতে গেলে প্রথমে বোঝা দরকার একটি কয়লা ভিত্তিক তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র পরিবেশের উপর কি কি প্রভাব ফেলে :
ক) বায়ু দূষণ: একটি ৫০০ মেগাওয়াটের বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে বছরে উৎপাদিত বায়দূষণ কারী উপাদানগুলো হলো-
১) ৩৭ লক্ষ টন কার্বন ডাই অক্সাইড যা প্রায় ১৬ কোটি গাছ কেটে ফেলার সমান।
২) ১০ হাজার টন সালফার ডাই অক্সাইড। এই সালাফার ডাই অক্সাইড এসিড রেইনের কারণ এবং অন্যান্য উপাদানের সাথে বাতাসে ক্ষুদ্র কণিকার পরিমাণ বাড়িয়ে তোলে যার ফলে ফুসফুস ও হার্টের রোগ সহ বিভিন্ন অসুখ বিসুখ হয়।
৩) ১০ হাজার ২০০ টন নাইট্রোজেন অক্সাইড। এই নাইট্রোজেন অক্সাইড ফুসফুসের টিস্যূ’র ক্ষতিকরে যার ফলে শ্বাসতন্ত্রের নানান রোগ হতে পারে।
৪) ৫০০ টন ক্ষুদ্র কণিকা যার ফলে ব্রংকাইটিস সহ ফুসফুসের বিভিন্ন রোগ বেড়ে যায়।
৫) ৭২০ টন বিষাক্ত কার্বন মনোক্সাইড।
৬) ১৭০ টন মারকারি বা পারদ। ২৫ একর আয়তনের একটা পুকুরে এক চা চামচের ৭০ ভাগের একভাগ পারদ পড়লে সেই পুকুরের মাছ বিষাক্ত হয়ে খাওয়ার অযোগ্য হয়ে পড়ে। পারদের কারণে ব্রেন ডেমেজ সহ স্নায়ু তন্ত্রের নানান রোগ হয়।
৭) ২২৫ পাউন্ড বিষাক্ত আর্সেনিক যার ফলে আর্সেনিকোসিস এবং ক্যানসারের বিস্তার ঘটায়।
৮) ১১৪ পাউন্ড সীসা, ৪ পাউন্ড ক্যাডমিয়াম এবং পরিবেশ ও মানব স্বাস্থের জন্য ক্ষতিকর অন্যান্য ভারী ধাতু।
খ)কঠিনও তরল বর্জ্য: কয়লা পুড়িয়ে ছাই তৈরী হয় এবং কয়লা ধোয়ার পর পানির সাথে মিশে তৈরী হয় আরেকটি বর্জ্য কোল স্লাজ বা স্লারি বা তরল কয়লা বর্জ্য। ছাই এবং স্লারি উভয় বর্জ্যই বিষাক্ত কারণ এতে বিষাক্ত আর্সেনিক, মার্কারি বা পারদ, ক্রোমিয়াম এমনকি তেজস্ক্রিয় ইউরোনিয়াম ও থোরিয়াম থাকে। ছাই বা ফ্লাই এশ কে বিদ্যুত কেন্দ্রের নিকটে অ্যাশ পন্ড বা ছাইয়ের পুকুরে গাদা করা হয় এবং স্লারি বা তরল বর্জ্য কে উপযুক্ত ট্রিটমেন্টের মাধ্যমে দূষণ মুক্ত করার চেষ্টা করা হয়। কিন্তু ছাই বাতাসে উড়ে গেলে, ছাই ধোয়া পানি চুইয়ে কিংবা তরল বর্জ্য বৃষ্টির পানিতে ধুয়ে মাটিতে বা নদীতে মিশলে ভয়াবহ পরিবেশ দূষণ ঘটে। একটি ৫০০ মেগাওয়াটের কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে বছরে ১ লক্ষ ২০ হাজার টন ছাই এবং ১ লক্ষ ৯৩ হাজার টন তরল কয়লা বর্জ্য বা স্লারি উৎপাদিত হয় যার উপযুক্ত ব্যাবস্থাপনা করা কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্রের একটি বড় সমস্যা।
গ)পানি দূষণ: কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্রের কঠিন ও তরল বর্জ্য বৃষ্টির পানিতে ধুয়ে, সংরক্ষণ আধার থেকে চুইয়ে নানান ভাবে গ্রাউন্ড ও সারফেস ওয়াটারের সাথে মিশে পানি দূষণ ঘটায় যার ফলে পানির মাছ, জলজ উদ্ভিদ ইত্যাদি হুমকির মুখে পড়ে।
ঘ)শব্দ দূষণ: কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্রের টারবাইন, কমপ্রেসার, পামপ, কুলিং টাওয়ার, কনস্ট্রাকশানের যন্ত্রপাতি, পরিবহনের যানবাহনের মাধ্যমে ব্যাপক শব্দ দূষণ ঘটে থাকে।
এসকল কারণেই আবাসিক এলাকা, কৃষিজমি এবং বনাঞ্চলের আশপাশে কয়লা ভিত্তিক তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ করার অনুমতি প্রদান করা হয় না।
বিপন্ন সুন্দরবন , বিপন্ন পরিবেশ :
পরিবেশ দূষণ, লবণাক্ততা, জলবায়ু পরিবর্তণ, বন কেটে ধবংস করা ইত্যাদি নানান কারণেই বাংলাদেশের প্রাকৃতিক ঐতিহ্য সুন্দরবন ধবংসের মুখে। প্রস্তাবিত কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি থেকে সুন্দর বনের দূরত্ব মাত্র ৯ কিমি। ফলে কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্রের মাধ্যমে বায়ু-পানি-কঠিন-তরল যত ধরণের দূষণ ঘটতে পারে তার সবটুকুই সরাসরি সুন্দরবনকে ক্ষতিগ্রস্থ করবে। পশুর নদী থেকে ১৩২০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্য প্রয়োজনীয় পানি ঘন্টায় প্রায় ২৪/২৫ হাজার ঘনমিটার হারে প্ল্যান্টে টেনে নিলে সেক্ষেত্রে নদীর উপর নির্ভরশীল জনগোষ্ঠীর সেচ কার্য কিভাবে চলবে সেটা একটা প্রশ্ন। বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে দূষিত পানি নদীতে মিশে পশুর নদীর পানি দূষিত করবে যার ফলাফল নদীর উপর নির্ভরশীল চাষী-জেলে থেকে শুরু করে সুন্দরবনের গাছপালা-জীবজন্তুর উপর গিয়ে পড়বে। এসকল কারণেই বিশ্বের বিভিন্ন দেশে সংরক্ষিত বনভূমি ও বসতির ১৫ থেকে ২০ কিমি এর মধ্যে কয়লা বিদ্যূৎ কেন্দ্র নির্মাণের অনুমোদন দেয়া হয় না। যে ভারতীয় এনটিপিসি বাংলাদেশের সুন্দরবন ধবংস করে এই বিদ্যূৎ কেন্দ্র নির্মাণ করতে চাইছে, সেই ভারতেরই ওয়াইল্ড লাইফ প্রটেকশান এক্ট ১৯৭২ অনুযায়ী, বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ১৫ কিমি ব্যাসার্ধের মধ্যে কোন বাঘ/হাতি সংরক্ষণ অঞ্চল, জৈব বৈচিত্রের জন্য গুরুত্বপূর্ণ বনাঞ্চল, জাতীয় উদ্যান, বন্য প্রাণীর অভায়ারণ্য কিংবা অন্য কোন ধরণের সংরক্ষিত বনাঞ্চল থাকা চলবে না। অথচ বাংলাদেশের সুন্দরবনের ৯ কিমি ব্যাসার্ধের মধ্যে বিশাল একটি বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ করতে দেয়া হচ্ছে কোন রকম পরিবেশ সমীক্ষা ছাড়াই!
কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্রের বর্জ্য ও পরিবেশ দূষণ- বড় পুকুরিয়ার চিত্র:
বাংলাদেশের একমাত্র কয়লা ভিত্তিক তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্র বড়পুকুরিয়ার ২৫০ মেগাওয়াট পাওয়ার প্ল্যান্ট। এই বিদ্যুৎ কেন্দ্রের পরিবেশ গত প্রভাব নিয়ে কোন সমীক্ষার কথা আমাদের জানা নেই। অথচ বিদ্যূৎ কেন্দ্র চালু হওয়ার পর থেকেই নানান ধরনের সমস্যা দেখা দিয়েছে। আশপাশের গ্রামবাসীর অভিযোগের শেষ নেই। মাঝেই মাঝেই তারা এসব সমস্যা সমাধানের দাবীতে কেন্দ্রটি ঘেরাও করছেন। একটি সমস্যা হলো পানি সমস্যা। বিদ্যুৎ কেন্দ্রের প্রয়োজনে ভুগর্ভস্থ পানি টেনে নেয়ার কারণে এলাকা বাসী চাষাবাদ ও দৈনন্দিন কাজে ব্যাবহারের পানি পাচ্ছেন না। গ্রামবাসীর অভিযোগ বিদ্যুৎ কেন্দ্র সংলগ্ন ১৪ টি পাম্পের কারণে দুধিপুর, তেলিপাড়া, ইছবপুরসহ আশপাশের গ্রামে পানির অভাব দেখা দিয়েছে। অগভীর নলকুপ থেকে পানি উঠছে না। আরেকটি সমস্যা হলো বিদ্যুৎ কেন্দ্রের কঠিন বর্জ্য ছাই ব্যাবস্থাপনা নিয়ে। ২৫০ মেগাওয়াটের এই কেন্দ্রটি চালু রাখতে প্রতিদিন কয়লা জ্বালাতে হয় ২ হাজার ৪০০ টন। এতে ছাই হয় প্রতিদিন ৩০০ মেট্রিকটন। একাধিক পুকুরে এই ছাই প্রতিদিন জমা হচ্ছে। সিমেন্ট কারখানার কাচা মাল হিসেবে এই ছাইয়ের একটা ব্যাবহার রয়েছে। কিন্তু ২০০৬ সাল থেকে ২০১০ সালের মে মাস পর্যন্ত হিসেবে চার বছরে মোটামুটি দুই লাখ ৬০ হাজার ৬১৩ টন আর্দ্র ছাই পুকুরে জমা করে রাখা হয়েছে। ইতিমধ্যেই এই ছাই পুকুরের চার ভাগের তিন ভাগের বেশি ছাইয়ে ভরাট হয়ে গিয়েছে।ফলে পুকুরের পানিও শুকিয়ে গেছে। এ অবস্থা অব্যাহত থাকলে পানি মিশ্রিত ছাই আর পুকুরে ফেলা সম্ভব হবে না। ফলে বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি বন্ধ হয়ে যাওয়ার আশংকা রয়েছে। সূত্র: উপজাত ছাই, অযাচিত সমস্যা
এতে গেল ছাই রাখা ও ব্যাবহারের সংকটের কথা। কিন্তু এই ছাই সঠিক ভাবে রাখা হচ্ছে কি-না, ছাই মিশ্রিত পানি চুইয়ে মাটির নীচে ও আশপাশের জলাভূমিতে কয়লা খনির বিষাক্ত ধাতব উপাদান কি পরিমাণ দূষণের সৃষ্টি করছে তার কোন খোজখবর কি কেউ করেছে? সূক্ষ ধাতব কণার কথা যদি বাদও দেই, বড় পুকুরিয়া কয়লা খনির আশপাশে গেলেই দেখা যায়, কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্রের নালা বেয়ে কয়লা ধোয়া কালো পানির স্রোত মিশে যাচ্ছে চারপাশের কৃষিজমিতে। ফলে আশপাশের কৃষিজমিগুলোর রং এখন নিকষ কালো!
এই যদি বড় পুকুরিয়ার মাত্র ২৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ কেন্দ্রের পরিবেশ দূষণের আংশিক চিত্র হয়, তাহলে ১৩২০ মেগাওয়াটের একটি কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্রের প্রভাব নিকটবর্তী সুন্দরবন ও আশপাশের জনবসতি ও কৃষি জমির উপর কি হতে পারে অনুমান করা শক্ত নয়। উল্লেখ করা যেতে পারে, ১৩২০ মেগাওয়াটের একটি কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্রে বছরে ৭০ লক্ষ টন কয়লা জ্বালানি হিসেবে ব্যাবহ্রত হলে ৩০ লক্ষ টন ছাই বর্জ্য উৎপাদিত হবে। এ বিপুল পরিমাণ ছাই উৎপাদিত হয় বলেই কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্রের পরিবেশ গত সমীক্ষার একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ থাকে এই ছাই ব্যাবস্থাপনা নিয়ে। ভারতের মধ্যপ্রদেশের সিংগ্রাউলি জেলার নিগ্রি গ্রামে ১৩২০ মেগাওয়াটের বিদ্যুৎ কেন্দ্রের পরিবেশগত সমীক্ষা রিপোর্ট আমাদের হাতে আছে। সেখান থেকে দেখা যায়, ছাই সমস্যা সমাধানের জন্য নিকটেই একটি সিমেন্ট কারখানা তৈরীর প্রস্তাব করা হয়েছে যাতে বার্ষিক ২০ লক্ষ্য টন সিমেন্ট উৎপাদিত হবে। বাংলাদেশের রামপালে প্রস্তাবিত কয়লা বিদ্যূৎ কেন্দ্রের বেলায় কি উৎপাদিত ছাইয়ের ব্যাবহার, পশুর নদী থেকে পানি টেনে নেয়ার ফলে আশপাশের গ্রামবাসীর সম্ভাব্য পানিসংকট কিংবা কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে বেরিয়ে আসা দূষিত পানি ব্যাবস্থাপনা ইত্যাদি বিষয় বিবেচনা করা হয়েছে?
অর্থনৈতিক বিবেচনা:
প্রস্তাবিত রামপাল কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি ভারত-বাংলাদেশ যৌথ বিনিয়োগে নির্মিত হওয়ার কথা বলা হলেও বাস্তবে এটি মূলত ভারতীয় মালিকানা ও ব্যাবস্থাপনায় একটি ভারতীয় বিদ্যুৎ কেন্দ্রই হবে, যে বিদূৎ কেন্দ্র থেকে সরকার বেসরকারি বিদ্যূৎ কেন্দ্র বা আইপিপি’র কাছ থেকে যেমন চড়া দামে বিদ্যুৎ কেনে সেভাবে কিনবে। পিডিবির চেয়ারম্যান জনাব আলমগীর হোসেন বলেন, এই অর্থের ২৫% এনটিপিসি ও পিডিবি সমান দুই ভাগে ভাগ করে অর্থাৎ প্রত্যেকে ১২.৫% করে বিনিয়োগ করবে। বাকি ৭৫% অর্থ এনটিপিসি বিভিন্ন ব্যাংক ও দাতা সংস্থার কাছ থেকে সংগ্রহ করবে। কাজেই দেখা যাচ্ছে বিদ্যুৎ কেন্দ্রটির ৮৭.৫% মালিকানাই থাকবে এনটিপিসি’র। আর এই মালিকানা এনটিপিসি’র বলেই বিদ্যুৎ কেন্দ্রটির ব্যাবস্থাপনা ও পরিচালনার কাজ সম্পূর্ণ ভাবে এনটিপিসি’র যদিও অযুহাত হিসেবে তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্র পরিচালনার উপযুক্ত দক্ষতা না থাকার অযুহাত দেয়া হচ্ছে। বিদ্যুৎ কেন্দ্র পরিচালনা ও দাম সম্পর্কে বিদুৎ সচিব আবুল কালাম আজাদ বলেন: এই বিদ্যূৎ কেন্দ্রটি দেশের বেসরকারি খাতের অন্যান্য বিদ্যুৎ কেন্দ্র গুলোর মতোই পরিচালিত হবে যেগুলো থেকে পিডিবি বিদ্যুৎ কিনে থাকে।৮
কিন্তু পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদ অনুসারে এমনকি বেসরকারি খাতের প্রস্তাবিত মূল্যের চেয়েও বেশি মুল্যে এই রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে বিদ্যুৎ কিনতে হবে বাংলাদেশকে। পিডিবি ও এনটিপিসি’র মধ্যে সমঝোতা অনুসারে যদি আমদানি করা কয়লার দাম প্রতি টন ১০৫ ডলার করে হলে প্রতি ইউনিট বিদ্যুৎ ৫ টাকা ৯০ পয়সা এবং প্রতি টন ১৪৫ ডলার করে হলে প্রতি ইউনিট বিদ্যুৎ ৮ টাকা ৮৫ পয়সা করে ক্রয় করবে বাংলাদেশ। পিডিবি’র কর্মকর্তার বরাত দিয়ে ডেইলি সান লিখেছে, এনটিপিসি এবং পিডিবি ইতিমধ্যেই প্রতি টন ১৪৫ ডলার করে কয়লা আমদানি চূড়ান্ত করে ফেলেছে, ফলে প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের দাম পড়বে ৮ টাকা ৮৫ পয়সা বা ভারতীয় ৫ দশমিক ২ রূপি।
অথচ গত ২০ ডিসেম্বর ওরিয়ন গ্রুপের সাথে পিডিবির চুক্তির সংবাদ থেকে দেখা যাচ্ছে কয়লাভত্তিকি কন্দ্রেগুলোর মধ্যে
মুন্সীগঞ্জের মাওয়ায় ৫২২ মেগাওয়াটের কয়লা বিদ্যুত কেন্দ্র থেকে প্রতি ইউনিট ৪ টাকা এবং খুলনার লবণচোরায় এবং চট্টগ্রামের আনোয়ারায় ২৮৩ মেগাওয়াট ক্ষমতার দুটি কেন্দ্র তিন টাকা ৮০ পয়সা দরে বিদ্যুৎ কিনবে পিডিবি।
ফলে বোঝা শক্ত নয়, বিদ্যুৎ সংকট নিরসনের নামে আরেকটি বিদেশী কোম্পানির কাছ থেকে বেশি দামে বিদ্যূৎ কেনার আয়োজ হচ্ছে।
একটি ১৩২০ মেগাওয়াটের কয়লা ভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র কেন্দ্র নির্মাণ পর্যায়ে ৪০০০ এবং পরিচালনা পর্যায়ে দক্ষ ও অদক্ষ শ্রমিক মিলিয়ে সর্বোচ্ছ ৬০০ মানুষের কর্মসংস্থান করতে পারে। অন্যদিকে প্রস্তাবিত কয়লা বিদ্যুৎ প্রকল্পের আওয়াত ১ম পর্যায়ের ১৩২০ মেগাওয়াট ক্ষমতার বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য ১,৮৩৪ একর জমি বেছে নেয়া হয়েছে যার বেশির ভাগই হলো কৃষি জমি। এই জমির মালিক ও কৃষিকাজের উপর বিভিন্ন ভাবে নির্ভরশীল ব্যাক্তিদের জীবন জীবিকার কি হবে? রামপাল কৃষিজমি রক্ষা সংগ্রাম পরিষদ শুরু থেকেই হাজার হাজার মানুষের জীবন জীবিকা ধবংস করে কৃষি জমির উপর এই বিদ্যুৎ নির্মাণ প্রকল্পের বিরোধী করে আসছে। তারা সংবাদ সন্মেলন করে বলেছেন : ” প্রস্তাবিত এই বিদ্যুৎ প্রকল্পের বিশাল এলাকার মধ্যে বসতবাড়ি, ধানী জমি, মৎস খামার, চিংড়ি চাষ প্রকল্প, সবজি ক্ষেত, গরু-মহিষ উৎপাদন খামার, দুগ্ধ খামার, মসজিদ মাদ্রাসা মক্তব কবরস্থান ও অন্যান্য ব্যাবসা প্রতিষ্ঠান রয়েছে। প্রতি মৌসুমে কয়েক কোটি টাকার মাছ, ধান, গরু-মহিষের মাংস এই এলাকা থেকেই উৎপাদন করা হয়। কৃষি জমি অধিগ্রহনের এই উদ্যোগের সাথে সাথে আমাদের রুটি-রুজির সংস্থান আর বাপ-দাদার ভিটে-মাটি সবই যেতে বসেছে। ... বিদ্যূৎ কেন্দ্র স্থাপিত হলে হয়তো কিছু লোকের কর্মসংস্থান হবে কিন্তু জমি অধিগ্রহণের ফলে কৃষি জমি ও কৃষি কাজের সাথে সম্পৃক্ত যে ব্যাপক সংখ্যক মানুষ কর্মহীন আর উদ্বাস্তু হয়ে পড়বে তাদের সবাইকে পুনর্বাসন করা আদৌ সম্ভব নয়। ক্ষতিপূরণ হিসেবে হয়তো কিছু টাকা মিলবে কিন্তু তা দিয়ে নতুন করে কৃষি জমি কেনাও দূরহ। এ অনিশ্চয়তা থেকে আমরা কৃষি জমি রক্ষা সংগ্রাম পরিষদ গঠন করেছি।”
ভারতের ছত্তিশগর কিংবা মধ্য প্রদেশের কয়েকটি বিদ্যুৎ কেন্দ্রের পরিবেশ সমীক্ষা রিপোর্ট আমাদের হাতে আছে যেগুলোর প্রত্যেকটিতে প্রথমেই হলফ করে নিশ্চিত করা হয়েছে যে প্রকল্পটি অকৃষি জমির উপর নির্মিত হতে যাচ্ছে, প্রকল্পের ১৫ কিমি এর মধ্যে কোন সংরক্ষিত বানাঞ্চল নেই ইত্যাদি। অথচ বাংলাদেশ সরকার একদিকে খাদ্য নিরাপত্তার কথা বলছে, খাদ্য নিরাপত্তার জন্য কৃষি জমিতে যে কোন ধরণের অকৃষি স্থাপনা নিষিদ্ধ করার আইন করার কথা বলছে, আফ্রিকার কৃষি জমি লিজ নিয়ে খাদ্য শস্যা ফলানোর কথা বলছে অন্যদিকে কৃষি জমি ধবংস করে উন্মুক্ত খনি কিংবা কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের বিদেশী প্রকল্পগুলোর অনুমোদন দিয়ে যাচ্ছে।
ডিজাস্টার ক্যাপিটালিজম বা সংকটের পুঁজিবাদ :
পুঁজিতন্ত্রিক অর্থনৈতিক ব্যাবস্থায় শাসক শ্রেণী ব্যাক্তি-গোষ্ঠীর মুনাফার প্রাধন্য নিশ্চিত করতে গিয়ে বৃহত্তর জনগোষ্ঠীকে নানান সংকটে ফেলে দেয় এবং পরে আবার সেই সংকট থেকে উদ্ধারের নামে মুনাফার প্রাধান্য দিয়ে আরো বড় সংকট ডেকে আনে। নাওমি ক্লেইন তার ডিসাস্টার ক্যাপিটালিজম এ বলেছেন: ”সামরিক ক্যু, সন্ত্রাসী আক্রমণ, বাজারের ধ্বস, যুদ্ধ, সুনামি, হারিকেন ইত্যাদি বিপর্যয় সমস্ত মানুষকে একটা কালেক্টিভ শক বা আঘাতের সম্মুখীন করে ফেলে। নিক্ষিপ্ত বোমা, সন্ত্রাসের আতংক কিংবা শো শো ঝড়ো হাওয়া সমগ্র সমাজকে কাদার মত নরম করে ফেলে- যেমন আঘাতের পর আঘাত নরম করে ফেলে কারবন্দী আসামীকে। আতংকিত বন্দী যেমন বিপর্যস্ত হয়ে নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে সহযাত্রী বন্ধুর নাম ফাঁস করে দেয়, বড় ধরণের বিপর্যয়ের মুখে আতংকিত সমাজও অনেক সময় এমন সব কাজের অনুমোদন দিয়ে ফেলে যেগুলো অন্যসময় হলো তীব্র প্রতিরোধের মুখে পড়তো।” বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সংকটকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশের মানুষকে এরকমই একটি কালেক্টিভ শক এর মধ্যে ঠেলে দেয়া হয়েছে যে শক বা আঘাতকে কাজে লাগিয়ে বিদ্যূৎ ও জ্বালানি সংকট নিরসনের নামে শাসক শ্রেণী দেশী বিদেশী লুটেরা পুজির মুনাফার আয়োজন করছে। ফুলবাড়ি-বড়পুকুরিয়ার উন্মুক্ত খনি, সাগরের গ্যাস ব্লক বিদেশী কোম্পানির কাছে ইজারা, কুইক রেন্টালের নামে ১৪ থেকে ১৭ টাকা দরে বিদ্যূৎ ক্রয় কিংবা হালের এই ভারতীয় বিনোয়োগে সুন্দরবন-কৃষিজমি ধবংস কারী রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র ইত্যাদি সবকিছুই এই মুনাফা ও লুটপাটের আয়োজনের অংশ। আমরা বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের বিরোধী নই কিন্তু বিদ্যুৎ সংকটের অযুহাতে জল-জমি-জঙ্গল-জীবন ও অর্থনীতি ধবংসকারী কোন প্রকল্প মেনে নিতে রাজী নই। আমরা মনে করি, কৃষিজমি, সুন্দরবনের মতো সংরক্ষিত বনভূমি কিংবা জীবন-অর্থনীতি ধবংস না করেও বড়-ছোট-মাঝারি নানান আকারের বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ করা সম্ভব যদি মুনাফার আগে জনস্বার্থকে প্রাধান্য দেয়া হয়। এই রামপাল বিদ্যুৎ প্রকল্পের বেলাতেও এলাকাবাসীর মতোই আমরা মনে করি পরিবেশ ও অর্থনৈতিক যেসব প্রশ্ন আমরা এখানে উত্থাপন করেছি এগুলোর পুঙ্খানুপুঙ্খ যাচাই বাছাইয়ের মাধ্যমেই এই বিদ্যুৎ প্রকল্পের ভবিষ্যত নির্ধারণ করতে হবে।