সেলিম এখন এলিফ্যান্ট রোডের একটা বাসার সামনে। প্রচন্ড গরম, তবুও তার গায়ে কালো রংয়ের উপর কবিতা লেখা একটা চাদর। ঠিক কী কারনে সে এই গরমের মধ্যেও চাদর গায়ে দিয়ে বেড়িয়ে ছিল তা সে মনে করতে পারে না। হয়ত দীর্ঘদিনের অভ্যাসবশতঃ পরে ফেলেছিল। তাছাড়া গায়ের উপর একটা চাদর জড়িয়ে তার এক পাশ দিয়ে একটা হাত বের করে সেই হাতে জ্বলন্ত সিগারেট ধরে রেখে পা টিপে টিপে রাস্তা দিয়ে হাটার মধ্যে আলাদা ভাব আছে। এই ভাব ধরার সুখ টা গরমের ফলে প্রাপ্ত কষ্টের সমানুপাতিক। তাই এইটুকু গরমের কষ্ট সহ্য করা যায়। তাছাড়া লেখক-শিল্পীদের একটু ভাব না রাখলে আসলেই চলে না। রবীন্দ্রনাথ তার লম্বা দাড়ি নিশ্চই শেভ করার পয়সা বাচানোর জন্য রাখেন নি।
তবে আজকের ব্যাপার ভিন্ন। এমনিতেই আজকে গরম টা একটু বেশি, তাই চাদরের নিচে পরা সেলিমের পাঞ্জাবীটা (এটাও কবিতা সমৃদ্ধ) ঘেমে তার গায়ের সাথে পলিথিনের মত লেগে আছে। রুপা এসে এরকম দেখলে খুব রাগ করবে, খুবই রাগ করবে।
এলিফ্যান্ট রোডের বাসাটায় সেলিম মূলত এসেছিল কিছু টাকা জোগাড় করতে। তার এক দুঃসম্পর্কের চাচী থাকেন এখানে। এই চাচীর বড় মেয়েকে ইন্টারমিডিয়েট এর সময় সেলিমই ইংলিশ পড়িয়েছে। তবে তার পড়ানোতে খুব একটা লাভ হয় নি। ইংলিশে মাত্র ৬৩ পেয়ে সেই মেয়ে ইন্টার পাশ করে। মেয়েটার নাম ছিল শিলা। ওকে নিয়ে সেলিমের লেখা একটা কবিতা সাহিত্য সৌরভে ছাপা হয়েছিল প্রায় ৭ মাস আগে। আশ্চর্য ব্যাপার! নামের শেষে "আ" যুক্ত মেয়েদের সাথেই সেলিমের প্রেম হয়। শিলা, আরিফা, শান্তা, তনিমা, রুপা...এইসব ভাবতে ভাবতে সেলিম এলিফ্যান্ট রোডের বাসা থেকে বের হয়। টাকা পাওয়া যায় নি, তবে তাতে সেলিমকে খুব বিচলিত মনে হচ্ছে না। কে জানে, হয়তো সে আগেই জানতো টাকা পাওয়া যাবে না, কিংবা হয়তো শিল্পি সাহিত্যকরা এমনই হয়। অর্থের মতো "সেকুলার" বিষয় তাদের কে তেমন নাড়া দেয় না হয়তো।
কিন্তু আজকের ব্যাপার টা নাড়া দেওয়ার মতই। আজকে এই টাকা গুলো আসলেই দরকার। সেলিম মোবাইলটা বের করে রুপা কে কল করার জন্য, কিন্তু মোবাইলটা চার্জের অভাবে মরে গেছে অনেক আগেই। বাধ্য হয়ে সেলিম কে একটা "এখানে মোবাইল করা যায়" দোকানের দিকে পা বাড়াতে হল।
ফোন ধরেই বোঝা গেল কোন সমস্যা আছে। রুপার গলা কেমন ভারী ভারী লাগছে। বোঝাই যাচ্ছে সে এতক্ষন কাঁদছিল।
সেলিম: এ্যই তুমি আসছো তো?
রুপা: ....
সেলিম: কি হল?
রুপা: তুমি টাকা জোগাড় করতে পেরেছ?
সেলিম: ...হ্যা...কিন্তু...তুমি...
রুপা: আচ্ছা শোন, এবোশন করিয়ে ফেলেল কেমন হয়? না মানে, একবার ভেবে দেখ...
সেলিম: কি বলছ এইসব? আমি তো বলেছিই বাচ্চা পালার মত ক্ষমতা আমার আছে, কি ভাব তুমি আমাকে?
রুপা: না, একবার ভেবে দেখো না? এখন...
সেলিম: আচ্ছা তুমি আসছো কখন সেটা বল
রুপা: মমম...তুমি...৫ টার দিকে থেকো, আমি আসবো
সেলিম: আচ্ছা আমি ঠিক পাঁচটায় ই থাকবো, দেরি হয় না যাতে, রাখি...
রুপা: টাকা জোগাড় হয়েছে তো? আমার কাছে জমানো টাকা গুলো আছে...
সেলিম: হুম, বললাম তো ঐটা কোন প্রবলেম না...তুমি চলে এস, আর শোন, আমার গায়ে যেহেতু সাদা পাঞ্জাবী, তুমি কিন্তু একটা সাদা শাড়ী পরে আসবা।
রুপা: কি? সাদা শাড়ী
সেলিম: হ্যা, সমস্যা কি? আমাদের টা একটু ভিন্ন হবে...
বিকাল পাঁচটা বাইশ মিনিটের সময় সেলিম কে হাজিপারায় একটা ছোট দোতলা বাসার নিচে দেখা গেল। বাসার গেটের মধ্যে কালো সাইন বোর্ডে সাদা রং দিয়ে "অত্র এলাকার নির্ধারিত কাজী অফিস" লেখা ঝুলছে।
সন্ধ্যা ৭ টা ২৩ মিনিট পর্যন্ত সেলিম কে ঐ বাসাটার সামনেই ঘোরাঘুরি করতে দেখা গেল। এর মধ্যে দুইবার সে মোরের চায়ের দোকানে গিয়ে একদিনের বাসী গোল বণ রুটি আর চা খেয়ে আসল। চা খাওয়ার সময় তার চোখ বার বার "অত্র এলাকার নির্ধারিত কাজী অফিস" সাইনবোর্ড ঝোলানো বাসাটার দিকে যাচ্ছিল।
দ্বিতীয় দফা চা ও বণরুটি খাওয়া পর্ব শেষ করে সে প্রায় পৌনে এক ঘন্টা ঐ দোতলা বাসাটার সামনে বসে থাকল। এর মধ্যে একবার সে তার অনাগত সন্তানটির কথা ভাবল। সে কি ছেলে হবে না মেয়ে? সেলিমের শখ সে মেয়ে হবে। এ ব্যাপারে অবশ্য রুপার সাথে কথা বলার সুযোগ হয় নি। কারন রুপা অন্তঃসত্বা হওয়ার রিপোর্ট আসার পর মাত্র দুইবারই তার সাথে দেখা হয়েছে। সেই সময় এই ধরনের রোমান্টিক আলাপ করার মত মেজাজ ওদের ছিল না।
আচ্ছা...শিলা কি শেষ পর্যন্ত তার বাচ্চাটিকে নষ্ট করতে পেরেছিল? নিশ্চই পেরেছে, নইলে চাচীর বাসায় আজকে ঢোকাই যেত না, আর চাচীও নিশ্চই ভদ্রতা করে পায়েশ খাওয়াতেন না, আজকে যেমন খাইয়েছেন। আচ্ছা, সেই বাচ্চাটা কি ছেলে হত না মেয়ে হত? কে জানে...
কেন যেন সেলিমের চোখ ভিজে উঠে। সে একটা অশ্বস্তি নিয়ে গায়ের চাদর টা খুলে হাতে নেয়।
রাত ৭ টা ২৩। রুপা একটা হাসপাতালের ওয়েটিং রুমের ভিতরে বসে আছে। তার পাশে বোরখা পরা এক বৃদ্ধা পান চিবুচ্ছেন এবং সঙ্গে থাকা তার নাতনীর সাথে কথা বলছেন। বৃদ্ধার নাতনীটির বয়স বেশি না, ৪-৫ হবে, কিন্তু সে বড়দের মত করে খুব গম্ভির ভাবে বৃদ্ধার সঙ্গে কথা বলছে, যেন সে দেশের চলমান রাজনৈতিক সংকট কিভাবে মোকাবেলা করা যায় সে বিষয়ে সিরিয়াস আলাপ করছে। রুপার চোখেও কেন যেন পানি চলে আসলো। এই সময় একজন নার্স এসে রুপা কে জিজ্ঞেস করল, "আপনিই কি নার্গিস আক্তার?" রুপা কি হ্যা বলবে কিনা ভেবে পেল না।
(সমাপ্ত)
সর্বশেষ এডিট : ৩০ শে এপ্রিল, ২০০৮ রাত ৩:২৮