আগুনের কথা বন্ধুকে বলি , দু’হাতে আগুন তারও
কার মালা হতে খসে পরা ফুল রক্তের চেয়ে গাঢ়
যার হাতখানি পুড়ে গেল বধূ আচলে তাঁহারে বাধ,
আজও ডানা ভাঙ্গা একটি শালিক হৃদয়ের দাবী রাখো।
সঞ্জীব চৌধুরী সংবেদনশীল অবয়বে বোহেমিয়ান, প্রথা বিরোধী প্রকৃতিদত্ত কবি প্রতিভা এবং ভেতরে ভেতরে এক ডানা ভাঙ্গা শালিক ! নিজস্বতায় ঋদ্ধ নাগরিক সুরে নৈঃসঙ্গ্য, যন্ত্রণা, প্রেম,দ্রোহ আর বিচ্ছিন্নতাবোধের কঙ্কালতা ছিলো তার প্রতিটা গান। সুর সংক্রামক এবং বিষাদী, ফিকে বাতাসের মত উড়ে বেড়ায় আশে পাশে ! আমরা ধরি সেই সুর হাওয়া থেকে , বিষাদিত হই,ঘাই মারে বুকে । সেকো বিষের মত আমাদের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ঢুকে যায় আর চোখের জলের উপর ছায়া ফেলে গানের ভেতরকার অনুভব , অন্তর্গত ব্যাকালাপ গেথে যায় এক পদ্মফুল যার বয়ান দেয় এইভাবে-
“আমার চোখে রাত, তোমার চোখে আলো !” অথবা “পূর্ব বুঝিনা, পশ্চিমও না ,সীমানা একেছে কে ? এইসব সীমানা আঁকে কে ?” তার গানের ভিতর , সুরের ভিতর টুকরো টুকরো উল্লাস চিৎকার করে মুদ্রিত করে যেন নৈঃশব্দ্যের নৈর্ব্যক্তিক উপস্থিতি !
এই পঁচা-গলা পোষাকী সিস্টেম এবং শ্রেণী বৈষম্যের সমাজের বিপরীতে সন্জীব চৌধুরী দাঁড়িয়ে ছিলেন একরোখা তেজী বাইসনের মত , স্বপ্ন দেখেছিলেন সাম্যবাদী সমাজের , পা বাড়িয়েছিলেন আলোকিত পথে , নিরন্নের অন্ন, বেঁচে থাকার কথা বলার জন্য রাজপথে ছিলেন বামরাজনীতির হাত ধরে। মানুষের প্রতি ভালোবাসাই ছিলো রাজনীতির উৎস মুখ। তার লেখা কবিতা, গানেও প্রতিফলিত হয়েছে জীবনমুখী চেতনা , ঘোষণা দিয়েছিলন দৃঢ় চিত্তে ,স্ফুলিঙের মত স্বপ্নের কথা, শান্তির কথা:
একজন কর্নেল তাহের-পৃথিবীর সমান বয়সি স্বপ্ন নিয়ে আলিঙ্গন করেন ফাসির রজ্জু, পৃথিবীতে শান্তি রক্ষিত হোক, আকাশে শান্তি বাতাসে শান্তি, বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকারীকে ধরীয়ে দিন’
অথবা
তবুও আমি ঘুরিয়া ঘুরিয়া সন্ধান করিয়া/স্বপ্নেরই কথা বলতে চাই/আমার স্বপ্নের ই কথা বলতে চাই/আমার অন্তরের কথা বলতে চাই
০২
ইংরেজীতে একটা শব্দগুচ্ছ আছে জানি ‘ফেলো-ডি-সি’। যদ্দুর জানি সেই হল ফেলো-ডি-সি’ যে নিজেকে পোড়াতে ভালোবাসে । সন্জীব ছিলেন আত্মবিধ্বংসী বোহেমিয়ান । তার ব্যক্তিগত বিষন্নতা, বোহেমিয়ান স্বত্তা সূর্যগ্রহণের মত গ্রাস করেছিলো তার গানকে ; একজন বোহেমিয়ান ,প্রকৃত নিঃসঙ্গ মানুষের ব্যবচ্ছেদ করেছেন তার গানে যেন মর্গের দমবন্ধ ঘরে ; কেঁদে ঊঠেছেন এইভাবে “ঘরে ফিরবো না, ঘরে ফেরার কিছু নেই ,রাখবো না ধরে যে আর ধরে রাখার কিছু নেই” ; “কালা পাখি শোন তোর চোখ কান কিছু নেই , মনের ভিতর মাঝি তোর রাঙা নাও বাই; “গল্প ভাঙ্গে তবু গল্প জমে, এই চোখে রাত্রি নিঝুম ;একলা এ ঘর একলা প্রহর, থমকে দাঁড়ায় ! এই বোহেমিয়ান জীবনের ভিতরে ভ্রমণে একাকী ড্রাগনের শ্বাসে পুড়ে যায় সঞ্জীবের চোখ, তিনি গেয়ে উঠেন :
চোখটা এত পোড়ায় কেন ও পোড়া চোখ সমুদ্রে যাও…সমুদ্র কি তোমার ছেলে, আদর দিয়ে চোখ নামাও!
যেন সঞ্জীব নিঃস্ব রাজসন্তান! বুক ভাঙ্গা রোদ্দুরের বুকে শূণ্যতার শীষ বাজিয়ে গেয়ে গেছেন মানুষের আজন্ম দহনের কথা ! গেয়েছেন:
ওই কান্না ভেজা আকাশ আমার ভালো লাগে না
থমকে থাকা বাতাস আমার ভালো লাগে না
তুড়ির তালে নাচতে থাকা ভালো লাগে না
এই মরে মরে বেঁচে থাকা আমার ভালো লাগে না..
০৩
তার গান শুধু গানই ছিল না, যেন এক একটা কবিতা! কবিতাগুলোকে তিনি নিপুন মায়েস্ত্রের মত গানে কনভার্ট করতেন! ।দেশের অনেক পত্রিকায়ই তার কবিতা ছাপা হয়েছে। ‘রাশপ্রিন্ট’ তার একমাত্র কাব্যগ্রন্থের নাম । তার একমাত্র একক এলবাম স্বপ্নবাজী.. তিনি বিখ্যাত সাংবাদিক ছিলেন এবং আজকের কাগজ, ভোরের কাগজ এবং যায়যায়দিনে কাজ করতেন….৯০ দশকের স্বৈরাচার এরশাদবিরোধী আন্দোলনেও সক্রিয়ভাবে অংশ নেন।
সঞ্জীব দেখিয়ে গিয়েছিলেন জীবনে কত বঞ্চনা, যা কেউ দেখাতে পারেনি, এর আগে গানের ভিতর । শ্রেনী বৈষম্য আর রাষ্ট্রের তথাকথিত উন্নয়নের ভিতর যে বঞ্চনা তা বলেছেন তীব্র ক্রোধে, করুণ ব্যাঙ্গাত্মক সুরে এই ভাবে
“ রেডিওতে খবর দিছে দেশে কোন অভাব নাই, নাইলার ঘরে, কাইলার ঘরে আনন্দের আর সীমা নাই, চেয়ারম্যানের সাবে বগল বাজায়, আমরা কিচ্ছু দেখছি না! অথবা “আসতিছে পরিবর্তনের হাওয়া…এদিকে তহবিল জমে, ওইদিকে চোখের পানি!”
সঞ্জীব সময় এবং জীবনকে দেখেছেন গভীরভাবে, আপন খেয়ালে , বেঁধেছেন গান , তুলেছেন সুর ! আমরা সেখানে খুজে পেয়েছি বিষণ্ণ ম্যান্ডোলিন ! সঞ্জীব গেয়েছেন,
“পাগল রাগ করে চলে যাবে ফিরেও পাবে না ,পাগল কষ্ট চেপে চলে যাবে ফিরেও আসবেনা”।
কাকে বলছেন ফিরে আসব না, জীবনকে ? যাবেন কোথায়? মৃত্যুর দিকে ? এ ধরনের লাইনের মুখোমুখি হয়ে অসহায় পড়ি আমরা , বিমূঢ় হয়ে পড়ে সমস্ত বোধ, বাতাসে কান্না লুকাই আর ব্যক্তিগত গল্পঘরে জেগে থাকি ভয় নিয়ে চলে যাওয়ার, সকল নশ্বরতার আড়ালে!
উনি গেয়েছিলেন শুদ্ধতম ভালবাসার গান:
“আমাকে অন্ধ করে দিয়েছিল চাঁদ /আমাকে নিঃস্ব করে দিয়েছিল চাঁদ/আমার চোখ গেল ধরেছে সুন্দর/মেয়ে তুমি এভাবে তাকালে কেন/এমন মেয়ে কি করে বানালে ঈশ্বর?/বুঝি না এমন মেয়ে কি করে বানালে ঈশ্বর?”
এরকম গান শোনার পর একধরনের নি:স্ব বোধ অনুভূত হয় , সুন্দর ,ঈশ্বর এবং চাঁদের মত মেয়ে লিখে দেয় প্রগাঢ় বিষাদ !
০৪
এক পলকেই চলে গেল
আহ্ কি যে তার মুখখানা!
রিক্সা কেন আস্তে চলে না!
বাতাস লেগে ঊড়ছে যে চুল,
ঊড়ছে আচল, সাদা সাদা ফুল!
রিক্সায় দ্রুত চলে গেলে,
কেন আমার হলে না !
রিক্সা কেন আস্তে চলে না ?
কত সহজ , অথচ তীব্রভাবে বলে দিয়েছেন এক পলকেই চলে গেল, রিক্সা কেন আস্তে চলে না। আদ্যোপান্ত যেন প্রেমময় আকুতি কোন গলির মোড়ের দাঁড়িয়ে থাকা নিরীহ কিশোরের ! সত্যি কি তাই ? সঞ্জীব কি এমন ই বলতে চেয়েছিলেন ? নাকি প্রেম এবং জীবনকে একই সূতায় মালা গেথেছেন সাদা সাদা ফুলে! আসলে এতসব প্রেম আর মায়ার আড়ালে একটি ধ্রুব সত্য ছুড়ে দিয়েছেন আমাদের দিকে সঞ্জীব “ সহসাই জীবন ফুরিয়ে যায়” হাহাকারের জ্যামিতিতে, জাদুকরী গায়কীতে। গানে।
তার গানের কাছে গেলে মনে হয়-কে না ভালোবাসা এবং জীবনের কাঙাল। সঞ্জীবের গানে মানুষের প্রতি, জীবনের প্রতি, প্রেম-দ্রোহের প্রতি ভালোবাসা ভাবলেশহীন! এইসব হৃদয়গ্রাহী গান সঞ্জীবের আত্মার ডায়েরী থেকে বাংলার হাওয়া , মাঠে , সবুজে , মানুষের মাঝে মিশতে চাওয়া , মিশেও যেতে পেরেছেন মানুষের হৃদয় দরজায় তীব্রভাবে, তার সুরের প্রতিমা তাই সবসময় নৃত্যময় , জ্বাজ্জল্যমান ! সঞ্জীব তাই থাকবেন সবসময় কিংবদন্তী হয়ে,তার লিরিক আর কবিতা জ্বলে রবে অবিনাশী নক্ষত্রের মত !
০৫
যখন সন্জীব গেয়েছেন;
দোল ভাটিয়ালী
এ নদী রুপালী
ঢেউ এর তালেই
নৌকা বাজাও’!
তখন আমরা দেখি জীবন নৌকার মাঝির ভাটিয়ালী গাইতে গাইতে ভ্রমণ সুরের মানচিত্রে , একে যায় স্মৃতির ক্যালিওগ্রাফ বোধিবৃক্ষের নিচে !
“খোলা আকাশ, একটি গাছ
সবুজ পাতা, একটি গাছ
স্মৃতির বৃক্ষ, পাতারা জানে নিজের চাষ-বাস।
কত যে কথা, এইটুকু গাছ
কত যে কান্না, এইটুকু গাছ
একটা সময়ের কিছু চিহ্ন
দাগ কেটে যায়, কোথায় যেন !”
সময়ের ডাইনোসরের পিঠে চড়ে জীবনের এত সব বিচিত্র ভ্রমণের কথা সন্জীব ই শিখিয়েছিলেন আমাদের তার গানের মাধ্যমে । এইতো সারি সারি কান্না , কথা উড়ে যায় সমুদ্রের দিকে, প্রিয় মানুষের চোখের দিকে , তাই উনি গেয়ে উঠেছিলেন-
” আমার মনেতে নাই সুখ, তাই চোখের মাঝে বসত করে অন্য লোকের চোখ”!
অথবা
আমি তোমাকেই বলে দেব/কী যে একা দীর্ঘ রাত/আমি হেটে গেছি বিরান পথে/আমি তোমাকেই বলে দেব/সেই ভুলে ভরা গল্প/কড়া নেড়ে গেছি ভুল দরোজায়/ছুয়ে কান্নার রঙ ছুয়ে জোছনার ছায়া !
চাপ চাপ কষ্ট, ফালি ফালি বেদনা গানের ভিতর, দীর্ঘ রাতের বুকের প্রান্তে আমাদের ফেলে দিয়ে সন্জীব হেটে যায় বিরান পথে, কবির হাজার বছরের পথে! তিনি গানের মধ্যে বলে যান সম্পর্কের অভিজ্ঞানের ভুল ইতিহাসে, কান্নার রং আর জোছনার ছায়ার ভিতর দীর্ঘশ্বাসের শব্দ শোনা যায়!
হাতের উপর হাতের পরশ র’বে না
আমার বন্ধু, আমার বন্ধু হবে না, হবে না
হাতের উপর হাতের পরশ রবে না
হাতের উপর হাতের পরশ রবে না
শিশির ঝরবে সকাল বেলা
আমাকে তুমি করবে হেলা
আমাকে ভালোবাসবে ঠিকই কিন্তু আমার হবে না
হাতের উপর হাতের পরশ র’বে না, হাতের উপর হাতের পরশ র’বে না! কত অবলীলায় কত সহজে পৃথিবীর দুরহতম দুঃখগাথা গেয়েছিলো সন্জীব চৌধুরী ! পোড়া চোখ জুড়ে কার , কার জন্য গোপন দীর্ঘশ্বাস! শিশির ভেজা সকাল বেলা, রাখালের বাঁশি, সোনালী ডানার চিল , প্রেম, মায়া সব কোথায় যায়! যখন ইথারে ভেসে আসে হাতের উপর হাতের পরশ রবে না , তখনি সন্জীব চৌধুরী নামক হলুদ পাখি গান গাইতে থাকে আমাদের বুকের ভিতর , নিরবিচ্ছিন ভাবে!