গতকাল ভার্সিটির ক্লাবে বসেছিলাম; এক ভাই ফেসবুক থেকে কিছু ছবি দেখিয়ে বললেন এগুলো কি ইসলামে আছে । বলছিলাম নাই । ছবিটা ছিল তাজিয়া মিছিল উপলক্ষে দাঁড়ালো অস্র দিয়ে পিঠে আঘাত এবং রক্তাক্ত দৃশ্য... ইত্যাদি । বলে এসেছিলাম; যে চুরি করল সেই আবার চুরি যাওয়া মালের জন্য কান্না করা ঘটনা এইটা ।
আগামীকাল ১০-ই মুহারম এই উপলক্ষে উপ মহাদেশের অধিকাংশ মসজিদ্গুলোতে মিলাদ মাহফিলের আয়োজনের মাধ্যমে একটা মুখরোচক ( সাহিত্যিক tragic অলংকরণে) গল্প শোনানো হবে । অ্যারিস্টটল তাঁর পোয়েটিক্স গ্রন্থ cathersis এর যে বৈশিষ্ট্য দিয়েছিল তা এই গল্পে অক্ষরে পালন করে পাঠকের কিংবা শ্রোতাদের মনে ভয় এবং শেষে নায়কের জন্য করুণা করে বিলাপের প্লট অধিকাংশ জলসাগুলোতে বলা হয়ে থাকে ।
বাংলা সাহিত্যের অনবদ্য সৃষ্টি “বিষাদ সিন্ধু” এই গল্পের পিছনে আর একটু আঠা লাগিয়ে উপমহাদেশের অধিকাংশ মানুষের মনে একটা মনগড়া কাহিনীকে ধর্মের অঘোষিত অংশ হিসেবে ল্যাপ্টে দেওয়া হচ্ছে; এখন সত্যটা বলতে গিয়ে কেবলই নিজের জান এর উপর রিস্ক নেওয়া বলা চলে । কিন্তু মুসলিমের কর্তব্য সত্যের দাওয়াত পৌঁছে দেওয়া ।
সেই উপলক্ষেই কারবালায় আসলে কি ঘটেছিল এবং ১০ ই মহারম ইসলামে কেন এতো গুরুত্বপূর্ণ তা জানাতে আমরা ইসলামের ইতিহাস বিষয়ক শ্রেষ্ঠ কিতাব সমূহ থেকে এবং হাদিস থেকে বর্ণ্নার চেষ্টা রাখব ।
আমরা যা জেনে এসেছি
১) কিছু মানুষের গল্পে মুসলিম বিন আকিল এবং তাঁর পাঁচ ও সাত বছরের দুই ছেলের বর্ণনা দেওয়া হয় । তাতে বলা হয় তাদের বাবার মৃত্যুর পর তাদের মৃত্যুর ভয়ে তারা মদিনায় পালিয়ে যেতে চাচ্ছিল কিন্তু কুফার governor তাদের আটক করে হত্যা ( সে হৃদয় বিধারক কাহিনী শোনে ছোট বেলায় অনেক চোখের জ্বল ফেলেছি) করে ।
২) ইমাম হুসাইন (রাঃ) তাঁর সন্তান আসগর কে নিয়ে শত্রুদের কাছে পানি ভিক্ষা চায় এবং তারা আলী আসগরের বুকে তীর বিদ্ধ করে শহীদ করে
৩) গাছ কান্না করে রক্ত ঝরেছিল
৪) মাটি কাটলে রক্ত বের হত
৫) রক্তের বৃষ্টি হয়েছিল
তাবারী, ইবন খালদুন, উস আল গাবাহ, ইবন আসির, তারিখ আল খুলাফা বা তারিখ ইবন কাসির কোন বইয়ে এই সকল বর্ণ্নাগুলোর একটিও নেই ।
প্রচলিত গল্প, তাঁর নায়ক, ভিলেন সম্পর্কে আপনারা অনেক কিছু জানেন তাই সেই কাহিনী নতুন করে না বলে আসলে কি ঘটেছিল তা জানানো যাক ।
কি ঘটেছিল
৬০ হিজরির ঘটনা । ইয়াজিদ বিন মুয়াবিয়াকে খলিফা নিযুক্ত করেন তাঁর বাবা মু’আবিয়া (রাঃ)। কিন্তু বিষয়টি ইসলামী খিলাফত পদ্ধতির চেয়ে রাজতান্ত্রিক ধারণার সাথে বেশি সাদৃশ্যপূর্ণ ছিল । তাই তাঁর হাতে বাইয়াত করেন নি হুসাইন (রাঃ)। ইরাকের লোকেরা খবর পেয়ে তাঁকে চিঠি লিখে এবং দূত পাঠিয়ে জানালো তারা তাঁকে খলিফা হিসেবে চায়। খবর পেয়ে হুসাইন (রাঃ) তাঁর চাচাতো ভাই মুসলিম বিন আকিলকে কুফায় পাঠায় পরিস্থিতি পর্যবেক্ষনের জন্য । মুসলিম দেখলেন আসলেই অনেক মানুষ হুসাইন (রাঃ) কে খলিফা খলিফা হিসেবে দেখতে চায় । এবং কিছু অতি উৎসাহী লোক হানী বিন উরওয়াড় ঘরে মুসলিমের হাতে হুসাইনের (রাঃ) পক্ষে বাইয়াত গ্রহণ করে । ইয়াজিদের কাছে এই খবর পৌঁছালে তিনি বিদ্রোহ দমন করতে বসরার governor উবাইদুল্লাহ বিন যিয়াদকে পাঠান ।
উবাইদুল্লাহ কুফায় গিয়ে দেখে ঘটনা সত্যি । মুসলিম বিন আকীল চার হাজার সমর্থক নিয়ে যিয়াদের প্রাসাদ ঘেরাও করেন, এ সময় যিয়াদ মানুষকে ইয়াজিদের ভয় দেখালো এবং কুফাবাসী ইয়াজিদের শাস্তির ভয়ে আস্তে আস্তে সরে পড়ল এবং সূর্য অস্ত যাওয়ার পর মুসলিম বিন আকীল দেখলেন তথাকথিত হুসাইন (রাঃ) সমর্থকদের কেউ আর আশেপাশে নেই । মুসলিমকে গ্রেফতার করে হত্যা আদেশ দিলেন উবাইদুল্লাহ । মুসলিম মৃত্যুর আগে হুসাইন (রাঃ) কাছে একটী চিঠি পাঠান
হুসাইন ! পরিবার পরিজন নিয়ে ফেরত যাও । কুফাবাসিদের ধোকায় পোড়ো না । কেননা, তারা তোমার সাথে মিথ্যা বলেছে । আমার সাথেও তারা সত্য বলে নি ।
এদিকে মুসলিম বিন আকিলের আগের চিঠির উপর ভিত্তি করে তিনি মক্কা থেকে কুফার উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন । অনেক সাহাবী তাঁকে নিষেধ করেছিলেন ।
যাত্রা পথে হুসাইনের কাছে মুসলিমের কাছে সেই চিঠী এসে পৌঁছালে, তিনি কুফার পথ পরিহার করে ইয়াজিদের কাছে যাওয়ার জন্য সিরিয়ার পথে অগ্রসর হতে থাকেন । পথিমধ্যে ইয়াজিদের সৈন্যরা আমর বিন সাদ, সীমার বিন যুল জাওশান এবং হুসাইন বিন তামীমের নেতৃত্বে কারবালার প্রান্তরে হুসাইনের (রাঃ) গতিবেগ রোধ করল । তিনি আগত সৈন্যদলকে আল্লাহ্র দোহাই এবং নিজের মর্যাদার কথা উল্লেখ করে তিনটি প্রস্তাব দেন-
ক) তাঁকে ইয়াজিদের দরবারে যেতে দেয়া হোক । তিনি সেখানে গিয়ে ইয়াজিদের হাতে বায়াত গ্রহন করবেন । তিনি জানতেন যে ইয়াজিদ তাকে হত্য করতে চায় না ।
খ) অথবা তাঁকে মদিনায় ফেরত যেতে দেওয়া হোক ।
গ) অথবা তাঁকে কোনো ইসলামী অঞ্চলের সীমান্তের দিকে চলে যেতে দেয়া হোক । সেখানে তিনি জহাদ করবেন এবং ইসলামী রাজ্যের সীমানা পাহারা দিবেন ।
ইয়াজিদের সৈন্যরা উবাইদুল্লাহ বিন যিয়াদের ফায়সালা ছাড়া কোন কিছু মানতে রাজি হল না । তারা যুদ্ধ বেছে নিল ।
হুসাইন (রাঃ) সাথে ছিলেন-
১) আলী ইবনে আবু তালিবের (রাঃ) ছেলেরা- আবু বকর, মুহাম্মাদ, উসমান, জাফর এবং আব্বাস ।
২) হুসাইন (রাঃ) এর নিজের সন্তানেরা- আবু বকর, উমর, উসমান, আব্দুল্লাহ...
৩) হাসান (রাঃ) এর ছেলেদের মধ্যে থেকে- আবু বকর, উমর, আব্দুল্লাহ এবং কাসেম
৪) আকিলের সন্তান- জাফর, আব্দুর রাহমান এবং আব্দুল্লাহ বিন মুসলিম বিন আকিল
৫) আব্দুল্লাহ বিন জাফরের সন্তান্দের মধ্য থেকে-আউন এবং আব্দুল্লাহ ।
সাহাবা এবং তাবেঈদের এই ছোট্ট দলটি সবাই বীরত্বের সাথে যুদ্ধ করে শহীদ হন । অবশেষে হুসাইন (রাঃ) ছাড়া আর কেউ জীবিত রইলেন না । সীমার বিন যুল জাওশান নামের এক নরপশুর বর্শার আঘাতে ধরাশয়ী হলে ইয়াজিদ বাহিনীর সম্মিলিত আক্রমণে এই নির্ভীক বীর আল্লাহ্র লেখে দেওয়া ভাগ্য অনুযায়ী শহীদ হলেন ।
MARTYRDOM OF IMAM HUSAIN
Shimar shouted to his men,
"How cowardly you all are? You cannot even kill an injured person. There are so many of you that if all of you were to throw one stone at a time he would be killed and buried. So what are you doing? Attack him at once and kill him instantly."
When Imam Husain heard that Shimar was urging the people to attack him, he said,
"The prophecy of the Prophet has come true. The Prophet had said that he was looking at a white dog that was sniffing at the blood of his family." The reason Imam Husain said this was because Shimar had leprosy.
When they heard this they started to attack. Some of them started to shoot arrows at Imam Husain. Zurah bin Sahreek Tamimi attacked Imam Husain on his right shoulder, causing him deep and serious wounds. After that Sinan bin Anas Nakhee threw a spear at Imam Husain. The sheer force made Imam Husain fall to the ground, and Khowla bin Yazid Asbahi came forward with the intention of cutting off Imam Husain's head. At that time Imam Husain's whole body was shaking. Sanan said to Khowla, "You get back, I will cut his head off." He came forward and cut Imam Husain's head and separated it from his body. They started to divide Imam Husain's belongings amongst themselves. Baher bin Ka'b took Imam Husain's shirt, Qais took Imam Husain's shoes and Aswad Azdee took his sword. There were spear wounds , and forty-three sword wounds on Imam Husain's body.Umar bin Sa'd ordered ten horsemen to ride over Imam Husain's body at such a speed that the meat would be separated from the bones.
শহীদ হওয়ার পূর্বে তিনি ইরাকবাসীকে বলেন
তোমরা কি চিঠির মাধ্যমে আমাকে এখানে আসতে বলোনি? আমাকে সাহায্য করার ওয়াদা করো নি? আকল্যাণ হোক তোমাদের ! যে অস্র দিয়ে আমরা ইসলামের শত্রুদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছি এখন সে অস্র তোমরা আমাদের বিরুদ্ধে চালাতে যাচ্ছ? মাছি যেমন উড়ে যায় তেমনি তোমরা আমার বায়াত থেকে সরে যাচ্ছ, সকল ওয়াদা ভঙ্গ করেছ । এই উম্মতের তাগুতের দল, তোমদের ধ্বংস হোক!
ইয়াজিদ প্রত্যক্ষভাবে হুসাইনের (রাঃ) হত্যায় জড়িত ছিল না । যে আশায় ইরাকবাসী শিয়ারা বিশ্বাসঘতকতা করেছিল সে আশা যেন পূর্ণ না হয়, অর্থাৎ উমাইয়া শাসকরা যেন এই প্রতারকদের উপরে সন্তুষ্ট না হয় এমনটি দু’আ করেছিলেন হুসাইন (রাঃ) । আল্লাহ্ এ দু’আ কবুল করে নেন । পরবর্তীকালে উবাইদুল্লাহ বিন যিয়াদকে ইয়াজিদের আদেশে হত্যা করা হয় ।
শাইখুল ইসলাম ইমাম ইবনে তাইম্যিয়া বলেন, সকল মুহাদ্দিস ও ঐতিহাসিকরা এ ব্যাপারে একমত যে ইয়াজিদ বিন মুয়াবিয়া হুসাইনকে (রাঃ) হত্যার আদেশ দেয় নি । বরং উবাইদুল্লাহ বিন যিয়াদকে ইরাকে হুসাইনকে কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে বাঁধা দিতে বলেছিল । বিশুদ্ধমতে, তাঁর কাছে যখন হুসাইন (রাঃ) নিহত হওয়ার খবর পৌঁছায় তখন সে আফসোস করেছিল । সে হুসাইন পরিবারের কোন মহিলাকে বন্দী বা দাসীতে পরিণত করে নি বরং পরিবারের জীবিত সকল সদস্যকে সসম্মানে মদীনায় পাঠানোর ব্যবস্থা করেছিল ।
১০ই মুহাররম
কারবালার ঘটনার স্মরণকল্পে তাজিয়া মিছিলসহ শোক প্রকাশের জন্য অন্যান্য যা কিছুই করা হয় সেগুলো শিয়াদের অনুকরণ যে শিয়ারাই হুসাইন (রাঃ) এর আসল হত্যাকারী । ইসলামের মূলনীতির বিরোধী এসব আচরণ শারঈ সীমানার লঙ্ঘন ।
ইসলামে সস্তা আবেগের কোন মূল্য নেই, সস্তা আবেগকে পুঁজি করে ভেসে আসা নতুন কিছুর ঠাই নাই এখানে । আবেগ এখানে authentic . খাদহীন ।
তেমনি ১০ই মুহাররম মূলত আমাদের কাছে অন্য কারণে গুরুত্বপূর্ণ । এর গুরুত্ব কারবালাকে কেন্দ্র করে নয় বরং মুসা (আঃ) এর মুক্তিকে কেন্দ্র করে । নব্যুয়াতের পূর্বে রাসূল (সাঃ) মূলত কিতাবিদের অনুসরণ করতেন ।
আব্দুল্লাহ উবনে আব্বাস (রাঃ) বলেন; নবী (সাঃ) মাদীনায় কিছু ইহুদীকে আশুরার দিনে সিয়াম রাখতে দেখে জিজ্ঞাসা করলেনঃ এটা কোন সিয়াম? তারা উত্তর দিল, এটা একটি পবিত্র দিন । এদিনে আল্লাহ্ বনী ইসরাইলকে তাদের শত্রুদের থেকে মুক্তি দিয়েছেন । তাই মুসা (আঃ) এ দিন সিয়া থাকতেন । নবী (সাঃ) তখন বললেনঃ তাদের চেয়ে মুসা (আঃ) এর সাথে আমার সম্পর্ক বেশি আপন । তিনি সেদিন সিয়াম পালন করলেন এবং সাহাবীদের সিয়াম পালনের নির্দেশ দিলেন । অপর এক বর্ণ্নায় পাওয়া যায়- তিনি ইহুদীদের অনুকরণ করবেন না বিধায় মুহাররমের ৯ এবং ১০ এই দু দিনই সিয়াম পালনের নিয়ত করেছিলেন।
ইসলাম পুঁথির কিচ্ছা নে যে লোক মুখে যা শোনে আসব তাই বিশ্বাস করতে হবে; কতটুকু যুক্তি সঙ্গত এবং মূলনীতি ( কুরআন - হাদিসের) সাথে সাংঘর্ষিক কিনা তা যাচাই করে মানা হচ্ছে ইসলাম । মানুষের আবেগের মূল্য ইসলাম দিতে জানে কিন্তু আবাগের নামে ডাহা মিথ্যে কিংবা সত্য-মিথ্যার সংমিশ্রিত আবেগকে তুলে ফেলে দেয় ইসলাম ।
আল্লাহ্ আমাকে; আপনাকে এবং সবাইকে সত্য জেনে; মেনে এবং দেখে-শোনে চলার- গড়ার তৌফিক দান করুক । আমিন ।
যা থেকে অনুকরণ এবং কিঞ্চিৎ নেয়া হয়েছে
১) The Hisotory of Karbala by Abu Ammar
২) বাক্সের বাইরে by শরীফ আবু হায়াত অপু
৩) Islamic Information Cnetre; UK
৪) তারিখ আল খুলাফা
৫) তাবারি volume 19
৬) তারিখ ইবন কাসির