আজকে কোরআনে ক্ষমা সম্পর্কে কি বলল তা জানব এবং তার সাথে বাস্তব জীবনে আরবি কে এড়িয়ে বাংলা অনুবাদ পড়ে আমরা কোরআনের মূল ভাবার্থের উপলব্ধি থেকে কত দূরে আছি তাঁর ছোট্ট একটি উদাহরণ দিব ।
ক্ষমা নিয়ে দুইটি আয়াত আলোচনা করব; তাঁর আগে আমাদের জানা দু'টি উদাহরণ আবার জেনে নেই "যে আপনাকে কষ্ট দিল সে আপনার গুনাহর ভাগ কিছুটা হলেও লাঘব করে দিলো, সে জন্য তাকে ধন্যবাদ সহ মাফ করা দেয়া যায় । দ্বিতীয়ত খলিফা উমর (রাঃ) তাঁর হত্যাকারীদের শাস্তি দিতে বারণ করেন, কারণ সে তাকে হত্যা করার মাধ্যমে তাঁর সমস্ত দোষত্রুটি নিজের কাঁধে তুলে দিয়ে তাঁকে মুক্ত করে দিলো ।
ক্ষমা ও আল্লাহর পক্ষ থেকে আমাদের পুরষ্কারঃ
এবার আসুন কোরআনের আয়াতে; আল্লাহ্ আমাদের জন্য ক্ষমার পরিবর্তে কি রেখেছেন তা জানাতে সূরা আল-ইমরানের ১৩৩ আয়াতে আল্লাহ্ বলেছেন "তোমরা তোমাদের পালনকর্তার ক্ষমা এবং জান্নাতের দিকে ছুটে যাও"।
এখানে ক্ষমা ও জান্নাত সমার্থক, কারণ আল্লাহ্ যাকে ক্ষমা করেন কেবল তাঁরাই জান্নাতে যেতে পারবে । এক্ষেত্রে কোনব্যক্তি যতই পূণ্যবান হোক না কেন, তিনি ভুলত্রুটির উর্ধ্বে নন । সুতরাং মানুষ মাত্রই বুঝতে হবে আমদের ক্ষমার প্রয়োজন ।
পুরষ্কিত হবার গুণাবলিঃ
তবে ক্ষমা প্রাপ্তির জন্য যে গুণাবলিগুলো দরকার তা তিনি পরবর্তী আয়াতে ( সূরা আল-ইমরানঃ আয়াত ১৩৪) বলে দিয়েছেন-
"যারা সচ্ছলতায় এবং অভাবের সময় ব্যয় করে, যারা নিজেদের রাগকে সংবরণ করে , আর মানুষের প্রতি ক্ষমা প্রদর্শন করে, বস্তুত আল্লাহ্ সৎকর্মশীলদেরকেই ভালোবাসেন"
এই আয়াত দ্বারাই আজকের বিষয় আলোচনা করতেছি; এজন্য আরবি আয়াতটি পড়ুন-
"الَّذِينَ يُنفِقُونَ فِي السَّرَّاء وَالضَّرَّاء وَالْكَاظِمِينَ الْغَيْظَ وَالْعَافِينَ عَنِ النَّاسِ وَاللّهُ يُحِبُّ الْمُحْسِنِينَ"
এখানে "কাযিমিনাল গওইয ( كَاظِمِينَ الْغَيْظَ )" শব্দ দু'টি লক্ষ্য করুন । আরবিতে " কাযিমিন ( كَاظِمِينَ ) অর্থ যারা গিলে ফেলা এবং " গওইয ( غَيْظَ ) হল রাগ । এবার উপলব্ধির ক্ষেত্রে আসুন; মনে করুন আপনি শ্রেণীকক্ষে কিছু খাচ্ছেন তন্মধ্যে আপনার শিক্ষক আসলেন
এক্ষেত্রে আপনার সামনে দুটি উপায় থাকে হয় মুখে রাখা কিংবা সম্পূর্ণ গিলে ফেলা । যখন মুখে রাখবেন তখন মাঝে মাঝে তা নেড়ে চেড়ে রাখতে হবে কিংবা তার বাহ্যিক অবস্থান আপনাকে বিব্রত করবে । আর আপনি যদি তা গিলে ফেলেন তাহলে তার জন্য আপনাকে কোন বিব্রত হতে হবে না । আপনাকে একজন স্বাভাবিক ছাত্র হিসেবে উল্লেখ করবে ।
ঠিক সেভাবে আল্লাহ্ আমাদের আদেশ দিয়েছেন আমরা যেন আমাদের রাগকে গিলে ফেলি; তাহলে দোষিত ব্যক্তি এবং আপনার মাঝে খারাপ মনোভাব আসবে না, আপনার দ্বারা সমাজে খারাপ কিছু হবে না । কিন্তু যখন আপনি রাগকে মুখে লুকিয়ে রাখার মত রাখবেন তখন খাবারের মত আপনার রাগকে ও আপনার অনিচ্ছা সত্ত্বেও নাড়তে হবে । (আল্লাহু আকবর; উপলব্ধি দেখুন... এমনিতে সিজদাহতে লুটীয়ে পড়ার ইচ্ছে হবে)
সংবরণ আর গিলে ফেলার মধ্যকার পার্থক্য হল দমিয়ে রাখা আর হজম করে ফেলা ।
অর্থাৎ আমাদের অপরাধীকে এমনভাবে ক্ষমা করে দিতে হবে যেন রাগের উপস্থিতিই অনুভূত না হয় ।
কিভাবে মানুষকে ক্ষমা করবেনঃ
মানুষের প্রতি ক্ষমা প্রদর্শণ করে বুঝাতে "আফিন ( عَافِينَ ) " শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে যার অর্থ "যারা ভালবেসে ক্ষমা করা দেয়" । সে যদি আপনার মনের কুটিরের আঘাত দিয়েও থাকে ; আপনি তাকে ক্ষমা করলেন কিন্তু মনের মাঝে ক্ষোভ রাখলেন তাহলে এই ক্ষমা আল্লাহ্র কাছে গ্রহণ যোগ্য হবে না । যে যতই ক্ষমা করার অযোগ্য হোক না কেন তবুও আপনাকে উদারতা দেখিয়ে ক্ষমা করে দিতে বলা হয়েছে ।
কিভাবে উদারতা দেখাবেনঃ
এখন বলতে পারেন এতো ঊদার হওয়া সম্ভব কিনা । হ্যাঁ; তা সত্য যে আমাদের কাছে মানবীয় উদারতা চাওয়া হলেও প্রকৃতপক্ষে আমরা মানবীয় দূর্বলতার উর্ধ্বে নয় । সেক্ষেত্রে আমাদের উপলব্ধির জায়গায়টা পরিষ্কার করতে হবে- কারণ যখন আমাদের মাঝে উপলব্ধি আসবে যে আমাদের কর্ম একমাত্র আল্লাহর জন্য তখন আমরা এসকল দুর্বলতাকে কাটিয়ে উঠতে পারব ।
দূর্বলতাকে কাটিয়ে উঠার জন্য কিংবা আল্লাহর কাছ থেকে ক্ষমা চাওয়ার জন্য বা কাউকে ক্ষমা করার জন্য আপনাকে আল্লাহর প্রতি আনুগত্য হতে হবে । তাছাড়া আদৌ সম্ভব নয় কারণ যখনই আপনি কারও কাছে ক্ষমা চাবেন তখন আপনার "ইগো" এবং "শয়তানের কুমন্ত্রণা" আপনার সামনে বাধার প্রাচীর হয়ে দাঁড়াবে ।
যখনই আপনি ইগোর কাছে নিজেকে আত্মসমর্পন করবেন তখনি শয়তান বিশাল হাঁপর দিয়ে রাগে আগুনে ফুঁ দেয় । এটা সবার জানা যে শয়তান তার ইগোর কাছে নিজেকে আত্মসমর্পন করার কারণেই স্বর্গ থেকে বিতাড়িত হয়েছিল । রাগকে দমন করার প্রধান অস্র হল ইগোকে ধমন করে আল্লাহর আনুগত্য স্বীকার করে নেয়া ।
আল্লাহ্ পরম করুণাময়, তিনি অপরাধী এবং ক্ষমাকারী উভয়কেই ক্ষমা করে দেন; আল্লাহ্ বলেছেন "তোমরা কি চাওনা আল্লাহ্ ক্ষমা করুন?" ( সূরা আন-নুরঃ আয়াত ২২)
আমি ক্ষমাশীল বা মহানুভাব নয়, মানুষ হিসেবেও উচ্চস্তরের নয় বলা যাবে না । তাই রাগ হলে আল্লাহর কাছে ক্ষমা চান, তাঁর সাথে চুক্তি করুন ...
কিন্তু রাহমানের বান্দা হয়েও আমরা কি রাহমাহকে আঁকড়ে ধরেছি বরংচ ক্ষমা করার ব্যাপার হলে আমরা দোষী ব্যক্তির ত্রুটি বিশ্লেষণে উদ্যমী হোয়ে পড়ি । নিজের উপলব্ধির জায়গায়টি যখন সতেজ থাকবে তখন অন্যের দোষ খুঁজার পরিবর্তে নিজের ত্রুটি চোখে পরবে আর এভাবেই আমরা ইগো এবং শয়তানের বাধার প্রাচীরটি অতিক্ক্রম করে আল্লাহর কাছে পৌঁছে যেতে পারি ।
ভুল বুঝবেন না কিন্তু! :
কাউকে ক্ষমা করার মানে এই নয় যে তাঁকে আরেকবার যাচ্ছেতাই করার সুযোগ করে দেয়া । ক্ষমা করার পাশাপাশি অবশ্যই সাবধানতা থাকতে হবে সেই ব্যক্তিটী যেন আবার কষ্ট দেয়ার সুযোগ না পায় । সুতরাং আপনি কাউকে ক্ষমা করুন এবং সাথে পরিষ্কার করে দিন এই সুযোগটি তাকে আর দেওয়া হবে না ( অবশ্যই ভালবাসা দিয়ে বুঝিয়ে দিতে হবে )।
ইতি টানব, সূচনার কিছু বলে উপরিউক্ত আলোচনায় আল্লাহর ক্ষমা প্রত্যাশীদের গুণাবলি বর্ণনা করতে গিয়ে আমরা মূল বাংলা তরজমার মাধ্যমে মূল ভাবার্থ এর কিছু অংশ পেয়েছি । কিন্তু "আফিন" "কাযিমিন" "গওইয" শব্দত্রয়ের মূল আরাবিক অর্থের মাধ্যমে যে মূল ভাবার্থ সহজে বুঝা সম্ভব হয়েছে তা বাংলা তরজমা দ্বারা হয় নি । তাই আমাদের প্রত্যেক মুসলিমের উচিত মাতৃভাষায় কোরআন পড়ার পর যতটুকু সম্ভব মূল আরাবিক টা আরবি ভাষা চর্চার মাধ্যমে পড়া । তাহলে হয়ত কেউ কোরআন পড়ে হানাহানির পথ কিংবা মানুষকে পূজা করার পথ বেছে নিবেন না; পথভ্রষ্টরা কোরআনের মায়াজালে ফেলে আপনাকে বিভ্রান্ত করতে সাহস পাবে না । এক্ষেতে ইমাম ইবনে তাইমিয়্যা (রঃ) এর কঠোরতা আমার কাছে যৌক্তিক মনে হয়; কেননা তিনি বলেছিলেন "প্রত্যেক মুসলমানে আরবি ভাষা শিক্ষা ফরয হওয়া উচিত" (যদিও ফতোয়া নিয়ে মানুষের মাঝে বিভক্তি সৃষ্টি হয় তাই শুধু উপলব্ধির স্থান থেকে তা নেয়ার জন্য অনুরোধ রইল ।
বিশেষ মন্তব্যঃ ইহা আমার একান্তই উপলব্ধি, তবে মূল থীমকে ঠিক রেখে তা লেখার চেষ্টা ছিল । লেখাটি রেহনুমা বিনতে আনিস আপুর ওপারে বইয়ের " হে রাহমানের বান্দারা" আর্টিকেল দ্বারা প্রভাবিত হয়ে লিখা । তাই কিছু অংশ এবং বর্ণনা মিলে যাওয়া অস্বাভাবিক কিছু নয় । মহান আল্লাহর কাছে কৃতজ্ঞ । আল্লাহ্ যেন উনার মত আর ও মুসলিম মহিলা লেখিকা আমাদের মা-বোনদের খেদমতে নিয়োজিত করেন । আমিন । আর কোরআনের আয়াতের বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে তাফসীর গ্রন্থ এবং হাদিসের বিকল্প নেই ।
মোঃ তাজুল ইসলাম
১৯ রজব ১৪৩৭ হিজরী