[লেখাটা অনেক আগের,মনে হল,প্রাসঙ্গিকতা হারায়নি,তাই ২৬ মার্চের প্রাক্কালে আবারো দিলাম,হয়তো কেউ পড়তেও পারেন]
"আবু মোহাম্মদ কাওসার,বীর মুক্তিযোদ্ধার সন্তান"
নাম জিজ্ঞেস করার পর ছেলেটার এমন উত্তর শুনে একটু অবাক হয়ে তাকাই। কত বয়স? ১০-১১ হবে। উত্তরটা ঠিকমত শুনলাম কিনা ভেবে আবারো প্রশ্ন করি--"কি নাম?" এবার একটু মনোযোগ দিই,কান পাতি। না,একই কথা--"আবু মোহাম্মদ কাওসার,বীর মুক্তিযোদ্ধার সন্তান"। মায়ের দিকে তাকাই,ব্যাখ্যার আশায়,মা বলে,সুলতানের ছোট ছেলে। পরিষ্কার হয় ব্যাপারটা এতক্ষণে। সুলতান মামা,আমার মায়ের চাচাতো ভাই,গ্রামের বাড়িতে থাকে,যখন শহরে আমার নানাবাড়িতে আসে,মাঝে মাঝে কথা হয়।সহজ-সরল মানুষ,বাড়িতে গেরস্থালি দেখে,চাষবাস করে,অবস্থা খুব একটা ভাল না। তবে,মায়ের কাছে তাঁর গল্প শোনা অন্য কারণে।মামা ছিলেন মুক্তিযোদ্ধা। তা ঐ বাড়িতে আরো মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন,মা দের ঐ বাড়ি যুদ্ধের সময় পুড়িয়ে দেয় পাকবাহিনী মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয়স্থল ছিল বলে,এই মানুষটা তাহলে আলাদা কোথায়? আলাদা,কারণ এই দুঃসাহসী মানুষটি মুক্তিযুদ্ধে যখন যোগ দেন,তখন তাঁর বয়স মাত্র ১৩ বছর। সম্মুখযুদ্ধ করেছেন ঐ বয়সেই রাইফেল হাতে,বিশ্বাস হতে চায় না,রূপকথা মনে হয়।এখনো যখন মানুষটাকে দেখি,কেমন যেন লাগে,অবাক হতেও ভুলে যাই। ঐতো একটা খুব সাধারণ খেটে খাওয়া লোক,যা বয়স, পরিশ্রম আর দারিদ্র্যের কারণে তার চেয়েও বেশি দেখায়।নিরীহ চেহারা,কোথাও খুঁজে পাইনা যুদ্ধদিনের সেই আগুন,কথাতেও না। কোন নেতা নয়,মুক্তিযুদ্ধ ভাঙিয়ে খাওয়া বা ইজারা নেয়া কোন রাজনীতিবিদ বা ব্যবসায়ী নয়।যখন হৃদয়ের ভেতর থেকে দেশের ডাক এসেছে,অস্ত্র হাতে জীবনবাজি রেখে নেমেছিলেন ময়দানে,দেশ স্বাধীন হবার পরে তাঁরই মত আরো হাজারো গণযোদ্ধার সাথে মিশে গেছেন জনসমুদ্রে। কোন বাড়তি সুবিধা পাননি মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে। অভিযোগ নেই কোন,যুদ্ধ করে কি পেলেন,এই প্রশ্নের উত্তরে আরো অনেকের মতই বলেছিলেন,দেশের জন্য যুদ্ধ করসিলাম,যুদ্ধ বেইচা খাওয়ার জন্য তো করি নাই। এখন আমি ভাবি,এমন মানুষগুলোর সন্তানরা তো মাথা উঁচু করে সগর্বে নিজের নামটা বলে বলতেই পারে--"বীর মুক্তিযোদ্ধার সন্তান"।
আমরাও কি একি কথা বলতে পারিনা? আমরাও তো এদেরই দেয়া রক্তের সন্তান,এই যোদ্ধারাই তো জাতি হিসেবে আমাদের জন্ম দিয়েছে,সৃষ্টি করে গেছে এমন এক মহাকাব্য,পৃথিবীর সমস্ত বীররসের কাব্য যার কাছে ম্লান একদমই। অভিমন্যু কি '৭১ এর সেই ১৩ বছরের কিশোরের চেয়েও বেশি সাহসী ছিল? একিলিস বা হেক্টর কি ছিল আমাদের সিপাহী মোস্তফা বা নূর মোহাম্মদের চেয়েও মস্ত কোন বীর? এঁদের মত আরো কত নাম জানা বা না জানা মহাবীররা সেই আগুনের দিনগুলিতে যে রূপকথা লিখে গেছে,তেমন গল্প কেউ কি কখনো লিখেছে? সবাই আসুন না স্বাধীনতার এই মাসে সব কাদা ছোঁড়াছুড়ি আর নোংরা ঘাঁটাঘাটি বাদ দিয়ে মনের সব আবেগ দিয়ে লিখি এসব যোদ্ধাদের কথা,পরের প্রজন্মকে জানিয়ে দিই কি অসাধারণ বীরত্ব আর আত্মত্যাগের উত্তরাধিকার ধারণ করে আছি আমরা। কে জানে,শত বা হাজার বছর পরে হয়তো অনেক দূরের কোন দেশের কেউ আমাদের যোদ্ধাদের রক্তে লেখা সেই মহাকাব্য পড়ে শোনাবে--"অনেক অনেক দিন আগে বঙ্গোপসাগরের তীরের ছোট্ট একটা ভূখণ্ড জন্ম দিয়েছিল সাহসী অনেক মানুষের,সত্যিকারের মানুষের,যারা নিজের মাকে বাঁচাবার জন্য শূন্য হাতে দানবের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে লড়েছিল---"।
স্বাধীনতা দিবসের প্রাক্কালে সেইসব দানবজয়ী রাজকুমারদের জন্য রইল অন্তরের সব শ্রদ্ধা ও ভালবাসা।