গুলিস্তানের ফুলবাড়িয়া পার হয়ে চানখারপুলে এসে জ্যামে পড়লাম । ভয়াবহ জ্যাম । ডানে বায়ে কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই । লোক মুখে শোনা গেলো সামনে নাকি রাস্তার মাঝখানে একটা ট্রাক আইলেনে ধাক্কা খেয়ে নষ্ট হয়ে গেছে । রাস্তা ক্লিয়ার হতে সময় লাগবে । গাড়ির ড্রাইভাররা এই কথা শুনে ইঞ্জিন বন্ধ করে দিলো ।
দেখতে দেখতে ঘড়ির কাঁটা বারোটা থেকে দেড়টায় । একটু পেছনে তীব্র শব্দে এম্বুলেন্সের সাইরেনটা খুব আকুল হয়ে বাজছে । রোগীর অবস্থা মনে হয় খারাপ । এতোক্ষন একটু ছায়া ছায়া ছিলো , এখন চোখ ঝলসে দেওয়ার মতো প্রখর রোদ । বাংলাদেশে এখন ঋতু হয়ে গেছে একটা ; আজগুবি ঋতু । এ ঋতুতে যখন খুশী রোদ , যখন খুশী বৃষ্টি । রিকশার হুডটা তুলে দেবো কিনা ভাবছি । একটু দ্বিধাদ্বন্দে আছি, কারণ আমার ডানপাশে ঠিক এক রিকশা আগে একজন মায়াবতীর সাথে বেশ কয়েকবার চোখাচোখি হয়েছে । শেষবারে সে একটু অস্পষ্টভাবে হাসলোও যেন । এমন উস্কানিমূলক অবস্থায় রিকশার হুড তুলে দেয়াটা ঠিক নিরাপদ নয় । কারণ কোন এক অদ্ভুত কারনে অনেক মেয়েই রিকশায় হুড তুলে চলা ছেলেদের মেয়েলী স্বভাবের ছেলে ধরে নেয় ।
যাচ্ছি এক বান্ধবীর গায়ে হলুদে । বহু দূরে তার বাসা, জ্যাম না থাকলেও পৌছতে বিকেল হয়ে যেতো । বেলা গড়ানোর সাথে সাথে ক্ষুধা বেড়েই চলেছে । ব্যাগে কখনো সখনো টুকটাক ড্রাই ফুড থাকে । নেড়েচেড়ে দেখলাম । এক বোতল পানি ছাড়া কিছুই নেই । পানিটাই খেলাম একটু ।
......কিছুক্ষনের জন্যে অন্যমনস্ক হয়ে গিয়েছিলাম । সংবিৎ ফিরে পেয়ে দেখি ঐ মেয়েটা আরেকজনের সাথে চোখাচোখি করছে । আমার মন বিষন্ন হয় ।
- " বাবা ক্ষুধা লাগছে নাকি তোমার ? "
রিকশার গা ষেঁষে দাড় করানো এক প্রাইভেট কারের জানলা থেকে এক গোলগাল চেহারার মাঝবয়সী মহিলা মুখ বের করে জিজ্ঞেস করেছেন । তার মাঝে মাতৃভাব প্রবল ।
এ ধরনের প্রশ্নে ভদ্রতা দেখিয়ে না করার নিয়ম ।
- " জ্বি লেগেছে । বুঝলেন কিভাবে? "
- " বারবার ব্যাগ কি যেন খুঁজছো দেখে মনে হলো । এই নাও , এইগুলো থাও । "
বলে আমার দিকে এক প্যাকেট বিস্কুট বাড়িয়ে দিলেন । না করলাম না । কিছু মানুষের মমতা ফিরিয়ে দেয়া যায় না । কুটকুট করে খাওয়া শুরু করি ।
বিকেল হয়ে গেলো । কিছুক্ষন আগে থেকে রোগী মারা যাওয়ায় সাইরেন আর বাজছে না । রোদও মরে গেছে । সবাই ক্ষুধার্ত । কিছু খাওয়া দরকার । আশেপাশের দোকান থেকে চাল, ডাল, আনাজ পাতি আনা হলো । আমি সহ আরও কয়েকজন নেমে রিকশা, গাড়ি একটু একটু করে চাপিয়ে রাস্তার মাঝখানে কিছুটা জায়গা ফাঁকা করে ইট দিয়ে চুলো বানালাম । আমাকে বিস্কিট খেতে দেয়া সেই আন্টি কোমড়ে আঁচল বেঁধে রান্নায় নেমে গেলেন । জ্যামের অবস্থা দেখে শুধু দুপুর না , রাতের খাবারও রান্না হলো । খাবারের স্বাদ অমৃতসম ।
রাতে খাওয়ার সময় দেখলাম ঐ ছেলে মেয়ে দুটোর প্রেম হয়ে গেছে । খাওয়া শেষে মেয়েটা লাজুক মুখে তার রিকশা ছেড়ে চলে গেলো ছেলেটার রিকশায় । তাদের মনে মনে আশীর্বাদ করি । জগতের সকল ভালোবাসা সুখি হোক ।
সকাল হলো । রাতে রিকশায় বেকায়দায় ঘুমানোয় সারা শরীর ব্যথা । উঠে রাস্তার পাশের সরকারি কলের পানিতে মুখ ধোয়া শেষে দেখি রাতের উপায়েই নাস্তা হাজির ।
ছুটছে, ছুটবে করেও জ্যাম ছুটলো না । দিন কাটতে লাগলো । কাটতে লাগলো সপ্তাহ, মাস ...
একদিন শুনি মেয়েটা আর ছেলেটার সম্পর্কটা নেই । ভেঙ্গে গেছে । সে আবার ফিরে এলো তার নিজের রিকশায় । চেহারায় মলিনতার ছাপ । মাঝেমাঝে সে পিছু ফিরে এক দৃষ্টে আমার দিকে তাকিয়ে থাকে । আমিও মায়াবতীর চোখে চোখ রাখি । কিন্তু বুকের ভিতরে কিছু অনুভব করি না ।
......আমরা সবাই স্থবির হয়ে দাড়িয়েই আছি । এরই মাঝে বেশ কয়েক বছর সময় কেটে গেছে । যে বান্ধবীর বিয়ে খেতে যাওয়ার কথা ছিলো, সেদিন ফোনে জানালো তার এখন ফুটফুটে একটা বাচ্চা আছে, ক্লাস টুতে পড়ে ।
..... এখানে এখন আর কেউ দিন - তারিখের হিসাব রাখে না । কি লাভ রেখে? রিকশা, গাড়িতে থাকা বাচ্চাদের পড়াশোনার ক্ষতি হচ্ছে দেখে আমরা একটা স্কুল খুলেছি কিছুদিন হলো । আমি ওখানে বাংলা পড়াই । আর মেয়েটা গনিত । প্রতিদিন দেখা হয় তার সাথে , কখনো কথা হয় না । নামটাও জানা হয় নি । মায়াবতী তো মায়াবতীই, তার অন্য নামের আবার কি দরকার?
সময় নিস্তরঙ্গ । তবু আজও আমরা অপেক্ষা করি একদিন গাড়ির এ জট ছুটবেই , তখন আমরা যার যার গন্তব্যে পৌছবো । যারা গন্তব্যের ঠিকানা ভুলে গেছে, তারা নতুন গন্তব্য খুঁজে নেবে । নগরীর মাঝে আটকে পড়া আমাদের কথা আর কারো মনে নেই । আমরা সবার মাঝে থেকেও হারিয়ে গেছি ।
সবকিছুর পরেও, এই অন্তহীন স্থবিরতায় বেশ ভালোই আছি আমরা ।
( অনেক আগে একটা ম্যাগাজিনে লেখক শিমু নাসেরের একটা ছোট গল্প পড়েছিলাম । এতদিন পর এখন আর নামটা মনে পড়ছে না । এ লেখাটা সেই লেখার ছায়া অবলম্বনে রচিত )
সর্বশেষ এডিট : ০৮ ই মে, ২০১৬ রাত ১১:০৭