ইমরান এখন যে মেসটায় উঠেছে সেটা একটা গার্মেন্টস বিল্ডিং এর পেছনটায়, ঘিঞ্জি বস্তিমত আধখোলা একটা জায়গা, পুরানো বিল্ডিংটার দেয়ালের সিমেন্টের পলেস্তরা চাকা চাকা হয়ে খুলে ঝুলে আছে। ডানপাশে যে বস্তি এলাকাটা আছে, সেটার সাথে বেড়া দিয়ে বাড়ির একমাত্র সীমারেখাটা টানার ব্যর্থচেষ্টা করে যাচ্ছে এখনো চারফুটি আধভাঙ্গা শেওলা পড়া ইটের দেয়ালটা। যদিও তাতে যে উপকার হচ্ছে খুব একটা -তা কিন্তু না। বরং সকালে সাড়ে ৭ টার দিকে যখন গার্মেন্টস খোলে বস্তির গার্মেন্টসে কাজ করা নানা বয়সের কর্মীরা তাড়াহুড়োয় অনেকসময় দেয়ালটার ভাঙা প্রাচীর টপকেই চলে যায় ওপাশে। দেরী হলে ঝামেলা আছে। ছোট্ট রাস্তাটায় সকাল আর সন্ধ্যায় এই মানুষগুলোর ভিড়ে পাটুকু ফেলার জায়গা মাইক্রোস্কোপ দিয়ে খুঁজেও পাওয়া যাবে কিনা সন্দেহ।
সবাই ছুটছে পেটের তাগিদে, জীবিকার একমাত্র উৎস হিসেবে চিহ্নিত ওই রংচটা কালচে ধোঁয়াটে চিমনি ওয়ালা গার্মেন্টস বিল্ডিং গুলোয়।
ইমরানকেও ছুটতে হয়, সবার সাথেই, তবে তার গন্তব্য ভিন্ন! সে যায় ইউনিভার্সিটির ক্যাম্পাসে ক্লাস করতে। সকালে আহামরি কিছু মুখে দেবার অভ্যাস ছিলোনা কোনকালেই। হবে কি করে? হতদরিদ্র গ্রাম্য কৃষকের ছেলেদের স্কুলে যেতে হয় হয়তো অনেক সময় না খেয়েই। সকালের খাওয়াটা তাই তার কাছে আদৌ কোন গুরুত্ব বহন করে টরেনা। রাস্তার পাশের রমিজের টং থেকে ৫ টাকায় শিঙ্গাড়া মুখে দিলেই চলে বেশিরভাগ সময়। গ্রামের সামান্য কৃষকের সন্তান হলেও, ভর্তি যুদ্ধে হাজার হাজার প্রতিযোগী ডিঙিয়ে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাক্রমের একেবারে প্রথম সারির একটা বিষয়ে ভর্তি হয়েছে- লাজুক মায়াবী চোখ দুটোয় একরাশ মধু মায়াবী স্বপ্ন ,উচ্চশিক্ষার একবুক আশা আর কাঁধে অসহায় কৃষক বাবার অর্থনৈতিক ভাবে খোঁড়া সংসারটার ভবিষ্যতটুকুর ভার নিয়েই।
ঢাকায় আসার পরে প্রথমেই যে সমস্যা গুলোর সাথে তাকে যুঝতে হয়েছে, তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে, খাওয়া আর থাকার খরচ। যার একমাত্র সমাধান হিসেবে খুঁজে নিতে হয়েছে অল্প ক টাকার টিউশুনি। যদিও সারাদিন ক্লাস ল্যাব শেষে শ্রান্ত দেহে মানুষের বাচ্চার সিলেবাস বই-খাতা নিয়ে গুতোগুতির পরে মাসশেষে সামান্য যে কটা টাকা হাতে আসে, তার প্রায় সবটাই চলে যায়, মেসবিল, আর হোটেলের বাকি টাকা শোধ করতে। ভেবেছিল সরকারি ভার্সিটিতে যখন ভর্তি হওয়া গেছে, থাকা খাওয়ার খরচ নিয়ে অন্তত ভাবতে হবে না।
কিন্তু, কিসের কি? বাস্তবের মাটিতে পা ফেলতে দৃশ্যপট বদলে গেল। এখানে হল তার মত সাধারণ ছাত্রদের জন্য না। বেশিরভাগ হলই বেদখল। সংসদ সদস্য, পুলিশ, স্থানীয় প্রভাবশালী ও আওয়ামী লীগ নেতাদের দখলে। কোনটা হয়তো মূলভবনের বেশিরভাগ অংশ ভেঙে সাংসদের স্ত্রীর নামে দাঁড়িয়ে গেছে ‘গুলশানআরা সিটি মার্কেট’ কোনটায় হয়তো দাঁড়িয়ে গেছে হার্ডওয়ারের দোকান, কোনটা ভেঙে হয়েছে, পুলিশ সমিতি! যাও আছে তাও আছে সরকারী দলের বিশেষ "ছাত্র" নামধারী সোনার ছেলেদের জন্যই বরাদ্দ। ওখানে পা মাড়াবার সামর্থ্য কিংবা যোগ্যতাবিশেষ কোনটাই তার নেই, থাকবার কথাও নয়।
দুপুরে যে হোটেলটায় সে খায়, তা খুবই সামান্য একটা টিনশেড সস্তাদরের হোটেল হলেও বিল কিন্তু তার পকেটের ওজন হিসেবে খুব একটা কম আসেনা!
মোটা চালের ভাতের প্লেট ১০ টাকা আর একটা ডিম ২০ টাকা রাখে। পানি ফিল্টারের হলে সেখানেও নোট গুনতে হয়। ডিম ছাড়া অন্য কোন মেনু চেখে দেখার সাহস সে খুব কমই পায়। তারপরও মাসের যাবতীয় পকেট খরচ আর দৌড়াদৌড়ি শেষে বেশ কিছু টাকা বাকি পড়ে যায় হোটেলটায়।
সব যুদ্ধ শেষে ব্যস্ত আর নিষ্ঠুর দুনিয়াটারে ক্লান্ত চোখে দেখতে দেখতে ফিরে আসতে হয় একসময় গার্মেন্টস বিল্ডিং গুলোর পাশ দিয়ে ঢল নামা শ্রমিকদের সাথে পা চালিয়ে ঘিঞ্জি ছোট্ট গলিটার শেষ মাথায়, অপেক্ষায় থাকা তার একমাত্র শান্তির ঠিকানা ছোট্ট বিছানাটায়।
আসতে আসতে ভাবে, ইশ! বাবাও হয়তো আজকে এমন করেই নারায়ঙ্গঞ্জের কোন এক গার্মেন্টস বিল্ডিং থেকেই সংসারের সারামাসের হিসেব নিকেশের অংকগুলি মেলাতে মেলাতে ফিরছেন বাসায়। মায়ের মরনরোগের চিকিৎসার পেছনে ছুটতে ছুটতে গ্রামের বাপদাদার ভিটে মাটি বন্ধক রেখে এখন তাদের বাসা খুঁজে নিতে হয়েছে নারায়ণগঞ্জের এক গার্মেন্টস এলাকায়। সপ্তাহ শেষে আকুল হয়ে ইমরান ছুটে যায় ছোট্ট ভাই বোন আর অসুস্থ মার কাছে।
সেখানে অপেক্ষা করছে প্রিয় মুখগুলো। আজকের সন্ধ্যাটা একটু বেশিই তাড়ায় আছে ইমরান। মেসের মালিক মোখলেস চাচার দেখা পাওয়া যাচ্ছেনা। সচরাচর সন্ধ্যার পরে গার্মেন্টসের পেছনের টং দোকানটায় বসে চায়ের কাপে ধর্ম,দেশ, বিদেশ, আওয়ামী লীগ-বিএনপির রাজনীতিতে তাঁর বেক্তিগত মতামত অভিমত সহ মধ্যপ্রাচ্চের তেল বেবসা আর আমেরিকার উপসাগরীয় যুদ্ধে লাভক্ষতি উদ্ধার করেন তিনি। দেশবিদেশ নিয়ে যতই সচেতন হোন না কেনো নিজের বাসার দেয়ালের ইট দুইটা খুইলা পড়ে গেলে, যদি কোন ভাড়াটিয়া উহা সবিস্তারে রিপোর্ট ও করে তবু সংস্কারে বড়ই উদাসীন মনে হয় তাকে। মাসের ভাড়া আদায়ের ক্ষেত্রে উনি আবার এতোটাই রক্ষনশীল যে, ৫ তারিখের মধ্যে ভাড়া দিতে না পারলে মহা ঝামেলা-ঝঞ্ঝাট শুরু করে দেন!
প্রতিদিনকার মত টং দোকানটায় কেনো, তার আশেপাশের চৌহদ্দিতেও লোকটার দেখা মিলল না। সকাল থেকেই গার্মেন্টস এলাকা গরম। কর্মীদের পাওনা বেতন না দিয়ে গার্মেন্টস মালিক পুলিশ ডেকে গার্মেন্টস পাহারা দিচ্ছে। কিন্তু, কতক্ষণ শ্রমিকদের ক্ষোভ ঠেকিয়ে রাখতে পারবে হাতে গনা কজন পুলিশ, ইমরানের সন্দেহ আছে যথেষ্ঠই! সকালে ক্যাম্পাসে যাওয়ার সময় একদফা মাইক্রো দাঙ্গা ডিঙিয়ে যেতে হয়েছে। পরে আরো কদফা হয়েছে, সে জানেনা। আজকে মেসে ফিরল একটু তাড়াহুড়ো করেই। এসে দেখে, বেস্ত এলাকা শুনসান প্রায়-তবে ঝরের পূর্ব মুহূর্তের নিরবতাটা ধরতে পারলো একটু পরেই! এসে দেখে মেসে ইয়া বড় এক চায়নিজ তালা ঝুলছে!
মোখলেস মিয়া আর তার ছেলেপেলের কারো কোন হদিস নাই আশেপাশে। আজকে বাড়ি ফিরবে করেই এত হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এসেছে। সপ্তাখানেকের ছুটি মিলেছে, বেতনটাও আজকেই পেল, তাই ইচ্ছা ছিল একেবারে মেসের বিলটা দিয়েই ছুটবে।
কিন্তু, সে সুযোগটা বোধহয় আর পাওয়া যাচ্ছেনা। কারণ, আক্কাস আলীর টং দোকানের পিচ্চিটা কোথেকে যেন ছুটে এসে বলতে লাগলো, "ভাইজান, মোখলেস মিয়ারে পুলিশে ধইরা লইয়া গেসেগা দুপুর বেলা, তার পোলাগরেও। কখন কারে লইয়া যায় ঠিক নাই, আপনে বাড়িত যানগা এইদিকে আর আইয়েন না তিনদিনের মইধ্যে! দুপুরে দুই বার মাইরপিট হইসে, পুলিশের লগে পাবলিকের। পুলিশ যারে ইচ্ছা ধরতাসে। আপনে ভাগেন জলদি!"
বিপদই হইলো দেখা যায়। কাপড় চোপড়্গুলি আর বোধহয় নেওয়া গেলনা,ভাড়াটাও দেওয়া হলো না, আবার ফিরে এসে না কোন কথা শোনা লাগে! -ভাবতে ভাবতে দ্রুত পায়ে রওনা হয়ে গেল ইমরান বাড়ির পথে। যাত্রাবাড়ি একটা মিষ্টির দোকানের সামনে দাঁড়ালো। ভাইটার জন্মদিন ছিল আজকে-তার মনেও নেই! খালি হাতে যাওয়াটা একেবারেই অসম্ভব!
বাসার কাছাকাছি এসে আরেকবার থমকে দাঁড়াতে হলো! -একি! বাসার সামনে পুলিশ কেনো!?
যতই ভিড় ঠেলে এগুচ্ছে, ততই কেনো যেন বুকের ভেতরে হৃৎপিণ্ডটার হাপড়ের মত ওঠানামা স্পষ্ট থেকে স্পষ্টতর হয়ে এলো। কেনো যেন, গলাটা কাঠের মত খশখশে ঠেকছে, বুঝতে পারছেনা! ভিড় ঠেলেঠুলে একটা রাস্তা করে মোটামুটি গায়ের জোরেই গিয়ে সামনে দাঁড়িয়ে পড়ল!
হুম, দাঁড়িয়েই রইলো, নড়তে পারছেনা, চোখের পাতাও ফেলতে পারছেনা! সামনের দৃশ্যটা তা ফেলতে দিচ্ছেনা! হাত থেকে খিসে পড়ে গেল দেড় কেজি ওজনের মিষ্টির প্যাকেটটা।
গলা চিড়ে অজান্তে বেরিয়ে এলো ভাঙা কাপাকাপা একটা আর্তনাদ......বাবা...!!
পুলিশ প্রহরায় একটা বেঞ্চে শুইয়ে রাখা হয়েছে তার দিন-দুনিয়ার একমাত্র ছায়া আর ভালোবাসা _ বাবার প্রাণহীন দেহটা!
কেউ একজন এগিয়ে এসে বলতে লাগলো তার কানেকানে, আপনি ইমরান? আপনার বাবা গার্মেন্টস মালিকের অন্যায় জোরাজুরি আর গালাগালির প্রতিবাদ করতে গিয়ে খুন হয়েছেন। আমরা লাশ ময়নাতদন্তের জন্য নিয়ে যাচ্ছি, আপনাকে একটু আসতে হবে আমাদের সাথে।
তার কানে তখন কিছুই ঢুকছেনা...শুধু একটা অদম্য আক্রোশ অস্ফুট যন্ত্রণার ভীষণ আঘাতে পিষ্ঠ হয়ে চোখের ঝাপসা নোনাজলে মিশে বুকভারি অস্ফুট কান্নার রেশে মিলিয়ে যেতে লাগলো দূর আকাশে ওই চির অপমানিত,চির নির্যাতিত, চির বঞ্চিত কোনটায়......