রাত ১ টা পঁচিশ । আজমল সাহেব চেয়ারে হেলান দিলেন ।
ক্লান্ত লাগছে তার । সেই সাথে বিরক্তও । বিরক্তির কারনটা ঠিক আঙ্গুল দিয়ে দেখানো যাবেনা । কয়েকটা হতে পারে । সেগুলো এই মুহূর্তে পয়েন্ট আউট করাটা ঠিক প্রয়োজন মনে করছেন না ।
দিনগুলি ক্রমান্বয়ে বর্ণহীন থেকে আরও বর্ণহীন হয়ে যাচ্ছে । আর জীবনটাও যেন এই পর্যায়ে এসে সব পথ ভুলে গেছে, হয়ে গেছে ছন্নছাড়া ।
অবশ্য বয়স তো কম হল না । এমনিতেও প্রথম যৌবনে যে খুব প্রাণোচ্ছল ছিলেন, কিংবা উচ্ছাসোদ্দিপ্ত সময় কাটিয়েছেন তাও নয় । প্রেম জিনিসটার রসাল সাক্ষাৎ হয়ত একবার পেয়েওছিলেন , কিন্তু তিক্ততায় ছিল তার পরিনতি । সে থেকে অনেক কিছু শিখে নিয়েছিলেন, লিখেও নিয়েছিলেন বেশ কিছু কপালে । নিয়তি যেমন তাকে আনন্দের ঝলক দেখিয়েছিল শুধু এক পলক আর তারপর কেড়ে নিয়েছিল, অপেক্ষা করেনি দু-দন্ড, তিনিও তেমনি আর ফিরে তাকাননি, কারও জন্য অপেক্ষাও করেননি । চলার পথে খুঁজে নিয়েছেন কাউকে, বেঁধে নিয়েছিলেন জীবনের সাথে ।
আর তারপর? তারপর দিনগুলো কেটে গেছে একে একে, জীবন চলেছে আপন নিয়মে । ছেলেমেয়ে গুলোকে মানুষ করেছেন, তারা এখন নিজ নিজ জায়গায় প্রতিষ্ঠিত । যদিও কেউ আর কাছে নেই এখন । নিজের একাকিত্বের সঙ্গি হিসেবে সেই প্রথম যৌবনে খাপছাড়াভাবে যে জিনিসটাকে বেছে নিয়েছিলেন শুধু সেই জিনিসটাই রয়ে গেছে, রয়ে গেছে নিরব সঙ্গি হয়ে –লেখালেখি ।
তবে এতো যে লিখেছেন, সব শুধু লোক চোক্ষুর আড়ালেই রয়ে গেছে , কেউ পড়েনি, এমনকি কোন প্রকাশনার উজ্জ্বল মোড়কে নিজেকে আবৃতও করেনি । একবার প্রথমদিকে এক স্বনামধন্য প্রকাশকের কাছে গিয়েওছিলেন ।
কিন্তু, যে তিক্ত অভিজ্ঞতা আর তাচ্ছিল্যের স্বীকার হয়েছিলেন তা মন থেকে মুছে যায় নি । ফলে পাবলিসিটির ধারেকাছে ঘেসেননি কোনওদিন । তিনি দেখেছেন, কি ধরনের জিনিস পাবলিক গোগ্রাসে গিলে খায় । তার কাছে ওসব সস্তাই মনে হয়েছে আজীবন । সস্তা পপুলারিটি না হলেও চলে ।
কিন্তু যে জিনিসটা একজন লেখকের কাছে সবচেয়ে বড় আনন্দের তা হল কেউ যদি তার লেখা পড়ে মনের আনন্দে, পড়ে উচ্ছসিত হয় । এর চেয়ে বড় পাওয়া হয়ত আর হতে পারে না লেখক জীবনে । কিন্তু আজমল সাহেব মনে করেন সত্তিকারের লেখক তারাই যারা মানুষের জন্য না, লেখে নিজের জন্য । নিজের মনের খুশির জন্য । লেখার মধ্যেই তারা ভেসে বেড়ান এক আনন্দলোক থেকে অন্য আনন্দলোকে , এক বাগান থেকে আরেক বাগানে । ওসবে পাবলিসিটি না হলেও চলে ।
আজমল সাহেব এখন যে লেখাটা লিখবেন সেটা উঁচুদরের পাবলিসিটি পাওয়া এক পপুলার লেখককে নিয়ে ।
তিনি তার নাম দিলেন – মাজহার ।
লেখাটা নিয়ে ৪-৫ দিন থেকে ভাবছেন । কিন্তু ঠিক স্থির করে উঠতে পারছেন না ।
জীবনে এত এত লেখা লিখেছেন কিন্তু কখনো এমন দ্বন্দে ভুগতে হয়নি । কিছুতেই দাড়া করতে পারছেন না কিছু । কিন্তু মনের ভেতর থেকে কে যেন প্রবল ভাবে ঝাকাচ্ছে, লেখ আজমল লেখ, এই লেখাটা যে তোমাকে লিখতেই হবে । এটাই তোমার শ্রেষ্ঠ লেখা । আর এই লিখাটাই সবচেয়ে বেশি পাবলিসিটি পাবে । তুমি চলে যাবার পরও লেখাটা পড়বে হাজারো মানুষ । আর এই লেখাটার হাত ধরেই তোমার সবগুলো লুকানো লেখা হাজারো মানুষের মনে ঢেউ তুলবে এবং লিখাটা যে তোমায় লিখতেই হবে ।
শেষ লিখা কিনা তিনি জানেন না । তবে লিখাটা তাকে ভোগাচ্ছে , শেষ করার জন্য অস্থির করে তুলছে , স্বস্তি দিচ্ছে না এক মুহূর্ত । কিন্তু বড় সমস্যা হচ্ছে তার চিন্তায় কিছুই আসছে না ।
তিনি টেবিল ছেড়ে উঠলেন , স্টাডির পাশের বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালেন । পাঁচতলার বারান্দা ।
সামনের অনেকটা দেখা যায় । শহরের কোলাহল স্তিমিত হয়ে এসেছে প্রায় ।
সামনের রাস্তাটা প্রায় ফাঁকা দুতিনটা কনফেকশনারি আর একটা ওষুধের ডিস্পেন্সনারী খোলা ।
আকাশে একফালি চাঁদ , ঝিরিঝিরি বাতাস বইছে ।
ডানদিকের বাসাটায় তাকালেন, বাসাটা অন্ধকার । শুধু পাঁচতলায় ওই জানলাটায় আলো দেখা যাচ্ছে । টেবিলে বসে কিছু লিখছেন তারই বয়সি এক লোক ।
আজমল সাহেব মুচকি হাসলেন আপনমনে । ওইতো বসে তার শেষ লেখাটার নায়ক । কি যেন একটা ধাক্কা দিয়ে গেল বুকে । অদ্ভুত একটা অনুভুতি হচ্ছে ।
আকাশে হেলে থাকা অর্থহীন হলুদ চাঁদটার দিকে একবার তাকালেন । সঙ্গে সঙ্গে একটা জিনিস স্পষ্ট হয়ে গেল, ওই জানালাতেই আছে তার অস্বস্তির সমাধান আপাতত । এখন তার নায়ক চরিত্রটির সাথে বসে দুকাপ চা না খেলেই নয় । ওনেক কথা বলার আছে, সেই সাথে কিছু প্রশ্ন । আর ওগুলোর উপরই নর্ভর করছে তার জীবনের শেষ শিল্পটা । নাহ! নক করতেই হচ্ছে । কেন আগে মাথায় আসেনি ?!
::::::::::::::::::::::::::: ___ :::::::::::::::::::::::::::
মাজহার সাহেব ঘড়ির দিকে তাকালেন । ৪.৪৫ / অসম্ভব! হাতঘড়িটা দেখলেন, ১ টা ৩০ ! ওহ! দেয়ালের ঘড়িটার ব্যাটারি শেষ মনে হয়
গতকালকে থেকেই ৪.৪৫ দেখছেন । বারবার ভুলে যান ।
কালকে কাজের ছেলেটাকে বলতে হবে । এতোক্ষনে বোধহয় ঘুমিয়ে পড়েছে বেচারা । একসপ্তাহ হয়ে গেল তিনি আর ছেলেটা ছাড়া বাসায় কেউ নেই।
একমাত্র ছেলেটা বৌ আর মেয়েদুটোকে নিয়ে শ্বশুড় বাড়ি গেছে ঈদ করতে । সাধাসধি করেছিল যাবার জন্য , যাননি তিনি । এটা ওটার ছুতোয় রয়ে গেছেন । উদ্দেশ্য মূলত হাতের লেখাটা শেষ করা । আর এমনিতেও ছেলের শ্বশুড় বাড়ির লোকজন গুলোকে তিনি যথা সম্ভব এড়িয়ে চলেন ।
তারচেয়ে এই কদিনে ঠান্ডা মাথায় শেষ লেখাটা নিয়ে চিন্তা করা গেছে – এটাই বরং ভাল হয়েছে । শেষ লেখা কিনা উনি নিশ্চিত না এখনো । কারন এমন একটা পর্যায়ে এসেছেন, যে লেখা থামানোটা একটা বিপদই বলা যায় । লেখার কাছে যেন তিনি দ্বায়বদ্ধ । উনি যেন একটা প্রিন্টিং মেশিন । রিবন-কালি শেষ মাত্রই হাজারো কাস্টমার দোকান ত্যাগ করবে আর সবরকমের ব্যাবসাপাতিও লাটে উঠবে ।
তবে বাস্তব এই যে, তিনি আর বিক্রি হচ্ছেননা । অনেকতো হল, পপুলারিটি আর মিডিয়া কাভারেজ থেকে এবার একটু দূরে থাকতে চান , অন্তত কয়েকটা দিন শুধুই নিজেকে নিয়ে কাটাতে চান , একবার ঠিক করলেন যে গ্রামে যাবেন , বাবার কবরটাও ঘুরে আসা যাবে, আর কয়েকদিন সব জঞ্জাল থেকে মুক্ত হয়ে প্রকৃতির মাঝেও থেকে নির্মল হাওয়ায় দূষিত হয়ে যাওয়া মনটাও রিফ্রেশ করে নেয়া যাবে ।
এইমাত্র যে লেখাটা শেষ করলেন সেটা তার মতে জীবনের শ্রেষ্ঠ লেখা । কারন এতে তিনি বিগত কয়েক দিন যাবত যেভাবে স্বাধীন মনে মনের রূপালী আকাশে উড়ে বেড়িয়েছেন সেই সদ্য যৌবনের উদ্দাম উচ্ছলতা নিয়ে , যেভাবে একের পর এক চোখের সামনে ভেসে উঠেছে পার করে আসা রূপালী স্মৃতিগুলো সব, তেমনটা তার লেখক জীবনে আর কোন লেখায় হয় নি । আর এই মধুমাখা লেখাটাই তবে হোক না, আপাতত শেষ ......... ।
মাজহার সাহেব তার সহস্র পাঠক হৃদয়ে রক্ত আর আনন্দের ফল্গুধারা ঝড়ানো কলমটা এবার বন্ধ করলেন ।
হ্যাঁ, এবার তবে একটু নিজেকে খুশি করা যাক । সময় এসেছে......
আপাতত দুধ ছাড়া এককাপ কড়া কফি হলে ভাল হয় । এই রাতে ওকাজটা করে দেবার মত যেহেতু আর কেউ অবশিষ্ট নেই, মাজহার সাহেব তাই চেয়ার ছাড়লেন ।
...... এবং কলিংবেল ......
এতো রাতে কে আসতে পারে ? !!
প্রথম কয়েক সেকেন্ড কিছুই মাথায় আসলো না । পা বাড়াতে যাবেন – বিদ্যুৎ চমকের মত একটা কথা মাথায় খেলে গেল, অমনি স্তব্ধ হয়ে গেলেন । কপালে ঘাম জমে উঠতে লাগল, চোখদুটো বিস্ফোরিত । ও কি আসবে, ওটা কি সত্যিই হতে পারে... ! নাহ, ধ্যাৎ কি যে ভাবছি ? সে কিভাবে আমার বাসা পর্যন্ত পৌঁছে ?? অসম্ভব ! সে যত বড় আদমই হোক এ পর্যন্ত পৌঁছতে পারবে না । তাহলে, এমন লাগছে কেন !?!
মাজহার সাহেব জীবনে কাউকে ভয় পেয়েছেন বলে উনার মন পড়ে না । কিন্তু এখন এ মুহূর্তে কেন অমন লাগছে ? কেমন যেন ঠান্ডা একটা শিরশিরে শীতল ভয়ের স্রোত বয়ে যাচ্ছে মেরুদন্ড বেয়ে । মনে হচ্ছে যেন দরজার ওপারে যে আছে সে আর কেউ নয়, আজরাঈল এবং আজকের রাতটাই তার জীবনের শেষ রাত হতে চলেছে ।
আবার বাজলো কলিংবেল, একবার, দুবার ... তিনবার......
ধ্যাৎ!! আসলে একটানা এক জিনিস চিন্তা করে মাথাটা ভোঁতা হয়ে গেছে । ওই তস্কর সে যত ভয়ানক ই হোক কোনওদিনই আমাকে ধরতে পারবে না । তাহলে কে হতে পারে ?
মনের একটা অংশ থেকে কে যেন বলে উঠল, ভুলেও যাসনে, ভুলেও না পা বাড়াসনে যদি বাঁচতে চাস ।
আরেকটা অংশ জোড়ালো ভাবে ধমকে উঠল তাকে , ওরে মাথামোটা ছাগল, তুই যার ভয় করছিস সে অনেক আগেই দেশছাড়া হয়েছে, হারিয়েও ফেলেছে তোকে, হারিয়েছে সব ঘটনার সমস্ত চিহ্ন, আর এতোদিন পর এত এত ছদ্মবেশের মাঝে থেকে সে কেন , তোকে স্রেফ আজরাঈলও বের করতে পারবে না ।
যদিওবা সে বেচে ফিরে আসে, তুই নিজেও পারবিনা তাকে চিনতে । আগেতো দরজাটা খোল, নির্ভীক প্রত্যয়ী নামকরা লেখক মাজহার হাবীব কি দমে গেলেন সামান্য কলিং বেলের আওয়াজে ??
সত্যিই তো ! কি যা তা ভাবছি? যে কেউ আসতে পারে ...
মাজহার সাহেব দরজার লুকিং হোলে চোখ রাখলেন । সঙ্গে সঙ্গে নিজেকে বেকুব মনে হল । ঝট করে খুলে দিলেন দরজা ।
-আরে, আজমল সাহেব যে, এতো রাতে? কি মনে করে?? আসুন আসুন ভিতরে আসুন । আমি আরো কি না কি ভাবলাম ।
-ঘুম আসছিল না । দেখি আমার প্রতিবেশিও সজাগ । ভাবলাম সঙ্গ দিয়ে যাই, এককাপ কফিও হয়ে যাবে সাথে , হা হা...
আরে ওভাবে ঘামছিলেন কেন ? চোর ডাকাত ভাবছিলেন নাকি ?
-আরে নাহ কি যে বলেন । তবে বেশ কয়েকদিন যাবৎ নির্জনবাস করছি তো, শব্দ হলেই চমকে উঠি , মনে হয় এই বুঝি কেউ আসলো ঘাড়ের পেছনটা টিপে ধরবে ... হাহ হা হা ।
-বটে! খারাপ লক্ষন ! এরকম চললে বোধহয় আজরাঈলের স্বাক্ষাৎ পেতে দেরি হবে না , প্যারাসিটামল দরকার ।
-কি যে বলেন না মশাই । ওতে কি আর চলে বডি কেমিস্ট্রি চেঞ্জ হয়েছে না? এখন এন্টিবায়োটিক দরকার । বয়েস তো আর অম হল না ।
-বটে! তা নিচ্ছেন না কেন? আমি তো শুরু করে দিয়েছি ।
-তাই? ইন্টারেস্টিং ! শোনা দরকার । দাড়ান কফি নিয়ে আসি । কফি ছাড়া ভাল্লাগবে না ।
-হুউম! স্টাডিতে বসি । হাজার হোক নামি লেখকের স্টাডি ! কজন বা পায় বলেন? / লিখছিলেন বুঝি ?
- কি যে বলেন... হুম শেষ একটা লেখা । সম্পূর্ণ মন থেকে নেয়া হাবিজাবি । তবে এটা কেউ পড়বে না বোধহয় /
- তাই? তাহলে ত আমি আগে পড়ব । যাই বসে যাই । আহা! মাজহার সাহেবের চেয়ারে বসে তার সম্পূর্ণ মন থেকে নেয়া শেষ লেখাটা পড়ছি – ভাবেই চোখে পানি আসছে ।।
-হা হা হা! দুঃখের বিষয় যে মশাই কফিতে তেল দরকার নেই, থাকলে আমি বাসার তেলের বোতল খালি করতে যেতাম না । আপনার কথাই যথেষ্ঠ ছিল । /
-আহাহা সাহেব তেল বলে উড়ালেন ? জানেন এই সৌভাগ্য পেলে আপনার কত ভক্ত তাদের অরগাজম মিস করে বসত ?
-হয়েছে হয়েছে! পড়া শুরু করেন, আমি কফি নিয়ে আসছি ......
-আম অনারড ব্রো !...... //
:::::::::::::::::::::::::: রাত ৩টা ৩৫ ::::::::::::::::::::::::::
আজমল সাহেবে নিজের চেয়ারে বসলেন । কয়েক ঘন্টা আগে ফেলে রেখে যাওয়া লেখাটা শুরু করলেন নতুন উদ্দমে । মনটা তার অদ্ভুত আনন্দে ভরে আছে । ফুরফুরে এমন মেজাজ বুঝি তিনি বহুদিন যাবত মিস করছেন । কলমটা হাতে নিতেই আবারো পুলকিত বোধ করলেন । একটু আগের অথর্ব বধির কলমটা যেন আর থামতেই চাইছে না । একের পর এক কথা বলে যাচ্ছে । আর ওতে মিশে আছে পৈশাচিক একটা বহুকাল না পাওয়া আনন্দ । কিছুক্ষনের মধ্যেই হয়তো শেষ হয়ে যাবে লেখাটা , আর ওতে মিশে থাকবে তাজা রক্তের বুনো সুবাস !!
:::::::::::::::::::::::::: রাত ৪ টা ৫৩ ::::::::::::::::::::::::::::
ওই রাতের মত তৃতীয়বার খুলে গেল মাজহার সাহেবের বাসার দরজা । তবে এবার আর কেউ বেল চাপল না, কেউ খুলে দিতে এগিয়েও এলো না !
ঘরে পা রাখলো ভারী একজোড়া বুট । ধীর পায়ে হেঁটে মাজহার সাহেবের স্টাডি পর্যন্ত পৌঁছল প্রায় পা পর্যন্ত লম্বা জ্যাকেট পরা একটা ছায়া । মুখ দেখা যাচ্ছে না তার, ঢেকে আছে চওড়া কাউবয় হ্যাটে – যেন কোন ওয়েষ্টার্ণ কিলার আউট-ল ।
সে স্টাডিতে ঢুকে দুটো জিনিস খুঁজলো, তার মধ্যে একটা টেবিলের উপরই থাকার কথা এবং সে জানে তা আছেও ।
-কিন্তু পেল না । তারপর সে পা বাড়ালো মাজহার সাহেবের প্রাইভেট বেডরুমের দিকে,
এবং যে জিনিসটা মরনেও চিন্তায় আনতে পারত না সেটাই দেখতে হল ... বিছানায় পড়ে আছে একটা লাশ, একদম তাজা এবং -সেটা মাজহার সাহেবের লাশ !!!
এমনভাবে আধশোয়া হয়ে পড়ে আছে যেন তিনি চিরায়ত রাজকীয় ভঙ্গিতে প্রিয় বইটা পড়ছেন ।
হাতে বইয়ের স্থলে একটা ডায়েরী । আগন্তুক ডায়েরীটা হাতে নিল । তাতে দুটো চরন লেখা...
// “মনে রেখ হে সুহৃদ, পাপ তা সে যতই ছোট হোক প্রায়শ্চিত্ত যে হবেই একদিন
মাঝের যত অর্জন লীলা, সুখ পিয়াসা আর কামনার যাতনা অলীক কল্পলোকে লুকোবে সেদিন ।।
ছলনা দিয়ে করেছিলে যাদের ভক্ত আপনজন, কজন রয়েছে ছায়া হয়ে তব অমর বিহ্বল?
সেই কাঁদিছে, প্রেমডোরে যারে বাঁধিয়াছিলে একদা ভুলে- হয়ে অক্লান্ত অচঞ্চল
যাও হে! সে যে ডাকিছে তোমায় আজ সময় যে হল বলে” //
জীবনে কোনকিছু আগন্তুককে কখনো এতটা বিষ্মিত হয়নি যা আজ এ মুহূর্তে মাজহার সাহেবের বেডরুমে দাঁড়িয়ে তাকে হতে হয়েছে । যদিও বা ওই চরনগুলোর কোন তাৎপর্য সে ধরতে পারেনি তবুও একটা জিনিস সে মন থেকে বলতে পারে যে, যেই হোক এই খুনি বা হন্তা সে যে খুব বড় মাপের শিল্পী তাতে কোন সন্দেহ নেই ।
হয়তোবা এমন কিছু বোঝাতে ছেয়েছে যা সে জানেনা কিংবা কোনও দিন জানবে না ।
কিন্তু, সে আশ্চর্য হচ্ছে যে , যে কাজটা তার করার কথা এখন এই মুহূর্তে, ঠিক সে কাজটাই কেউ একজন করে গেছে মুহূর্তের ব্যবধানে ।
যে লোকটার জন্য আর যে তিনটে ডকুমেন্টের হন্যে হয়ে এতগুলো বছর হেন জায়গা নেই দুনিয়ায় যা সে চষে বেড়ায় নি, যার প্রথমটা পেতে তাকে মাড়াতে হয়েছে ইসরাঈলী সিক্রেট এজেন্টদের ছায়া পর্যন্ত, আজ সেই লোকটা আর সেই অবশিষ্ট প্রশ্নগুলো হাতের মুঠোয় এসেও কেবল ক্ষনিকের ব্যবধানে হয়ে গেল হাতছাড়া ।
নাহ! হিসেব মিলছেনা । এমনটা তো হবার কথা ছিল না !
অস্বস্তি গ্রাস করছে আগন্তুক কে । সেই সাথে ভয় ।
জীবনে কখনো ভয় সে পায় নি । কিন্তু , এমুহূর্তে পাচ্ছে ।
না মেলা অংকগুলো আর খাপছাড়া হয়ে যাওয়া সুতোগুলো ওই চরন গুলোয় আছে ভেবে স্ট্রেঞ্জার তার সুপার সার্প মেমরিতে ওগুলো গেঁথে নিয়ে ঠিক যেমনিভাবে সে এসেছিল হাওয়ায় ভেসে ভেসে ছায়া হয়ে, তেমনিভাবে হারিয়ে গেল । কেউ দেখলো না, আর হয়তো দেখতে পাবেও না কোনও দিন এদেশের মাটিতে তাকে ।
ঠিক একই সাথে আজমল সাহেব তার জীবনের সর্বশেষ লিখাটার শেষ লাইনটা লিখলেন । আর তাতে জুড়ে দিলেন,
“আমি জানি এই লেখাটা তোরা খাবি । বৃথা যাবে না এটা, যেতে পারে না । কারন, এতে মিশে আছে অনন্য সফল এক লেখকের তাজা রক্ত ,যিনি রঙ তুলির সামান্য আঁচড়ে রক্ত ঝড়াতেন, অশ্রু ঝড়াতেন , হাসাতেন , কাঁদাতেন লাখো হৃদয়কে । আর সেই সাথে মিশে আছে তাঁরই গুণমুগ্ধ তারই সৃজনশীল প্রানের নির্যাসে সিক্ত তাঁরই এক নাম না জানা প্রানের সারথি , যাকে তিনি ক্ষনিকের ভুলে হারাতে বসেছিলেন তার জীবন সঞ্চিত প্রানরস । আজ তারা পরষ্পরকে খুজে পেয়েছেন পূনরায় । খুজে পেয়েছেন অন্য কোন রূপে অন্য কোন লোকে, তাদের এ মিলনে আজ আর থাকবে না কোন দির্ঘশ্বাস থাকবেনা কোন পিছুটান ...... ।
আজ ওই পবিত্রলোকে আর তাদের তাড়া করবেনা কোন মিথ্যে ছলনা অতএব, বিদায় হে ‘দুধের মাছিগণ’ , বিদায়......” //
তারপর আজমল সাহেব গরম ছুরির রক্তিম ফলাটা থেকে দুফোঁটা রক্ত লেপে দিলেন লেখাটার ডান কোনায় ।
আর তারপর? তারপর ওই একই রাতে একই ছোরার ফলায় মিশে একাকার হল আরো এক নাম না জানা লেখকের রক্ত ।
- হয়তো পবিত্র কোন লোকে পাপমুক্ত দুটি আত্নার কোন অনন্য মিলনের অভিপ্রায়ে ......... ///