আমাদের দেশে বর্তমানে যে ভর্তি পরীক্ষা পদ্ধতি প্রচলিত, তাকে অবশ্যই একজন ছাত্রের মেধা যাচাইয়ের কার্যকরি পরীক্ষা বলতে হবে, কিন্তু প্রসেসে সামান্য গলধটুকু যদি না থাকত তবে আগাগোড়াই নির্ভরযোগ্য, স্বচ্ছ ও সাধুবাদপ্রাপ্য বলা যেত।
তাহলে এবার দেখি কি কি ধরনের গলধ এখনও প্রসেসটাকে সম্পুর্ণ হতে দিচ্ছে না,
একজন ছাত্র ২ বছর লেখাপড়া করার পর যখন, কাঙ্খিত, ইপ্সিত উচ্চশিক্ষার অবারিত দুয়ার উন্মোচন করতে যায় নিজ স্ব্প্নের সাইটটিতে, তখন তাকে সর্বপ্রথম যে প্রশ্নটার উত্তর খুজতে হয় ,
"তুমি কি যোগ্য? তোমার মত কত কুটুম ই তো ইঞ্জিনিয়ার,ডাক্তার হতে চায় , কিন্তু জায়গাটা কোথায় তোমার জন্য?"
উত্তরটা যদি হত, "যে হ্যাঁ জায়গাটা আমার দেশেই, আমার দেশ আমার মেধাকে উন্মোচন করবে, আমার দেশই আমাকে জ্ঞানের অবারিত সাগরে সাতার কাটা শেখাবে, আমার দেশ ই আমাকে পরাবে আলোর মুকুট, বানাবে ডক্টর ।ইঞ্জিনিয়ার,কেন আমি বাবার পকেটের উপর নরক গুলজার চালাব?..."
তবে সত্তিই গর্ব হত যে আমার দেশ তার সব ব্রেইনগুলোকে কর্মক্ষম করছে ।
প্রচলিত গড্ডলিকায় ভেসে চলা পাবলিক পরীক্ষাগুলোর প্রশ্নপত্র এবং খাতা মূল্যায়নের তথা জাতির ভবিষ্যৎ কর্ণধার এবং সব আশা অভিলাসার প্রতিক ছাত্রসমাজকে মূল্যায়নের ভার যাদের হাতে ন্যস্ত থাকে আমাদের স্কুল কলেজ লেভেলে, তাদের ভূমিকা এখানে কততুকু - তা বলে গদ্য রচনা করবার প্রয়োজন মনে করছি না । তবে, তাহারা যে ভিত্তিটা গড়ে দেন একটা ছাত্রের ,তার মূল্যমাণ কি হওয়া উচিত ছিল আর কি হচ্ছে - প্রশ্ন থেকে যায় সেটাই !
আচ্ছা অতদূর নাহয় নাই যাই । শুধু বৃহত্তর পাবলিক পরীক্ষায় (মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিক এবং এক্ষণ গজিয়ে ওঠা জে এস সি, পি এস সি ইত্যাদি ইত্যাদি )
তাদের মূল্যায়নে যখন একটা ছাত্র দু চার নাম্বারের ব্যাবধানে কোন বিষয়ে জিপি এ ৫ মিস করে , তখনই সে হয়ে যায় খারাপ ছাত্র ! এবং ইঞ্জিনিয়ার , কিংবা ডাক্তার হবার ক্ষেত্রে অযোগ্য - এজন্য বলছি যে , তার সামনে দেশের সব বড় বড় ইঞ্জিনিয়ার কিংবা ডাক্তার বানাবার কারখানা গুলো তুলে ধরে জিপিএ এবং ভর্তি পরিক্ষায় ইলিজিবিলিটি সংক্রান্ত এতো এতো হাবিজাবি হিসেব কিতেব তুলে ধরে বলে ,
বাবা দেখ তুমি হয়তো ২ টি বছর বহু বই ঘেঁটেছ , শত শত অংক করেছ , সূত্র ঘেঁটেছ , লাইন বাই লাইন পড়েছ, ভালো কথা । কিন্তু , এইচ এস সি তে "এত পয়েন্ট এত" পাওনি বলে ইঞ্জিনিয়ার হওয়া ঠিক তোমাকে মানায় না !! পারলে বাপের টাকায় পড়োগে নইলে তোমার ভর্তি পরীক্ষা নেয়ার মত ফুসরত মোদের কই ??
বটে, রংগ বটে ! রসালো এই রঙ্গমঞ্চে আর কত ছেলেকে তার আজন্ম লালিত স্বপ্ন আর যোগ্যতা বলি দিতে হবে কে জানে !
ইংরেজি , বা বাংলার ২ -৩ টা নাম্বারের জন্য যদি একটা ছেলে বা মেয়ের মধ্যে প্রকৌশলের পটেনশিয়ালিটি খুঁজতে লজ্জা পায় দেশের শ্রেষ্ঠ বিদ্যাপিঠ গুলো তবে আর কিই বা আউট পুট আশা করা যায় সেখান থেকে ??
যে ছেলেটা ব্যাক বেঞ্চে বসে ক্লাস করে তার মাথায় যে শুধু গোবর এই থিউরি এ জাতি কোথায় আবিষ্কার করেছে আমার জানা নেই !
তবে একটা চরন মনে পড়ে এ মুহূর্তে আবছাভাবে , "ফ্রান্স ওয়াজ প্রোটেক্টেড বাই হার ব্যাক বেঞ্চারস !"
কিন্তু, এদেশে এটা কবে আশা করতে পারব আদৌ জানা নেই ।
যাই হোক, দেশের বাস্তবতায় তখন ছেলেটার উত্তর হয়ে যায় এরকম, আমি জায়গা করে নেব । নিতে যে হবেই আমাকে, হাজারজনকে সরিয়ে হলেও । আমাকে নিজেকে তৈরি করতে হবে এখন ।
এখানেই প্রশ্ন এসে যায় যে, "তাহলে ২ বছর কি করেছ? যদি এই ৩ মাস তুমি জানার জন্য পড় তবে তো্মার জন্য নির্ধয়ারিত ২ট বছর কিসের জন্য পরেছ, যে এখন তো্মার তৈরি হতে হবে??"
যাক, এবার আসা যাক তৈরি হওয়া প্রসঙ্গে,
ভর্তিযুদ্ধকে বিভিষিকা জ্ঞান করতে শেখা ছাত্রটির এবার প্রথমেই যে জিনিসটার মুখোমুখি হতে হয় তা হচ্ছে, কোচিং বাজিকরদের বাজিখেলা ।
এই বাজিকরেরা এতটাই সফল যে, তারা দেশের প্রতিটা শিক্ষার্থীকে বো্ঝাতে সক্ষম হয়েছে যে তাদের কাছে আছে সোনার কাঠি- রুপার কাঠি, আছে ম্যজিক ট্যাবলেট । একবার শুধু গিলবে আর সব উচ্চ বিদ্যাপিঠ তোমায় ডাকবে । বিনিময়ে কিছু নগদ-নারায়ণ লাগবে আরকি ।
এখানেই ২য় প্রশ্নটা আসে যে, কি শেখাল তার স্কুল কলেজ তাকে ১২ টি বছর? যে তাকে এখন বাজিকরকে নগদ নারায়ণ দিয়ে উচ্চশিক্ষার পিঠে যেতে হচ্ছে??
তো এই বাজিকরদের ম্যাজিক স্পেল শিখেও কি সবাই চান্স পায়?
আর কেউ যদি নগদ নারায়ন দিতে না পারে? তখন কি হঘটবে তার ভাগ্যে??
এমন কি হতে পারেনা,
যে এই নগদ নারায়ণ মানে ১৫-২০ হাজার টাকা দিয়ে এবং একগাদা ভার্সিটির ফর্ম ফিলাপ ও দেশের ৭-৮ টা প্রান্তে একযোগে তাকে নিয়ে দৌড়োবার মত আর্থিক সামর্থ তার সংসারে ওয়ি মুহূর্তে নেই । তখন কি ওই ছেলেটার জন্য দেশের বড় বড় বিদ্যাপিঠ বন্ধ হয়ে যাবে? তখন কি তার স্বপ্ন গুলো মরিচিকা হয়ে যাবে? মেডিকেল । ইঞ্জিনিয়া্রিং কিংবা ভার্সিটির ল্যাব কি তার জন্য নাজায়েজ হয়ে যাবে?
যদি হওয়াটা অনুচিত হয় তবে, সর্বপ্রথম যেসব গলধের প্রসঙ্গ আসে তার একটা হচ্ছে ৮-১০ টা জেলায় উপস্থিত হয়ে ৮-১০ টা পরীক্ষায় অংশ নেয়া । এতে যে কতখানি ভোগান্তি আর খরচ অভিভাবকের পফাতে হয় তার হিসাব ভুক্তভোগি বোঝে ।
যদি সব পরীক্ষাগুলোকে কয়েকটা ইউনিটে ভাগ করা জায় যে ইঞ্জিনিয়ারিং, ভার্সিটি, মেডিকেল তবে কি খুব ঝামেলা হয়?
একটি ইউনিটের সবগুলো বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষা একযোগে হবে, এবং দেশের সব প্রান্তে একিসাথে । প্রশ্নপত্র ও উত্তরমূল্যায়নের জন্য নির্ধারিত ইউনিটের সব ভার্সিটির বাছাইকৃ্ত টিম থাকব । এবং মেধাক্রম ও চয়েজ অনুসারে ভার্সিটি বাছাই হবে ।
তবে মেডিকেল এরি মধ্যে এর অনেকটাই কাছাকাছি করতে পেরেছে । তবে ওতেও যথেষ্ঠ ঘাপলা আছে- যা স্বচ্ছ না ।
সবচেয়ে বড় প্রশ্ন যেটা, ভর্তি পরীক্ষার জন্য ছাত্ররা কেন কোচিংয়ের কাছে জিম্মি হবে???
পরীক্ষাটাকি পাবলিক মানে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার পর পর হতে পারে না? মেধা যাচাই ই যদি উদ্দেশ্য হয় , তবে অতিরিক্ত ৩ মাস কেন? এই তিন মাসকে কাজে লাগিয়ে কোচিং ব্যবসায়ী্রা ছাত্রছাত্রিদের নিয়ে যে ব্যবসাটা করে তা কি নজরে আসেনা?
মেধাযাচাইয়ের, পড়াশুনা যাচাইয়ের জন্য যদি এই অতিরিক্ত সময় আর ফরমালিটিই লাগে, তবে হাম্বা টাইপ গ্রেডিংয়ের পাবলিক/বোর্ড পরীক্ষাটি কি যাচাইয়ের জন্য??
অবশ্য এর উত্তর কারো অজানা নয় । আমাদের দেশের এইসব পাবলিক পরীক্ষার দৌড় সবাই জানে । সেজন্যই যদি পাবলিক পরীক্ষাকে ঠিক করা না যায় তবে অন্তত ভর্তি পরীক্ষার উপর এর গরু গাধা টাইপ গ্রেডিং এর প্রভাব কমানো উচিত ।
ভর্তি পরীক্ষার আরেকটা গলধ হচ্ছে, 2nd time পরীক্ষার মধ্যে । একি প্রশ্ন পত্রে একটা ছেলে ৩ আর একটা ছেলে ১-দেড় বছর পড়ে পরীক্ষা দিচ্ছে । একি মেরিট লিস্টে নাম আসছে/ এটাকি আদৌ সঠিক মূল্যায়ন?? এতে প্রথমবার অনেক ভাল ছাত্র পিছিয়ে যাচ্ছে ।
এছাড়া আমাদের দেশের বর্তমানের বেশিরভাগ ভর্তি পরীক্ষাই হয় MCQ পদ্ধতিতে, যাতে ছাত্ররা শর্টকাট মুখি হয়ে পড়ে, অথচ আগে দরকার মূল বেসিক কনসেপ্ট টেস্ট করা । তাই written ও MCQ উভয় পদ্ধতিরই বেলেন্সড সমন্বয় থাকা উচিত প্রশ্নে যা বুয়েট ও রুয়েটে আছে ।
আরও কিছু ছোটখাটো ব্যাপার রয়ে গেছে যেগুলোও না শুধরালেই নয় ।
ভর্তি পরীক্ষা অবশ্যই মেধা যাচাইয়ের একটি আদর্শ পরীক্ষা/ কিন্তু উহাকে মেধার মানদন্ডে তখনই আদর্শ বলব, যখন এই গলধ গুলো সম্পূর্ণরূপে শুধরানো সম্ভব হবে......