আমাদের শিক্ষ্যাব্যবস্থা, আমাদের সমাজ, আমাদের কর্মক্ষেত্র সবকিছুই এমন ভাবে গড়ে তোলা, যেখানে বহির্মূখী স্বভাবের মানুষদের জয়জয়াকার। স্কুলের ক্লাসে সেই শিক্ষার্থীটিই শিক্ষকের মনোযোগ আকর্ষণ করতে পারে যে চটপটে, মিশুক, চঞ্চল, প্রাণবন্ত। শিক্ষকের কথার সাথে সাথে তাল মিলিয়ে পরের কথাটি বলতে পারে। কিন্তু প্রশ্ন হল, যে ছাত্রটি শিক্ষকের কথার সাথে তাল মিলিয়ে কথা বলতে পারে না, সে কি প্রাণহীন, নাকি কম বুদ্ধিসম্পন্ন? তার প্রতি বিমুখ কেন হবে শিক্ষক? কেন খাতায় নম্বর দিতে গিয়ে প্রিয় ছাত্রটিকে কিঞ্চিত বেশী আর শান্ত চুপচাপ ছাত্রটি কিঞ্চিত কম দেবেন শিক্ষক? এইসব কেনর উত্তর সেই শিক্ষকের কাছে নেই, তিনি নিজে যখন ছাত্র ছিল, তখন তার শিক্ষকের মাঝে দেখেছে এমনটাই, এটাই দেখেছে তার সহকর্মীদের মাঝেও। এর চেয়ে ভিন্ন কিছু হতে পারে, তা মনেই করেন না তারা সাধারণত। মাঝে মাঝে দুয়েকবার চমকে ওঠেন শান্ত চুপচাপ শিক্ষার্থীটির খাতা দেখে। আমি যখন স্কুলে পড়তাম ক্লাস নাইনে তখন একটি পরীক্ষায় সর্বোচ্চ নম্বর পাওয়ার পর ঐ বিষয়ের শিক্ষক আমাকে আমার খাতা হাতে দিয়ে বলেছিলেন, তুমি কি অবাক হয়েছ তোমার নম্বর দেখে? আমি শান্তভাবেই বলেছিলাম স্যারকে, না। এই ছোট্ট না শব্দটিতে অবাক হয়েছিলেন আমার শিক্ষক, কারণ তিনি ধারনাই করেননি, ক্লাসের এতো চটপটে শিক্ষার্থীদের ভীড়ে আমার খাতায় দিতে হবে তাকে সর্বোচ্চ নম্বর। উনার শিক্ষার্থীদের মেধা সম্পর্কে পোষণ করা ধারণা কি একটু দুলে উঠেছিল সেদিন? চটপটে মানেই মেধায় সবাইকে ছাড়িয়ে নয়, শান্ত চুপচাপ মানেই মেধায় কোনক্রমেই পিছিয়ে নয়।
শিক্ষা সমাপ্ত করে চাকুরীর জন্য মৌখিক পরীক্ষা দিতে যান। আজকালকার মামা চাচা বাদ দিয়ে যদি নিরপেক্ষভাবেও চাকুরীতে নিয়োগ হয়, তবুও অ্যাকাডেমিক্যালি মেধাবী ছাত্রটির চেয়ে পোষাক এবং কথায় কেতাদুরস্ত ছাত্রটির চাকরী হবার সম্ভাবনায় বেশী। কারণ সেই তথাকথিত ধারণা, কেতাদুরস্ত, চটপটে মানেই প্রতিভাবান। এটা কেবল বাংলাদেশের চিত্র নয়, সমগ্র বিশ্বেই এই চিত্র দেখা যায়। কর্মক্ষেত্রে সাফল্য অর্জন করতে হলে আপনাকে বাকপটু হতে হবে।
সারা পৃথিবীতেই মিডিয়াজগত মাত করে রেখেছে এই উপস্থাপন যোগ্য আউটলুকটাই। খবরের কাগজে অনেক পাতা থাকলেও অনেকেই কেবল ঐশ্বরিয়া রাইয়ের খবর জানতে সিনেমার পাতাটাই সবার আগে খুলে বসেন। বাজারে সেই ডিজাইনের পোশাকটাই বেশী চলে, যেটির বিজ্ঞাপনে ছিল কোন জনপ্রিয় মডেল তারকা। তুলনাটা নিতান্তই অস্বাভাবিক শোনাবে, তাও বলি, অ্যাস্ট্রোফিজিক্সের জগতে তোললপাড় ঘটানো আবিষ্কার পালসার, এর আবিষ্করক ছিল একটি মেয়ে, কজন জানে তার নাম?
আমাদের সমগ্র সমাজটাই এমনি করে চলছে, যেখানে অন্তর্মূখী মানুষদের জায়গা নেই প্রায় বলতে গেলে। যে শিশুটি চুপচাপ, শিশুটির বাবা-মাও তাকে হীন বুদ্ধির শিশু বলে ধারণা করে, সেই ভাবেই তার সাথে আচরণ করে। বন্ধুদের দলে জায়গা হয়না তার। অজস্র সমালোচনা কথা কানে আসে তার ক্রমাগত, অসামাজিক, অসংস্কৃত ইত্যাদি। অনেক শিশু এইসব আচরণ থেকে ক্রমাগত হীনমন্যতায় ভুগতে থাকে। ভাবতে থাকে, এই সমাজে বসবাসের যোগ্য নই সে, সে গুরুত্বপূর্ণ নয় চারপাশের কোন মানুষের জন্য। নিজেকে ক্রমাগত গুটিয়ে নিতে নিয়ে একদিন হারিয়ে যায় সে সময়ের খাতা থেকে। উজ্জ্বল অক্ষরে লেখা থাকে কেবল তাদেরই নাম, যারা পেরেছিল বহির্মূখী জীবনযাপন করতে। অথবা শিশুটি নিজেই নিজেকে হারিয়ে ফেলে যা সে নয়, সেইরকম হবার চেষ্টা করে করে। কেউ তাকে বলে না, পৃথিবীতে তোমার জায়গাটি কেবল তোমারই, অনন্য। বরং ক্রমাগত বলতে থাকে, তোমাকে তো আর সবার সাথে তাল মিলিয়ে চলতে শিখতে হবে, তোমার ভাইটি যদি পারে, তুমি কেন পারো না? চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিতে থাকে, বহির্মুখী, তথাকথিত সপ্রতিভ, কেতাদুরস্ত হতে না পারাটা তার অযোগ্যতা।
স্কুল কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি শব্দ খুব পরিচিত, গ্রুপ স্ট্রাডিজ, গ্রুপ ওয়ার্ক। ছোট বেলা থেকে এমন ভাবে শেখানো হয় শিশুদের, গ্রুপ ওয়ার্ক করতে জানাটা অত্যাবশ্যক কিছু। ফলশ্রুতিতে অবহেলার শিকার হয় সেই সব শিশুরা, যারা চটপটিয়ে কথা বলতে পারেনা, দলের সাথে মিশে যেতে পারে না। কিন্তু সত্যটা হল, গ্রুপ স্টাডিজ ছাড়াও শিক্ষা অর্জন সম্ভব, অনেক কঠিন কোন কাজ করে ফেলা সম্ভব, অনেক সাধারণ কিছু কাজ, তাও করে ফেলা সম্ভব। যে শিশুটি অন্তর্মূখী সে তার মত করে তার সমস্যা সমাধান, তার পড়ালেখা করতে জানে। তাকে সেই সুযোগটুকু দিতে হবে আমাদের। ক্লাসের ফার্স্ট মানেই যেমন সবজান্তা, সবচেয়ে মেধাবী নয়, অন্তর্মূখী মানেই হীনবুদ্ধি বা বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী নয়।
ছোটবেলায় আমার মাও আমাকে আর দশটা বাচ্চার মত বাইরে খেলতে পাঠাতো। খেলার দলে জায়গা না পেতে পেতে আমি হয়ে উঠেছি দলগত খেলার প্রতি অনাগ্রহী। একা একা ঘাসফুল, পাখি, আকাশ, প্রকৃতি দেখে কেটেছে আমার বাল্যকাল। একটু বড় হলে নেশা জেগেছে বইয়ের প্রতি। ডুব দিয়েছি বইয়ের পাতায়। স্কুলে সবাই মিলে যখন আড্ডা দিতো, সেখানে আমার জায়গা হত না, তাদের ধারনা ছিল আমি বুঝব না তাদের কথা। কথাটা হয়ত সত্য ছিল, কিন্তু এই সামাজিক প্রক্রিয়াটা বুঝিয়ে দেবার মানসিকতাও ছিল না আমার চারপাশের কারোর। সবচেয়ে অদ্ভুত ব্যাপার হল, এসবে আমি যে হারিয়ে গিয়েছি, তা নয় মোটেও। আমার আমিকে যেভাবে পেয়েছি, অনেকেই পায়না সেভাবে। আমার বন্ধুরা যখন আক্ষরিক অর্থেই বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিচ্ছে, সেই সময়ে আমি কথা বলেছি সদ্য পড়া কোন বইয়ের চরিত্রের সাথে। বই পাল্টেছে, আমার কথা বলার মানুষ গুলোও পাল্টেছে। একটা সময় এসেছে, যখন আমি আর উপন্যাসের চরিত্রের সাথে আর কথা বলিনি, কথা বলেছি নিজের সাথে অথবা বইটির লেখকের সাথে, ছাপার অক্ষরে লেখা শব্দগুলো ছাপিয়ে বুঝতে চেষ্টা করেছি লেখকের মানসিকতা, লেখকের চিন্তাটা। একেকটা সময় এমনও হয়েছে, একজন লেখকের হাতে পাওয়া সম্ভব সব বই আমি পড়েছি লেখকের জীবনদর্শন বোঝার জন্য। আমার পাশে বসা মেয়েটির সাথে আমার আড্ডা হয়নি, আমি দূর থেকে খেয়াল করেছি তাকে, কিভাবে সে হাসে, কেন হাসে, কি তার ভালো লাগে, আমি তার চেহারার অজস্র প্রকাশভঙ্গি পড়তাম। আমার মনে হত, আমি তার মনের সাথে কথা বলছি। এমন নিঃশব্দ কথা আমি বলেছি বহুজনের সাথে। আমার সামাজিকতা হয়েছে এমন ভাবে। এই সামাজিকতার ধারণাটা বহির্মূখী মানুষগুলোর কাছে অজানা। আমার মত মানুষদের বন্ধুত্ব হয়, তারা ভালোবাসতে জানে। অন্তর্মূখীদের বন্ধু সংখ্যাটা হয়ত অনেক থাকে না, তবে সাধারণত গভীর থাকে। আমার বন্ধুদের কাছে লেখা চিঠির উত্তরে প্রায় একটা কথা শুনতে পাই, এতো কিছু বুঝিস কি করে? নিশব্দে একটা সমস্যার বিভিন্ন কোণ থেকে কিভাবে পর্যবেক্ষণ করতে হয়, তা অন্তর্মূখীরা কিছুটা হলেও জানে, কথা বলার চেয়ে পর্যবেক্ষণটাই যে তারা বেশী করে। আমার বন্ধুরা, যারা তাদের বিপদের দিনে ফোনটা আমাকেই করে, কিভাবে যেন তাদের সেই বিশ্বাসটা তৈরী হয়েছে, ঐ মুহুর্তটায় আমি দাড়াবো তাদের আত্মার কাছাকছি। ঠিক একইরকম বোধ কাজ করে আমার মধ্যেও, একটা অদৃশ্য গভীর বন্ধন যেন কাজ করে।
বহির্মূখী মানুষদের নিয়ে যে পৃথিবীটা সেই পৃথিবী থেকে চোখ সরিয়ে অন্তর্মূখী মানুষগুলোর দিকে তাকিয়ে দেখুন। সেই মানুষগুলো আপনাদের মত সামাজিক নয়, কেতা দুরস্ত নয়, তাদের হয়ত সেই জ্ঞানের অভাব আছে, কিভাবে একটা অনুষ্ঠানে হাসতে হবে, কোন পোষাকে কোথায় যেতে হবে, কিন্তু অন্তর্মূখী মানুষদের মনের মাঝে অসংখ্য চিন্তা প্রতিনিয়ত খেলা করে। চুপ করে থেকে থেকে তারা আর কিছু জানুক চিন্তা করতে জানে। তারা চিন্তা করে, একজন সুবক্তা যতখানি বলে, তারচেয়ে অনেক বেশী চিন্তা করে অন্তর্মূখী মানুষটি। তাদের মস্তিষ্কে যত চিন্তা, যত সমাধান খেলা করে সেসবের দরকার আছে এই পৃথিবীতে। সেসব না হলে হয়ত আজ আমাদের সভ্যতা এসে দাড়াতো না এতোদূর। যে মানুষগুলোকে আজ আমরা ইতিহাসের পাতায় দেখি, যারা বদলে দিয়েছে পৃথিবীটাকে, যাদের কাজের ফলাফল ভোগ করছে এই সভ্যতা, তাদের জীবনের দিকে কি একটু চোখ বুলিয়ে আসা যায়? এই সভ্যতাকে বদলে দেবার জন্য তাদের ভাবতে হয়েছে, নিভৃতে নিঃশব্দে কাটাতে হয়েছে অনেকটা সময়। তাদের কাছ থেকে এই নিঃশব্দ সাধনাটা শেখার আছে আমাদের। এরা সবাই সামাজিক ছিল না। তাদের একটা উল্লেখযোগ্য অংশ ছিল নিভৃতচারী। বাকিরা জানতো, কিভাবে সামাজিকতার মাঝে থেকে নিজের ভাবনার জন্য সময়টি বের করে নিতে হবে। এই কাজটি করতে অনেক সময়ই ভুলে যায় বহির্মূখী মানুষেরা, যারা কোন কিছু সামনে আসা মাত্রই উত্তেজিত হয়ে পড়ে, সপ্রতিভভাবে অনেক কিছু বলে ফেলে, করে ফেলে, গভীরে গিয়ে চিন্তা না করেই। তাদেরকেও বুঝতে হবে, কর্মের জন্য খানিকটা ভাবনাও চাই।
না, আমি বহির্মূখী মানুষদের মোটেও অনুৎসাহিত করতে লিখিনি এই লেখা। লিখেছি আমাদের এই একটি সবুজ পৃথিবীতে অন্তর্মূখীতাকে তার সহজ স্বাভাবিক স্থানটুকু দেয়ার অনুরোধ জানাতে। একই রকমের সামাজিক আচরণ, একই রকম সুযোগ, একই গুরুত্ব নিয়ে জীবনযাপন করবে বহির্মূখী অন্তর্মূখী সব ধরণের মানুষ, এমন একটি সমাজের চিন্তা মনের মধ্যে জাগাতে। যে মানুষ শান্ত, চুপচাপ, অন্তর্মূখী, তাকে তার মত করে বড় হতে অনুপ্রাণিত করুন, তার মত করে জীবনযাপন করতে অনুপ্রাণিত করুন, তাকে সমাজ থেকে বাইরে সরিয়ে নয়। আসুন সেই মানুষটাকে অনুভব করতে দেই, সে আমাদেরই একজন। একজন সুস্থ স্বাভাবিক মানুষের সমস্ত যোগ্যতা নিয়ে সে আমাদের মাঝে বসবাস করবে, সেই উপযুক্ত বাসস্থানটুকু, সমাজটুকু আমরা তাকে দেয়ার চেষ্টা করি। সে হয়ত অনেক কথা বলতে পছন্দ করে না, কিন্তু কিছু কথা বলতে অবশ্যই পছন্দ করে। সে হয়ত এগিয়ে গিয়ে কারোর সাথে পরিচিত হতে পারে না, কিন্তু কেউ এগিয়ে এসে তার সাথে পরিচিত হলে খুশি হয়। সে হয়ত অনেক কথার উত্তর খুঁজে পায় না, কিন্তু সে কারণে অন্যরা তাকে এড়িয়ে গেলে কষ্টও পায় সে। আপনার যে আপনজনটি, বন্ধুটি, সহপাঠিটি এমন অন্তর্মূখী স্বভাবের মানুষ, সেই মানুষটিকে তার মত করে বাঁচার অনুপ্রেরণা দিন, তাকে এড়িয়ে না গিয়ে, তার সাথে থাকুন, তাকে বুঝতে চেষ্টা করুন। বহির্মূখী মানুষদের জন্য উপযুক্ত এই সমাজ ব্যবস্থায় তাকে তার অবস্থানটুকু নিশ্চিত করতে পারলে একদিন এই সমাজটা পাল্টাবে। নাট্যমঞ্চে এখন আমরা যে নাটকটা দেখি, সেই নাট্য মঞ্চে একদিন ফ্রান্সিস ক্রিক, নেলসন মেন্ডেলা, বা তেরেসাদের আরেক পৃথিবীর মানুষ হিসেবে নয়, আমাদের রোজকার পৃথিবীর মানুষ হিসেবেই দেখা যাবে। দেখা যাবে পিছনের বেঞ্চে বসা ছাত্রটিকেও সবার মাঝে। পালসারের আবিষ্কারক, জোসেলিন বেল বার্নেল, যার পাওয়ার কথা ছিল নোবেল পুরষ্কার, তার নামও সেদিন হয়ত অনেকেই জানবে।