রায়হান সোফায় আধশোয়া হয়ে আছে। তন্দ্রামত অবস্থা। ঘুম আসবে বলে মনে হচ্ছে, কিন্তু ঘুমিয়ে গেলে সমস্যা। কারণ ঘরে বাজার নেই, রান্না হয়নি। যখন গভীর রাতে ঘুম ভাংবে তখন ক্ষিধে জানান দেবে। আর তখন কিছুই করার থাকবে না। নীচে দোকানে যাওয়া একারনেই দরকার।
রায়হান অবিবাহিত। দেখতে সুদর্শন, পেশায় ইঞ্জিনিয়ার। বিয়ের বয়স পার হয়ে গেছে ঠিক বলা যাবে না, তবে রায়হানের বন্ধু-বান্ধব সবার বাচ্চাই প্রাইমারি স্কুলের গন্ডি পেরিয়ে গেছে। সে হিসেবে তার বয়স নেহাত কম হয়নি।
আলস্য নিয়ে দোকানের উদ্দেশ্যে নীচে নামল রায়হান। দোকান টা বাড়ির সামনেই। এই সময়ে যদি দোকানে ভীড় থাকে, তাহলে মেজাজটাই খারাপ হয়ে যাবে, এ কথা ভাবতে ভাবতে দোকানের দিকে এগুতে থাকল রায়হান।
দোকানে ভীড় ছিলনা। কেবল একটি মেয়ে সদাই নিচ্ছে। রায়হান অপেক্ষা করছে, মেয়ের শেষ হলে সে নেবে। দোকানদার জাকির রায়হান কে দেখে বলল, ভাই কী লাগবে? রায়হান বলল, আগে কাস্টমার বিদায় কর, বলতেসি। এ কথার মাঝখানেও মেয়েটি ঘুরে তাকালো না, দোকানের দিকেই মুখ করে রইলো। রায়হান সিগারেট ধরালো একটা। মেয়েটির পিঠ দেখা যাচ্ছে। দেখতে দেখতে হঠাৎ মনে হল, এ কী পরিচিত কেউ, চেহারা দেখা যাচ্ছে না। ভাবতে ভাবতেই মেয়েটি ঘুরে তাকালো। রায়হানের দিকে তাকিয়ে বলল, কেমন আছেন আপনি ? রায়হানের সম্বিৎ ফিরে পেতে দেরী হল। এ যে সুষ্মিতা। তাইতো মনে হচ্ছিল এ যেন পরিচিত।
হ্যাঁ ? হ্যাঁ আছি ভাল। তুই এখানে ? এদিকেই থাকিস নাকি ? তোর জামাই বাড়ি নাকি সাভার শুনেছিলাম।
হ্যাঁ ওখানেই ছিল। নিজেদের বাড়ি। এখন আর নেই। বাড়ি কেন কিছুই নেই আর।
রায়হান বলল, তুই একটু বাইরে গিয়ে দাঁড়া, আমি আসছি।
সুষ্মিতা বাইরে গেল। রায়হান ঝটপট তার সদাই নিয়ে বলল, চল । আমার বাসায় চল।
তুমি এদিকে থাকো ?
হ্যাঁ। বছর পাঁচেক হল এখানেই আছি।
তুমি না বিদেশ ছিলে ?
হ্যাঁ, ছিলাম কিছুদিন। মন টানলো না। চলে এসেছি। এখন দেশেই আছি।
বাসার সামনে এসে রায়হান বলল, আমি দোতালায় থাকি, আয়। সুষ্মিতা বলল, রায়হান ভাই, আজ না, আরেকদিন আসবো।
আরে আয়তো, বলেই সুষ্মিতার হাত ধরলো রায়হান।
সুষ্মিতা চেয়ে রইল কিছুক্ষণ। রায়হানের ভেতর বিন্দুমাত্র জড়তা নেই। যেন সে ইচ্ছে করলেই সুষ্মিতার হাত ধরতে পারে।
দোতালায় উঠে দরজা খুলে রায়হান বলল, আয়, ভেতরে আয়।
ভেতরে অন্ধকার। আলো জ্বেলে দিল রায়হান। এখন সুষ্মিতাকে ভাল করে দেখতে পারছে রায়হান। একটুও বদলায়নি মেয়েটা । সেই ছিপছিপে গড়ন, লম্বা মুখশ্রী, টানা চোখ।
বোস ওখানটায়। রায়হান বলল।
বাহ। তোমার বাসাতো অনেক বড়। তোমার বউ কে ডাকো। কথা বলি।
বউ নেই।
নেই মানে? কোথাও গেছে ? কখন আসবে ?
আসবে না আর।
মানে কী ?
মানে আবার কী, বউই যদি না থাকে তাহলে কোত্থেকে আসবে বল ?
সে কী, তুমি বিয়ে করনি এখনো ? নাকি দুষ্টুমি করছো ?
নারে, দুষ্টুমির বয়স কী আর আছে এখনো ? বিয়েটা আর করা হয়ে ওঠেনি।
তুমি আমাকে যে নিয়ে এলে, লোকে জানলে নানান কথা বলবে ।
লোকে কথা বলবে মানে, লোকজন কী আমাকে খাওয়ায়, পরায় ? আমি একা আজ ফ্ল্যাটে মরে পড়ে থাকলেও তো কেউ জানবে না। এমন লোকের ধার ধারি আমি ?
সে কী, তুমি এমন চটে যাচ্ছো কেন ? এখনও আগের মত ঝট করে রেগে যাও দেখি।
রায়হান শান্ত হল, বলল, তুই কী খাবি বল, যদিও খাওয়ার কিছু আছে বলে মনে হয় না। একা মানুষ। একবেলা হোটেলে খাই, আর রাতে নিজে টুকটাক রান্না করা হয়।
বিয়ে করনি কেন ?
কীভাবে করব বল, তুই চলে গেলি যে। হাসতে হাসতে বলল রায়হান।
একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো সুষ্মিতা। হয়ত বোঝার চেষ্টা করছিল, হাসির আড়ালে অজানা কোন কষ্ট আছে কিনা রায়হানের।
তুই তো চলেই গেলি, গিয়েও শান্তি দিলি না। এমন বদ দোয়া দিলি সারাজীবন বিয়েই আর করতে পারলাম না। বলতে থাকল রায়হান।
তাই না ? তোমার তাই ধারনা?
কিছু বলল না রায়হান।
আমি এখন উঠব। দেরী হয়ে গেছে।
বোস না আরেকটু। একা থাকি, তোর সাথে কথা বলে ভালো লাগছে।
আজ না। পরে কথা হবে। আমি যাই এখন।
বাসা তো চিনেই গেলি। আসবি তো মাঝে মাঝে ?
দেখি। হেসে বলল সুষ্মিতা।
সুষ্মিতা আর রায়হান একই পাড়ায় থাকতো। সেভাবেই পরিচয় দুজনের। রায়হান তখন বুয়েটের ফাইনাল ইয়ারে আর সুষ্মিতা ইন্টার সেকেন্ড ইয়ার। রায়হান কে শুরু থেকেই পছন্দ সুষ্মিতার। রায়হানও বুঝত একটু একটু। কিন্তু পাত্তা দিত না। ভাবত, বাচ্চা মেয়ে, যখন বুঝবে তখন আর আসবে না। রায়হানের বোঝায় ভুল ছিল। যতটুকু ভালো লাগার কথা রায়হান জানত, তার চেয়ে অনেক বেশি ভালবাসত সুষ্মিতা।
একদিন রাস্তায় পথ আটকে দাঁড়ালো সুষ্মিতা।
চল, আমার সাথে, কথা আছে। বলেই হাত ধরে টানতে টানতে মাঠের দিকে নিয়ে গেল সুষ্মিতা।
আরে আরে, কী করিস, হাত ছাড় না। সুষ্মিতা ছাড়লো না। মাঠের এক কোনায় বসলো দুজন।
কী এমন কথা যে বলার জন্যে রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকতে হবে ?
আমার বিয়ে ঠিক হয়ে যাচ্ছে।
তাই নাকি ? এতো সুখবর। কবে বিয়ে ?
সুষ্মিতা জলভরা চোখে তাকালো। সেই চোখের দিকে তাকানোর সাহস হয়নি রায়হানের।
এরপর যেন হঠাৎ করেই ঝটপট চলে গেল কয়েকটি বছর। সুষ্মিতার বিয়ের খবর পেয়েছিল রায়হান। তখন সে ব্যস্ত আমেরিকা যাওয়া নিয়ে, তার ক্যারিয়ার নিয়ে। এক মেয়ের জলভরা চোখের কান্নার চেয়ে ক্যারিয়ার অনেক গুরুত্বপূর্ন রায়হানের কাছে।
এখন রায়হান জানে, সে ভুল করেছিল। তার জীবনে অর্থ, খ্যাতি সবই এসেছে, যেমনটি সে চেয়েছিল। কিন্তু এর সাথে এসেছে একাকীত্ব। মা মারা যাওয়ার পর আক্ষরিক অর্থেই একা হয়ে যায় রায়হান। ভেবেছিল বিদেশে স্থায়ী হবে। একেবারেই মন টিকলো না। তাই আবার দেশে চলে আসা।
বেলা ১১টার দিকে বেল টিপল কে যেন। এক বার। দুবার। বিরক্ত হয়ে দরজা খুলল রায়হান। দেখলো সুষ্মিতা দাঁড়িয়ে আছে।
আরে তুই ? আয়, ভেতরে আয়।
তুমি ঘুমুচ্ছিলে বুঝি ? ডিস্টার্ব করলাম তো তাহলে।
আরে কীসের ডিস্টার্ব। সারাদিন তো বাসাতেই থাকি।
কেন ? অফিসে যাও না ?
নাহ। চাকরি ছেড়ে দিয়েছি। ভালো লাগে না।
তাহলে চলো কীভাবে ?
যা কামিয়েছি এক জীবন এমনিতেই কাটিয়ে দেয়া যাবে। আরো একা মানুষ। কতইবা লাগে। খরচের মধ্যে কেবল এক বই কেনা।
ওহ।
তুই বোস, আমি চা করে আনি।
না না, তুমি ফ্রেশ হঊ। আমি চা করছি। রান্না ঘরে সব আছে তো ?
হ্যাঁ সব আছে।
হাত মুখ ধুয়ে, রান্নাঘরে উঁকি দিলো রায়হান। সুষ্মিতা চা বানাচ্ছে। বউ বউ লাগছে তাকে।
কীরে তোর চা কতদূর ?
কি যেন ভাবছিল সুষ্মিতা। রায়হানের কথায় ঘোর ভাংলো তার। এইতো হয়ে গেছে। তুমি বোস, আমি নিয়ে আসছি।
দুজন দু কাপ চা নিয়ে মুখোমুখি বসলো।
আচ্ছা। আমি যে আসলাম, সমস্যা হবে নাতো তোমার ?
কীসের সমস্যা? কোন সমস্যা নেই। তুই এ বাসায় থাকলেও কোন সমস্যা নেই।
চায়ে চুমুক দিতে গিয়ে থমকে গেল সুষ্মিতা। তাকালো রায়হানের দিকে। নিশ্চিন্ত মনে চা খাচ্ছে রায়হান। ঠিক আগের মত। কোন জড়তা নেই তার ভেতর। সুষ্মিতা জানে, রায়হান যা বলেছে, মন থেকেই বলেছে।
তাই না ? কোন সমস্যা নেই ? বিয়ে কর না কেন তাহলে ?
বিয়ের কী দরকার, তুই চলে এলেই তো হয়। মাঝে মাঝে চা টা খাওয়া যায়।
আবারও তাকালো সুষ্মিতা রায়হানের দিকে । একমনে চায়ে চুমুক দিচ্ছে রায়হান। কী শান্ত, সৌম্য একটা মূর্তি। যেন সে যা বলেছে, ভেবে চিন্তেই বলেছে। যেন কোন সংশয় কোন দ্বিমত নেই তার কথায়।
তোর জামাই কেমন আছেরে ? ওর কথা তো শোনাই হল না সেদিন। কী করছে এখন ?
কিছুই করছে না। বাসায় থাকে আর গাঁজা খায়। মন মেজাজ খারাপ থাকলে আমাকে ধরে মারে। এইতো।
কী বলছিস তুই এগুলো ?
কী আবার, যা হয় তাই বলছি।
তোর জামাই নেশা করে, তুই কিছু বলিস না?
বলি দেখেই তো মারে। চাকরি বাকরি, ব্যবসা বানিজ্য সব কিছু খেল তো নেশা করেই। বলে চোখ মুছল সুষ্মিতা।
বাচ্চা নিস না কেন ? বাচ্চা কাচ্চা থাকলে হয়তো এমন করতো না।
তোমার যা কথা। দুজনের ভাতই জোটে না, সেখানে আবার বাচ্চা।
তুই বোস, আমি আসছি। বলে উঠে গেল রায়হান।
এটা রাখ, বলে একটা খাম হাতে গুঁজে দিল সুষ্মিতার হাতে।
সুষ্মিতা খাম খুলে দেখলো পাঁচশো টাকার একটা বান্ডেল।
আমি তোমার কাছে টাকার জন্যে আসিনি রায়হান ভাই। বলে খামটা রায়হানের হাতে দিয়ে চলে যাচ্ছিল।
আরে বোস তো। আচ্ছা ঠিক আছে, টাকা নেয়া লাগবে না। ভাবলাম, তোর নিজেরও খরচ আছে, তাই দিলাম আরকী। আচ্ছা রাগ করতে হবে না, বোস ঠান্ডা হয়ে।
দুজন বসে থাকলো চুপচাপ কয়েক মুহুর্ত। কেউ কোন কথা বলছে না।
সুষ্মিতাই মুখ খুললো, রায়হান ভাই, সেদিন দোকানে তোমার গলা শুনেই বুঝেছিলাম এটা তুমি। কী যে আনন্দ লেগেছিল তুমি জান না।
আমারও। রায়হান বলল।
তুমি কী জানতে রায়হান ভাই, আমি যে তোমাকে ভালবাসতাম ?
রায়হান কোন জবাব দিল না।
উঠতে উঠতে বলল সুষ্মিতা, এখনো বাসি। আমার হাসব্যান্ড যতবার আমার গায়ে হাত তোলে ততবার আমার তোমার কথা মনে হয়। মনে হয়, তুমি আমার সাথে থাকলে আমি অনেক ভাল থাকতাম।
রায়হান মাথা নীচু করে বসে ছিল। সেভাবেই বলল, তুই কী এখন আমার কাছে চলে আসতে পারিস না ? আমার দরজা তোর জন্যে সবসময় খোলা।
সম্ভব না রায়হান ভাই। আমি সমাজে বাস করি। এখানে চাইলেই সব করা যায় না । আর আমি আবারও বেবি এক্সপেক্ট করছি। তোমার সাথে এটাই আমার শেষ দেখা। আর কখনো তোমার সাথে দেখা হবে না। তুমি ভাল থেকো রায়হান ভাই।
বলেই দরজা খুলে বের হয়ে গেল সুষ্মিতা। রায়হান নিষ্পলক চেয়ে রইলো খোলা দরজার দিকে। যে দরজা দিয়ে নতুন করে প্রবেশ নিল একরাশ একাকীত্ব।
বিঃ দ্রঃ গল্পটি কম্পিউটারে পড়ে ছিল। উদীয়মান কবি, ব্লগার কলমের কালি শেষ এর পীড়াপীড়িতে অনেক দিন পর লেখা পাব্লিশ করলাম।
সর্বশেষ এডিট : ০২ রা মার্চ, ২০১৬ রাত ১২:০৭