আমার অনেক প্রিয় একটা উপন্যাস। হুমায়ূন আহমেদের বেশিরভাগ গল্পে যেমন থাকে, পড়লে মনে হয় এটা আমারই গল্প, এটাও অনেকটা তেমন।
বইয়ের প্রসঙ্গে ঢোকা যাক। হুমায়ূন আহমেদের বইয়ের মুদ্রণ অনেকবার করে হত। আমার কাছে যেই কপিটি আছে সেটির সর্বশেষ মুদ্রণ চতুর্থ এবং ১৯৯৯ সালে! মানে প্রথম ৪টি মুদ্রণ হতে ৯বছর লেগেছে! পরে আরও কতবার পুনঃমুদ্রণ হয়েছে সেটি অবশ্য জানা নেই। তাই ধারণা করা যেতে পারে, বইটির কাটতি একদম প্রথমদিকে খুব একটা ভাল ছিলনা। এটিও এই রিভিউ লেখার পেছনে একটি কারণ। আমার নিজের কাছে সবসময়ই মনে হয়েছে এটি লেখকের ভাল উপন্যাসগুলোর একটি। মূল বইটি পড়ার অনুরোধ থাকল।
বইয়ের মূল চরিত্র জহির। গ্রামের ছেলে, বি এ পাশ করে ঢাকায় এসে চেষ্টা করে নিজের পায়ে দাঁড়ানোর। অনেকটাই সফল সে চেষ্টায়। মোটামুটি মানের একটি চাকরি জুটিয়ে নেয়। ঢাকায় এসে প্রথমে দেখা করতে আসে দূর-সম্পর্কের মামা বরকত সাহেবের বাসায়। বরকত সাহেব এজি অফিসে চাকরি করেন। স্বভাবতই ঢাকায় আসা গ্রামের গরীব আত্নীয়দের হেলাফেলা করা হয়, জহিরের ক্ষেত্রেও ব্যতিক্রম হয়নি। মামী শাহানা প্রথম দেখাতেই বরকত সাহেবকে বলে দেন জহির যেন তাদের বাড়িতে না থাকে। উল্লেখ্য, বরকত সাহেবের ৩ মেয়ে। অরু,তরু, মীরু। বড় দুই বোনের উপস্থিতি উপন্যাসে প্রাধান্য পেয়েছে।
চাকরি করে নিজেকে একটু গুছিয়ে নিয়ে সবাই চায় সংসার করতে। জহিরও তার ব্যতিক্রম না। বেতনের সামান্য টাকায় নিজেরই চলে না, চাকরি করার পরেও ২টা টিউশনি করতে হয়। এর পরেও সে স্বপ্ন দেখে এক মমতাময়ী নারীর, যে ভালবাসার কঠিন দেয়াল তুলে জহিরকে আগলে রাখবে। মেয়ে দেখার সে প্রক্রিয়ায় দুই জনকে দেখেও ফেলে। দুইজনকেই জহিরের মনে ধরে। কিন্তু বিয়ে হয়না বিভিন্ন কারণে।
উপন্যাসের এক পর্যায়ে আসমানী নামে এক মেয়ের সাথে বিয়ের কথা পাকাপাকি হয় জহিরের। কনে দেখার দিনে বরকত সাহেব জহির কে জানায় যে আসমানী মেয়েটা বেশ সুন্দর, কিন্তু একটা ছোট সমস্যা আছে। তা হল, আসমানীর আগে একবার বিয়ে হয়েছিল! মাঝখানে বেশ কিছু বিয়ে ফোনের মাধ্যমে হত। আসমানীরও তাই হয়েছিল, কিন্তু পরে ছেলে জানায় তার সমস্যা আছে, তাকে যেন ক্ষমা করা হয়। এই হল আসমানীর বিয়ের ঘটনা। জহির বেশ মন খারাপ করে এ ঘটনায়। কিন্তু আসমানীকে দেখেই জহিরের মন মায়ায় ভরে যায় আগের দুইবারের মতই। এবং আসমানীর হাতেই আংটি পরিয়ে দেয়।
উপন্যাসের মাঝামাঝিতে এসে বরকত সাহেবের বড় মেয়ে অরুর আগমন। অরু বরিশাল মেডিকেলে পড়ত। অরুর মা শাহানা যে ভয় সবসময় পেত যে জহিরের সাথে অরুর বোধহয় ভাব আছে, সেটি সর্বৈব মিথ্যা প্রমাণ করে অরু বিয়ে করে লালমাটিয়া কলেজের এক মধ্যবয়স্ক শিক্ষক আজহার সাহেবকে। যিনি বিবাহিত এবং যার একটি সন্তানও রয়েছে। এই বিয়ে, আজহার সাহেব এবং আজহার সাহেবের বন্ধু বান্ধব নিয়ে এক ধরনের দ্বিধা থাকে অরুর মনে। একমাত্র জহিরের সাথেই বিয়ের পরও পরিচয় থাকে অরুর । অরুর বাসায় অরুকে নিষিদ্ধ করে তার পরিবারের সবাই।
উপন্যাসের শেষ পর্যায়ে জহিরের চাকরি চলে যায়। কারণ চাকরিটি ছিল টেম্পোরারি। সবার সেটি পার্মানেন্ট হলেও জহিরের হয় না, কারণ জহিরের তদবির করার মত কেউ ছিল না। উলটো তার জায়গায় বড় সাহেবের এক আত্নীয়ের নামে এপয়েন্টমেন্ট লেটার ইস্যু হয়। এদিকে বিয়ের সময় ঠিকঠাক। কমিউনিটি সেন্টার পর্যন্ত ভাড়া হয়ে গেছে, যার অগ্রিম জমা দেয়া টাকা ফেরত আনার কথাও চিন্তা করতে হয় জহিরকে। চাকরি চলে যাবার কথা আসমানীকে জানাবে কিনা সে চিন্তাও ভর করে। এদিকে অফিসের বসের কাছে জহির তার পাওনা টাকা চাইতে গেলেও বড় সাহেব এ কথা সে কথা বলে কাটিয়ে দেন, পরের কদিন অফিসেই আসেন না।
জহিরের যখন এ অবস্থা তখন হঠাৎ করেই বিয়ের তিনদিন আগে লাল টাই পড়া লম্বা মতন এক যুবক আসমানীর বাসায় কড়া নাড়ে। এ যুবক হল সেই যার সাথে ফোনে আসমানীর বিয়ে হয়েছিল। এ যুবকের একটি গল্প আছে, তা হল যুবকের ক্যান্সার ধরা পড়েছিল। এ খবর জেনেই যুবক বিয়ে ভেঙ্গে দিয়েছিল, নিজের ক্ষয়িষ্ণু জীবনের সাথে আসমানীকে জড়াতে চায়নি। কিন্তু মিরাকল ঘটে যুবকের জীবনে, তার ক্যান্সার পুরোপুরি সেরে যায়। সে আর বিলম্ব করেনি, ছুটে এসেছে আসমানীর কাছে। কিন্তু আসমানীর বিয়ে তো ঠিক হয়ে আছে জহিরের সাথে। সে ব্যবস্থাও করে এসেছে যুবক। জহিরের কাছে নতজানু হয়ে প্রার্থনা করেছিল সে, জহিরের হৃদয় স্বর্ণখণ্ডের, ফেরায়নি যুবককে। আর নিজের জীবনের দুর্দশার কথা তো আগেই জেনে গিয়েছিল সে।
সবশেষ বাকী থাকে অরু। সিঁড়ি থেকে পড়ে গিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয় সে। তার অনাগত সন্তান পৃথিবীর আলো দেখবে না এ দুঃখে কাতর হয় অরু।
উপন্যাসের মূল কাহিনী মোটামুটি এই। মাত্র ৭৫ পৃষ্ঠার কলেবরে লেখক অত্যন্ত সাধারণ মোড়কে জহির কে উপস্থাপন করেছেন অসাধারণ রুপে। যার চাকরির টাকায় নিজের চলেনা, তার অফিসের বসকে সে উলটো টাকা ধার দেয়, যা পরে আর তুলতে পারেনা সে । নিজের বিয়ের আলাদা করে রাখা সর্বশেষ সম্বল পাঁচ হাজার টাকাও একবার অরু জহিরের মেসে এসে নিয়ে যায়। জহির না করতে পারেনা।
পুরো উপন্যাসে জহির থাকে এমন একজন মানুষ যে তার সবকিছু কেবল দিয়েই যায় শুরু থেকে শেষ অবধি। টাকা পয়সার ব্যাপার তো বটেই, তার ভাল,সুন্দর,কোমল মনটাও। কারও বিপদ মানেই জহিরের উপস্থিতি। সার্বক্ষণিক সর্বশেষ আশ্রয়। জহির কে আবেগের আতিশায্যে ভালবেসেছিল অরু, সুস্পষ্ট সীমারেখা টেনে দিয়েছিল জহির। ভালবাসা পেয়েছে তরুর, আসমানীরও। তাই সবকিছু দিয়ে নিঃশেষ হয়নি জহির, অশেষ ভালবাসার স্পর্শেও ধন্য হয়েছে সে। যাদের জন্যে জহিরের এত আত্নত্যাগ তারা জহিরের জন্যে জনম জনম কাঁদবে।
উপন্যাসের দুর্বল দিক খোঁজাটা আমার জন্যে কষ্টকর, কারণ লেখক আমার অতিপ্রিয় সাহিত্যিক। তাঁর রচনার ভুল-শুদ্ধ বের করার দায়িত্ব আমার নয়। আমি কেবল একজন পাঠক হিসেবে তাঁর রচনা পাঠ করে আনন্দ নেয়ার চেষ্টা করেছি। আর সে আনন্দ নিতে গিয়ে হয়েছি বিষাদগ্রস্ত, ব্যাথিত। মাত্র ৭৫ পৃষ্ঠায় লেখক আমাদের অতি পরিচিত জীবনের গল্প তুলে এনেছেন। তাঁর নিজস্ব রচনাশৈলি দিয়ে পুরো সময়টুকু নিজের রচনায় টেনে নিয়েছেন। এমন সুন্দর উপস্থাপনা একমাত্র হুমায়ূন আহমেদের পক্ষেই সম্ভব ছিল। তবে দুর্বল যদি কিছু থাকে সেটি হল গল্পের প্রায় সব নায়িকাই জহিরের প্রেমে পড়ে। এই একটি দিক ছাড়া বইটি পড়ার পর আপনি যত কঠিনই হন না কেন হয়ত নিজের অজান্তে চোখের কোনায় জমে থাকা পানি মুছবেন। ভালবাসার মানুষটির দিকে আরেকবার ভালোবাসা নিয়ে তাকাবেন। দিনের শেষে তাই না পাওয়ার কোন গল্প হয়ে থাকেনি, দিনের শেষে ভালবাসার গল্প হয়ে উঠেছে।
সর্বশেষ এডিট : ২২ শে জানুয়ারি, ২০১৫ রাত ১২:৫৬