[পোস্টটি 'সরব মুভি থেকে নেয়া প্রতিযোগিতায়' ৪র্থ পুরষ্কার প্রাপ্ত ]
সাধারণত সুপারহিরো মুভিতে সব হিরো সুপার পাওয়ারওয়ালা হয়ে থাকেন। আকাশে উড়ে যান মুহুর্তে, এক ঘুষিতে গোটা বিশেক লোককে ধরাশায়ী করেন, কোন গুলি তাঁদের গায়ে লাগে না, কিন্তু তারা যে গুলি করেন সেগুলো মিস হয় না! আরও কত কী। সুপারহিরোরা যে আমাদের মত সাধারণ মানুষই, এবং কোন রকম সুপার পাওয়ার ছাড়াও যে সুপারহিরো হওয়া যায় এই চিন্তাটা অনেক পড়ে এসেছে। বা বলা যায় ক্রিস্টোফার নোলান বুঝিয়েছেন যে সাধারণ মানুষও অসাধারণ(সুপারহিরো)হয়, হতে পারে।
ডিসি কমিকসের অন্যতম জনপ্রিয় কমিক সিরিজ ব্যাটম্যান। ব্যাটম্যান কে নিয়ে বিগ বাজেটের সিনেমা তৈরি হয়েছে আগেও। কিন্তু ক্রিস্টোফার নোলানের ‘ব্যাটম্যান ট্রিলজি’ ছাড়িয়ে গেছে আগের সব ফ্র্যাঞ্চাইজকে। নোলানই প্রথম ব্যাটম্যান সিরিজে ডার্ক থিম সফলভাবে ব্যবহার করতে সক্ষম হন। এমনকি প্রথমবারের মত কোন ব্যাটম্যান সিরিজের ছবিতে ব্যাটম্যান শব্দটার ব্যবহার তিনিই প্রথম বন্ধ করেন (ডার্ক নাইট এবং ডার্ক নাইট রাইজেস)। নোলান এমন একজনে পরিচালক যিনি ডার্ক নাইটের প্রধান ভিলেন জোকার চরিত্রকে এমনভাবে উপস্থাপন করেন যে নায়কের চাইতে ভিলেন বড় হয়ে যায়। এমনকি জোকার চরিত্রে হিথ লেজারকে উপস্থাপন করেন যা নিয়ে ছবি মুক্তির আগে সমালোচনা হলেও পরে সেটি নিয়েই শুরু হয়ে যায় গবেষণা। শুধু তাই নয়, পরের ছবি ডার্ক নাইট রাইজেসে নিয়ে আসেন নতুন ভিলেনরুপী টম হার্ডিকে। মানে নোলান এমন এক পরিচালক, যাকে অভিনয়ের জন্যে নেবেন, কাজ করাবেন, তিনিই ওই চরিত্রে লিজেন্ড হয়ে যাবেন।
ক্রিস্টোফার নোলান, জন্ম ৩০ শে জুলাই, ১৯৭০ সালে লন্ডন, ইংল্যান্ডে। ছোটবেলায় বাবার ৮মিমি ক্যামেরা দিয়ে হাতেখড়ি। পরে ইংরেজী সাহিত্যে যখন লন্ডন ইউনিভার্সিটি কলেজে পরছিলেন তখন ১৬ মিমি ক্যামেরা দিয়ে শিখে ফেলেন ‘গেরিলা টেকনিক’ যা কিনা তিনি পরে তার প্রথম ছবি ‘দ্যা ফলোয়িং’ এ ব্যবহার করেন।
তার দ্বিতীয় ছবি ‘মেমেন্টো’। ছোট ভাই স্ক্রিন রাইটার জোনাথান নোলানের ছোট গল্প অবলম্বনে তৈরি মেমেন্টো অনেক প্রশংসিত হয়।নমিনেশন পায় একাডেমী এওয়ার্ড সহ অনেক এওয়ার্ডের জন্যে।জনপ্রিয় হিন্দী মুভি গজিনি এই মেমেন্টোরই রিমেক যা অনেক পরে ভারতে তৈরি হয়।
ভাল ছবির ধারাবাহিকতায় নোলান নির্মাণ করেন তার ৩য় ছবি ‘ইনসমনিয়া’ যেটিও মুভি ক্রিটিকদের মধ্যে সাড়া ফেলে দেয়।
২০০৫ সাল। নোলান প্রথমবারের মত যুক্ত হন ডিসি কমিক সিরিজের অন্যতম জনপ্রিয় ফ্র্যাঞ্চাইজ ব্যাটম্যান সিরিজের শেষ ৩টি পর্বের জন্যে। প্রথম ছবি ব্যাটম্যান বিগিন্সে নোলান ব্যাটম্যান কে উপস্থাপন করেন এমনভাবে যেমনটি এর আগে কোন ব্যাটম্যান কে দেখা যায়নি। ব্যাটম্যানরুপী ব্রুস ওয়েইন চরিত্রে নেন ক্রিশ্চিয়ান বেইলকে। তাকে নির্দেশ দেন পেশীবহুল শরীর তৈরি করতে, ওজন বাড়াতে। ৬ মাসের বেশি সময় বেইল ব্যয় করেন তার শরীর গঠনের কাজে। নোলানের সবচেয়ে বড় যে পরিবর্তনটি নিয়ে আসেন, তা হল ব্যাটম্যান কে এই সময়ের উপযোগী করে উপস্থাপন করা।যা আগের ব্যাটম্যান সিরিজের কোন ছবিতে অন্য পরিচালকগণ খুব সফলভাবে করতে পারেননি।
এর ৩ বছর পর আসে সিরিজের ২য় ছবি ‘দ্যা ডার্ক নাইট’। প্রথমবারের মত কোন ছবি যেখানে ব্যাটম্যান নামটি অনুপস্থিত। শুধু তাই নয়, নোলান মুভি প্রেমিকদের দ্বিতীয়বার চিন্তা করতে বাধ্য করেছিলেন এর পোস্টার, প্রচারণা সব দিক দিয়েই। ছবির জোকার চরিত্রে হিথ লেজার কী করেছিলেন তা সবারই জানা। বলা হয়ে থাকে, হিথ লেজারের চেয়ে জোকার চরিত্র আর কেউ ভালভাবে করতে পারতেন না। ডার্ক নাইট পুরো পৃথিবীজুড়ে ব্যবসা করে ১ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি।
মাঝে ২০০৬ সালে বানান আরেকটি মাস্টারপিস ‘দ্যা প্রেস্টিজ’। দুই জাদুকরকে কেন্দ্র করে নির্মিত ছবিটি সিনেমা সমালোচক থেকে শুরু করে সবার নজর কাড়ে। নমিনেশন পায় একাডেমী এওয়ার্ড সহ অনেক পুরস্কারের জন্যে।
২০১০ সালে নোলান নির্মাণ করেন সাই-ফাই থ্রিলার ‘ইন্সেপশন’। নোলানের নিজের অরিজিনাল স্ক্রীনপ্লে এই ছবি শুধু দেখার জন্যে না, দেখে চিন্তা-ভাবনা করার এবং সব শেষে নিজের মত করে বুঝে একটি সিদ্ধান্ত নেবার! ছবিটি এখনও বাঘা বাঘা মুভিখোরদের তর্ক করার একটি প্রিয় বিষয়।
এর পর নির্মাণ করেন ব্যাটম্যান ট্রিলজির শেষ ছবি ‘ডার্ক নাইট রাইজেস’। আগের মাস্টারপিসের মত এই ছবিটিও পুরো পৃথিবীজুড়ে ১ বিলিয়ন ডলারের ব্যাবসা করে।এমনভাবে ব্যাটম্যান শেষের পরিসমাপ্তি হয়ত নোলানের চেয়ে ভাল কেউ করতে পারতেন না। শেষ হইয়াও হইল না শেষ এর মত ব্যাটম্যান ভার্সেস সুপারম্যান ছবি আসতে যাচ্ছে। যেখানে নোলান থাকবেন প্রযোজক হিসেবে, পরিচালক হিসেবে নন। পরিচালক হিসেবে দেখা গেলে হয়ত নতুন কোন চমক অপেক্ষা করত দর্শকদের জন্যে। এর আগে ২০১৩ সালে প্রথমবারের মত ‘ম্যান অফ স্টিল’ ছবি প্রযোজনা করেন নোলান। জ্যাক স্নাইডারের পরিচালনায় ছবিটি সফলতা লাভ করে। কিন্তু নোলানের স্বভাবসুলভ পরিচালনায় ছবিটি অন্য মাত্রা পেত।
কৃতি এই পরিচালকের সর্বশেষ পরিচালিত ছবি ‘ইন্টারস্টেলার’। মুক্তি পেয়েই হইচই ফেলে দিয়েছে গোটা বিশ্বে।
ক্রিস্টোফার নোলান এমন এক গুণী পরিচালক যার পরিচালনায় করা প্রায় সব ছবি আইএমডিবির প্রথম ২৫০ চলচ্চিত্রের মধ্যে আছে। দুঃখের বিষয় এত হাই প্রোফাইল ডিরেক্টর, প্রডিউসার হয়েও ডিরেক্টর হিসেবে অস্কার খানা ছুঁয়ে দেখা হয়নি এই গুণী পরিচালকের। এই আফসোস কী নোলানের মিটবে এবার ? সময়ই বলে দেবে।