আজকে ১লা মে ছুটির দিন ছিল। কিন্তু আমার বস আমাকে ভেরেণ্ডা ভাজি করতে সাইটে পাঠিয়েছে!
ছাত্রজীবনে আমি ছিলাম প্রতিভাবান এবং খেয়ালি স্বভাবের। মেসকাত হোসেন ছিল চালাক এবং ক্যারিয়ার সচেতন। কাজেই সময়ের অংক খাতায় ফলাফল এসেছে, মেসকাত হোসেন = সাইমুন রহমানের বস।
পাঠক, বুঝতেই পারছেন আমার নাম সাইমুন রহমান এবং আমি আমার বস মেসকাত হোসেন এর উপর কতটা রেগে আছি! রাগব নাত কি করব? আমি পরশুদিন ফিল্ডে লে আউট দিয়ে এসেছি। গতকাল মালিক পক্ষের এক ‘আবাল চামচিকা’ গেছে লে আউট চেক করতে। আবাল টেপে ১০৬৭ মি.মি. কে ১০৭০ মি.মি. ধরছে। ফলাফল দুই পাশে ৬ মি.মি. এরর। আজকে বস আবার আমাকে পাঠিয়েছে সেই এরর ঠিক আছে কিনা চেক করে দেখতে! মনে মনে বলি, সার্টিফিকেট তুমি দ্বিধা হও, আমি ফাঁস প্রশ্নপত্রে পরীক্ষা দিয়ে পুনর্বার পাশ করি।
আমি প্রচন্ড রোদে সাইটে হাঁটছি।আমার মাথায় সাদা ক্যাপ, চোখে সানগ্লাস। ছুটির দিন বলে লোকজন বলতে গেলে নাই। তা দেখে আমার বিরক্তি আরো বেড়ে যাচ্ছে। সাইটে যেখানে যা কিছু চোখে পড়ছে সবকিছুই মনে হচ্ছে ভুল। কাল্ভার্ট থেকে রাস্তার ঢাল ঠিক হয় নাই, পুকুরের পাড় সমান হয় নাই, জেনারেটর টা আরো দক্ষিণ দিকে বসায় নাই কেন? আমার চান্দি অসম্ভব গরম হয়ে গেল। চান্দি ঠাণ্ডা করার জন্য আমি ডিপ টিউবওয়েলের কাছে আসলাম।ডিপ টিউবওয়েলের পাড়ে একটা ছেলে উবু হয়ে বসে আছে।কাছে গিয়ে দেখি মিশমিশে কাল হাড্ডিসার একটা ছেলে।লাল স্যান্ডো গেঞ্জি কাছা দেয়া লুঙ্গির ভেতর ইন করে পরা। বয়স বার তের। অপুষ্টির কারণে উচ্চতা মোটে চার ফুটের কাছাকাছি। সারা গায়ে খোস পাঁচড়ার দাগ। আমি কিছু বলার আগেই সে বলল, আমার নাম সুবিন। পাইল মিস্ত্রি মজনুর হেল্পার।
আমি বললাম, তুমি পাইল মিস্ত্রির কি হেল্পারি করবা? তোমাকে দেখলে ত মনে হয় বাতাসের বাড়ি খাইলে পড়ে যাবা!
সুবিন আমার কথায় দাঁত বের করে হাসল। শিশুর সরল হাসি। তারপর বলল, আমারে পাতলা কাম গুলা দেয়। খাঁচায় গুনা তার বাঁধা। পাইল ক্যাপের নম্বর দেয়া ইসব।
তুমি ইস্কুলে যাওনি কোনদিন?
না আমার বাপ মরছে আমার জন্মের আগে। পাঁচ বছর বয়সে মা মরছে। মাঝে মাঝে ডাস্টবিনে কুকুরের সাথে খানা খাইতাম। একদিন আল্লাকে বললাম-
কি বললা?
আল্লা, আমি যে কুকুরের সাথে খানা খাই এটা জানি কেউ না দেখে! বলতে বলতে সুবিনের চোখে জল টলমল করতে লাগল।
আমার মুখে কোন কথা আসছেনা। বাপ মা হীন এতিম একটা ছেলে ডাস্টবিনে কুকুরের সাথে খাবার খুঁজছে, এই দৃশ্যটা আমার মন অসম্ভব খারাপ করিয়ে দিচ্ছে।
সুবিন বলল, আল্লা আমার কথা শুনলেন। আমি যখন কুকুরের সাথে খানা খাইতাম কেউ আমারে দেখত না!
কেউ দেখত না কেমনে বুঝলা?
আমি টেস কইরা দেখছি। কুকুরের সাথে খানা খাইতেছি। লোকে ময়লা ফেলতে আইসা আমার গায়ের উপরেই ময়লা ফেলছে। আমারে দেখতে পায় নাই!
আমার বুক চিরে একটা দীর্ঘঃশ্বাস বের হয়ে আসল। জীবনের একটা অসম্ভব অপমানজনক অধ্যায় কে সহ্য করার জন্য একটা শিশু নিজের মধ্যে কি অদ্ভুদ মানসিক বিভ্রম তৈরি করে নিয়েছিল! হয়ত তার গায়ের উপর অসাবধানতা বশত কেউ ময়লা ফেলে দিয়েছিল। সেটাকেই শিশুমন আল্লাহ তার অদ্ভুদ দোয়া কবুল করেছেন বলে ধরে নিয়েছে।
এই শ্রেণীর মানুষদের আমরা উপর থেকে দেখে হা হুতাশ করি। এদের ভেতরে ঢুকলে বেঁচে থাকার জন্য এদের যে তীব্র মানসিক লড়াই সেটা সম্পর্কেও কিছুটা ধারণা পাওয়া যায়।
আমি সুবিন কে বললাম, এখন ত নিশ্চয় তোমাকে কুকুরের সাথে খানা খেতে হয় না! মজনু তোমাকে কত টাকা বেতন দেয়?
আমার প্রশ্নের জবাব দিল না সুবিন। অনেকটা নিজের মনে বলল, আমি অহনো চাইলে বাতাসের সাথে মিশ্যা যাইতে পারি!
প্রবল দুঃখবোধের মধ্যেও এবার আমার হাসি পেল। বেঁচে থাকার তীব্র লড়াই করতে গিয়ে ছেলেটার মাথার মধ্যে কি অসম্ভব একটা ব্যাপার ঢুকে গেছে। সে বিশ্বাস করে বসে আছে যে তার অদৃশ্য হবার ক্ষমতা আছে!
আমি হাসি চেপে বললাম, দেখি বাতাসের সাথে মিশে যাও ত!
সুবিন একবার চোখ ঘুরিয়ে চার দিকে তাকাল। তারপর বলল, খাল পারে চলেন স্যার। খাল পারে কুকুর আছে!
কুকুরের সাথে কি সম্পর্ক?
বাতাসে মিশ্যা যাবার জন্য আশপাশে কুকুর থাকা লাগে।আশপাশে কুকুর না থাকলে আল্লা কথা শুনে না!
খাল পারে কুকুর আছে বুঝলা কেমনে। এখান থেকে খাল পার ত অনেক দূর!
সুবিন আমার এই কথার জবাব দিল না। কথা ঘুরিয়ে বলল, আপনে মুখ ধুইবেন স্যার? টিউবল ডাইব্বা দেই?
আমার প্রবল আপত্তি অগ্রাহ্য করে সুবিন রীতিমত টিউবওয়েলের হ্যান্ডেলের সাথে ঝুলে ঝুলে টিউবওয়েল চাপতে লাগল। আমার চান্দি বহু আগেই ঠাণ্ডা হয়ে গিয়েছে। সুবিনের বাদুড়ঝোলা চাপে বের হয়ে আসা টিউবলের ঠাণ্ডা পানি দিয়ে মুখ ধুতে ধুতে নিজেকে কেমন জানি অপরাধী মনে হল।
মুখ মোছার পর দেখি মাটি কাটার কন্টাক্টর আলহাজ্ব আবু নছর ভুঁড়ি বাগিয়ে আমার দিকেই আসতেছেন। তার মাথার উপর ছাতা ধরে পাশে পাশে হাঁটছে তার চামচা জয়নাল। আবু নছর অতি বিরক্তিকর লোক। দেখা হলেই প্রচুর কথা বলেন যার সারমর্ম হল- উনি চাইলেই বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট হতে পারতেন, শুধু ওদিকে বেশি একটা খেয়াল দেন নাই তাই! ইদানীং আবার স্থানীয় পত্রিকায় জ্বালাময়ী প্রবন্ধ লিখছেন। সেদিন আমাকে সুকুমার রায় এর কাতুকুতো বুড়োর মত জোর করে একটা পড়ালেন। পড়ে আমার বমি আসতে লাগল!প্রবন্ধে অতি নগ্ন ভঙ্গিতে সরকারী দলের চামচামি। লেখা পড়ে নিশ্চিত বোঝা যাচ্ছে বিরোধী দল ক্ষমতায় থাকলেও ভদ্রলোক একই রকম চামচামি করতেন। কলামে লিখে দিতেন, এই সরকার ক্ষমতায় আছে বলেই আজ বাংলার সুর্য পুর্ব দিকে উঠছে। বিরোধী দল থাকলে অবশ্যই পশ্চিম দিকে উঠত!
আবু নছর বিশ গজের মধ্যে আসার আগেই আমি সুবিন কে নিয়ে সামনে আগালাম। আবু নছরের বিরক্তিকর কথা শুনার চেয়ে সুবিন কে নিয়ে খাল পাড়ের দিকে যাওয়া বেটার।হয়ত তুচ্ছ কোন ব্যাপার কে সুবিন অলৌকিক ব্যাপার হিসেবে দেখছে। হয়ত তার ভুল ভাঙ্গিয়ে দেবার একটা সুযোগ ও পাওয়া যাবে।
সুবিন কে সাথে নিয়ে প্রজেক্ট থেকে ধুলা উড়া রাস্তায় নামলাম। ধুলায় পায়ের গোড়ালি পুরাই ডুবে যাচ্ছে। আমার ত পায়ে কেডস আছে। সুবিন খালি পা ডুবিয়েই হাঁটছে। সুবিন দের দেখলে মনে হয় প্রকৃতির অন্যান্য ইতর প্রাণীর সাথে মানুষের আসলেই কোন ইতরবিশেষ নেই! আমি হঠাৎ লুঙ্গি কাছা মারা, খালি পা, বিচিত্র ভঙ্গিতে কোমর বেঁকিয়ে বেঁকিয়ে হাঁটতে থাকা অসম্ভব রোগা ছেলেটার প্রতি প্রচণ্ড মায়া অনুভব করলাম।মনে হল, এ ত আমার ছেলেও হতে পারত। আমার ছেলে হলে স্কুলের অ্যাসেম্বলিতে জাতীয় সঙ্গীত গেয়ে জীবন শুরু করত। দূর্ভাগ্য পীড়িত এতিম হওয়ায় ডাস্টবিনে কুকুরের সাথে খাবার কাড়াকাড়ি করে জীবন শুরু করেছে! আমার চোখ ভিজে গেল। আমি পকেট থেকে টিস্যু পেপার বের করে চোখ মুছলাম।
চোখ মুছে সামনে তাকিয়ে দেখি খাঁ খাঁ করছে ধুলা উড়া রাস্তা। সুবিন কোথাও নাই!
টিস্যু পেপার দিয়ে চোখ মুছতে তিন সেকেন্ডের বেশি কিছুতেই লাগে নাই। রাস্তার বাম পাশে খোলা মাঠ। ডান পাশে খাল। প্রজেক্টের কারনে গাছ টাছ ও সব কেটে ফেলা হয়েছে।সুপার ম্যানের মত দৌড়িয়ে খালে ঝাঁপ দিলেও ত ঝাঁপিয়ে পড়ার শব্দ শুনতাম! আমি খামোকাই জায়গায় দাঁড়িয়ে তিন চার বার লাটিমের মত পাক খেলাম। সুবিন কোথাও নাই!!
আমার মেরুদণ্ড আতঙ্কে ঠাণ্ডা হয়ে গেল। নিরাপদ আড্ডায় যতই ‘ট্রুথ ইজ স্ট্রেঞ্জার দেন ফিকশন’ কপচাই না কেন, গল্প অথবা সিনেমা বাদ দিয়ে বাস্তবে যুক্তির বাইরের কোন ঘটনার মুখোমুখি হওয়া কঠিনের চেয়েও কঠিন। আমি ‘লা ইলাহা ইল্লা আনতা সুবহানাকা ইন্নি কুন্তু মিনাজ জোয়ালেমিন’ পড়ে দ্রুত কাঁপতে থাকা বুকে ফুঁ দিতে দিতে সাইটের অফিসের দিকে হাটতে লাগলাম। অফিসে পৌছাতে পারলে দ্রুত দু’রাকাত নফল নামাজ পড়ব।
খালের উপরের যে বাঁধ টা পার হয়ে প্রজেক্ট থেকে সাইট অফিসে যেতে হয় সেই বাঁধটা জোয়ারের পানিতে ডুবে গেছে। কাজেই আমাকে অনেকখানি ঘুর পথে আসতে হচ্ছে। গরমের মধ্যে খালে অর্ধেক গা ডুবিয়ে একটা কুকুর শুয়ে আছে। খুব স্বাভাবিক কুকুর টাকে দেখেও আমার মনে হচ্ছে যেন কোন অশুভ প্রেতাত্না কে দেখছি!
আমার হৃদ স্পন্দন দ্রুত থেকে দ্রুততর হচ্ছে। আসগর আজিজ নামে আমার এক বন্ধু ছোট গল্প টল্প লিখে। ক’দিন আগে তার ছাপা হওয়া একটা গল্পে সে মানুষের একটা দেয়ালের ভেতর অদৃশ্য হয়ে যাবার ব্যাপার দেখিয়েছে। আমি ফোন করে তাকে কঠিন ঝাড়ি দিয়েছি। বলেছি- ব্যাটা, তুই বিজ্ঞানের ছাত্র হয়ে... আসগার আজিজ অনেকক্ষণ চুপ করে থেকেছে( অনুমান করতে পারি, সে তখন মুচকি মুচকি হাসছিল!)। তারপর বলেছে, দ্যাখ প্রকৃতি সব রহস্যের দরজা কখনো খুলেনা। বেশির ভাগ বন্ধ দরজাই আমরা বেশিরভাগ সময় দেখি না। মাঝে মাঝে দূ’ একটা বন্ধ দরজা প্রকৃতি আমাদের টর্চ মেরে দেখায়। আর আমরা বন্ধ দরজায় মাথা কুটে মরি!
এখন মনে হচ্ছে আসগর আজিজের কথাই ঠিক। পরে পাইল মিস্ত্রি মজনুকে জিজ্ঞেস করলে হয়ত বলবে সুবিন নামে কাউকে সে চিনে না! এটুক ভাবতেই কচি কণ্ঠের জোরালো একটা হাসির আওয়াজ বাঁদিক থেকে কানে আসল।
তাকিয়ে দেখি সুবিন!
যেন মাটি ফুঁড়ে উদয় হয়েছে! আমি তার দিকে তাকাতেই হাসি বন্ধ হয়ে গেল। চেহারায় ফুটে উঠল অদ্ভুদ একটা ভাব। সে ভাবে কিছুটা ছেলেমানুষী আনন্দ। কিছুটা অপরাধবোধের ছাপ!
আমি অসম্ভব দুঃসাহসী হয়ে ডাকলাম, এই সুবিন! এই সুবিন!
নাই!! চোখের সামনে দিয়ে হাওয়ায় মিলিয়ে গেল!
অন্ধকারের একটা পর্দা আমাকে গ্রাস করে নিচ্ছে। জ্ঞান হারানোর মুহুর্তে আমি কুকুরের ঘেউ ঘেউ ডাক শুনতে পেলাম। অদ্ভুদ সেই ডাক- ঘেউ উ উ উ উ...ও! ঘেউ উ উ উ উ...ও! শেষের 'ও' টা ধীরে ধীরে মিলায় না। হঠাৎ করে ফুলস্টপ চলে আসে!
জ্ঞান ফিরতে দেখলাম সাইট অফিসের কেয়ার টেকার শ্যামল বাবুর বিছানায় আমি শোয়া। স্থানীয় ফার্মেসি’র ডাক্তার সাহেব স্টেথোস্কোপ দিয়ে আমার প্রেশার মাপছে।মাথার উপর প্রবল বেগে ফ্যান ঘুরছে।ডাব হাতে মাথার পাশে দাঁড়িয়ে আছে পাইল মিস্ত্রি মজনু মিয়া।
‘প্রচণ্ড গরম সইতে না পেরে ইঞ্জিনিয়ার স্যার মাথা ঘুরে পড়ে গেছে’ এই কথাটা সবাই বলাবলি করছে দেখে স্বস্থি পেলাম। যাক, কারো মনে কোন প্রশ্ন জাগেনি।
কিছুটা ধাতস্থ হয়ে নিতে আবার সুবিনের ঘটনা মাথায় আসন গাড়ল। আমি বুঝলাম এই ঘটনার গ্রহণযোগ্য একটা ব্যাখ্যা না পেলে আমি পাগল হয়ে যাব। আমি বেশ গম্ভীর গলায় বললাম, মজনু মিয়া ছাড়া বাকী সবাই ঘর থেকে বেরিয়ে যান। ডাক্তার সাহেব আই এম সরি। পরে আপনার সাথে কথা বলব।
মজনু মিয়া ছাড়া বাকী সবার সাথে স্থানীয় ফার্মেসী’র ডাক্তার সাহেব ও থতমত মুখে বের হয়ে গেলেন।
মজনু মিয়ার বিস্মিত দৃষ্টি’র দিকে তাকিয়ে আমি কঠোর গলায় বললাম,
মজনু মিয়া! আমি চাইলে তোমার নামে কোম্পানি তে কমপ্লেন দিয়ে তোমার ওয়ার্ক অর্ডার বাতিল করতে পারি এইটা ত জান।
জ্বী স্যার জানি।
তুমি আমাকে সুবিনের ঘটনা বল। তুমি নিশ্চয় জান!
কি ঘটনা স্যার!বাপ মা মরা এতিম ছেলে। ছয় বছর বয়স থেকে আমার সাথে আছে।
সে কি আর দশজন মানুষের মত স্বাভাবিক?
কি বলছেন স্যার!
সে কি মাঝে মাঝে অদৃশ্য হয়ে যেতে পারে?
কাজ ছেড়ে পালানোর কথা বলছেন? জীবনেও না! ও বেঈমান না!
সে কথা বলছি না।
তাইলে কি বলছেন?
ধর সে কাজ করতেছে। কাজ করতে করতে হঠাৎ বাতাসে মিলিয়ে গেল!
আমার চেহারার দিকে তাকিয়ে মজনু মিয়ার চোখের দৃষ্টি ধীরে ধীরে পাল্টে যাচ্ছে। পরিষ্কার বুঝতে পারছি, মজনু মিয়া আমাকে পাগল ভাবছে।
অনেক কষ্টে চেহারায় একটা স্বাভাবিক ভাব ফুটিয়ে তুলে মজনু মিয়া বলল, কিছু মনে করবেন না স্যার। আমার মনে হচ্ছে আপনার রাতে ঘুম কম হইছে। সাইটের কাজ নিয়েও হয়ত টেনশন করতেছেন বেশি। বাসায় গিয়ে রেস্ট নেন। ঠিক হয়ে যাবে।
আমি মজনুর কথায় পাত্তা না দিয়ে বললাম, সুবিন এখন কোথায়?
ও কে ত আমি পাইল ক্যাপের নাম্বারিং করতে দিয়ে আসছি। ডেকে আনব স্যার?
সুবিন কে ডেকে আনার কথা বলাতে আমার এতক্ষণের সঞ্চিত সব সাহস মুহুর্তে উবে গেল। ঘরে সবার মধ্য থেকে সুবিন কে অদৃশ্য হয়ে যেতে দেখলে নির্ঘাত মারা যাব।আমি অভিজ্ঞতা থেকে বুঝে নিয়েছি ‘কুকুর কাছে থাকা লাগে’ অর্থ কুকুর একটা নির্দিষ্ট রেঞ্জের মধ্যে থাকা!একেবারে আশেপাশে নয়। আমি নিচু গলায় মজনু মিয়াকে বললাম, থাক ডাকতে হবে না। আর ওয়ার্ক অর্ডার বাতিলের কথায় তুমি কিছু মনে করনা। ওটা এমনে কথার কথা বলছিলাম!
আমার কথায় মজনু একেবারে গলে গেল। বার বার বলতে থাকল, কি বলেন স্যার! আপনি অসুস্থ মানুষ। এখন আপনার কথায় মাইন্ড করা ত অন্যায়!
মজনু ‘অসুস্থ’ বলতে কি বুঝাচ্ছে সেটা তার কথার টোনে আমি পরিষ্কার বুঝতে পারলাম!
ফেরার সময় মজনু কিছুতেই আমাকে একা ফিরতে দিল না। শ্যামল বাবুকে জোর করে আমার সাথে গাড়িতে উঠিয়ে দিল। শ্যামল বাবুকে ড্রাইভারের পাশে সামনের সীটে বসতে দিয়ে গাড়ির পেছনের সীট পুরোপুরি হেলিয়ে দিয়ে আমি সিটের উপর নেতিয়ে পড়লাম। এসি তেও আমার শরীর প্রচণ্ড রকম ঘামতে লাগল।
গাড়ির একঘেঁয়ে ইঞ্জিনের আওয়াজ কে মনে হচ্ছে যেন গোঁ গোঁ কান্নার আওয়াজ। এ আওয়াজ পৃথিবীর জন্য প্রতিমুহুর্তে অশুভ বার্তা বয়ে আনছে। আমার মনে হচ্ছে সীতাকুণ্ড থেকে চট্টগ্রাম শহরের দূরত্ব যেন এই জীবনে শেষ হবে না।
শ্যামল বাবুর উপরও আমার রাগ হতে লাগল। উনি কিছু কথাবার্তা বললে হয়ত আমার মন একটু হাল্কা হত। উনি গাড়িতে উঠার পর থেকে একেবারে মৌনি ঋষি হয়ে আছেন! হঠাৎ আমার মনের কথা বুঝতে পেরেই যেন শ্যামল বাবু মুখ ঘুরিয়ে আমার দিকে তাকালেন। চোখ থেকে চশমা খুলে নিয়ে চশমার কাঁচ মুছে নিয়ে আবার চশমা চোখে পরলেন। তারপর আড়চোখে একবার ড্রাইভার বাচ্চুর দিকে তাকিয়ে নিয়ে আবার আমার দিকে তাকালেন। বাচ্চু একমনে গাড়ি চালাচ্ছে দেখে যেন নিশ্চিত হলেন। তারপর নিচু স্বরে বললেন,
দুপুরবেলা সুবিনের সাথে আপনাকে হাঁটতে দেখলাম!
আমি সীটে হেলান দেয়া অবস্থা থেকে সোজা হয়ে বসলাম। বললাম, হ্যাঁ!
শ্যামল বাবু অনেকক্ষণ চুপ করে থাকলেন। তারপর আমার দিকে আরো ঝুঁকে এসে বললেন, স্যার আপনি কি অদ্ভুদ কিছু দেখেছেন? মানে সুবিন, মানে!
আমার হৃৎপিণ্ড তখন ধপ ধপ করে লাফাচ্ছে! প্রাণপণে নিজেকে সংযত করে বললাম, আপনি কি সুবিন সম্পর্কে কিছু জানেন? মানে তার মধ্যে কি কখনো অদ্ভুদ কিছু দেখেছেন?
শ্যামল বাবু দ্বিধাগ্রস্ত ভাবে আমার দিকে তাকালেন। দেখলাম উনার কপাল ও ঘেমে উঠছে। পকেট থেকে রুমাল বের করে ঘাম মুছতে মুছতে বললেন-
একদিন দুপুরবেলা সাইটের লোকজন সবাই লাঞ্চে গেছে। সেদিন আমার উপবাস ছিল। ভাবলাম একটু সাইট থেকে হেঁটে আসি। হাঁটতে হাঁটতে পুকুরের জন্য যেখানে মাটি কাটা হয়েছে সেখান পর্যন্ত চলে আসলাম। দেখি পুকুরের পাশে যে ডিপ টিওবওয়েল সেটার পাড়ে সুবিন উবু হয়ে বসে আছে।
আমি বললাম, কিরে সুবিন, ভাত খাইতে যাস নাই?
তাকাই দেখি কোথায় সুবিন! খাঁ খাঁ করছে পুকুর পাড়!
পরে? পরে খোঁজ নিয়ে দেখেন নাই অই সময় সুবিন কোথায় ছিল?
কেউ বলতে পারলনা। কিন্তু এর কিছুক্ষণ পরে সে রান্নাঘরে গিয়ে বাবুর্চির থেকে ভাত চেয়ে নিয়ে নাকি খাইছিল!
আপনি ভয় পান নাই?
না ভয় পাব কেন? ওর সাথে ‘দেও’ আছে।‘দেও’ ওকে মাঝে মাঝে অদৃশ্য করে দেয়!
দেও আছে কিভাবে জানলেন?
আমার প্রশ্নের জবাবে শ্যামল বাবু হাসলেন। দেও ব্যাপার টা যেন ঐশ্বরিক ব্যাপারের মতই কোন ব্যাপার। এ নিয়ে বেশি কথা চলে না!
আপনি এই ঘটনা কাওকে বলেন নাই? ধরেন আর কেউ চোখের সামনে এরকম দেখলে ত আতঙ্কে মারাও যেতে পারে!
বললে ত পাগল ভাববে!
তাইলে কোন অজুহাতে তাকে সাইট থেকে বের করে দিতেন! এরকম একটা ছেলে সাইটে থাকা ত বিপজ্জনক!
ছেলেটার চেহারায় খুব মায়া। বের করে দেবার কথা ভাবতে গেলেই মন টা কেমন যেন কেঁপে উঠে।
শ্যামল বাবুর কথায় আমি বিস্মিত হলাম। কারন সুবিন কে কোন অজুহাতে সাইট থেকে বের করে দেবার কথা যখনি মনে মনে ভাবছি আমার মনেও একই রকম প্রতিক্রিয়া হচ্ছিল।
আরেকটা কথা শ্যামল বাবু, আপনি এই ঘটনা কাউকে বলেন নাই। আগে আমাকেও বলেন নাই। আজ বলে ফেললেন?
শ্যামল বাবু অনেকক্ষণ চুপ করে থাকলেন। তারপর আমার দিক থেকে মুখ ঘুরিয়ে নিলেন। গাড়ির ব্যাক ভিউ মিররে আমাকে দেখতে দেখতে বললেন,
স্যার কেউ কিছু বুঝতে না পারলেও আমি ঠিক ই বুঝতে পেরেছি আজকে কি ঘটেছে!
শ্যামল বাবু, আপনি যেদিন সুবিন কে অদৃশ্য হয়ে যেতে দেখলেন সেদিন আশেপাশে কি কোন কুকুর ছিল?
কুকুর দেখি নাই। কিন্তু সে অদৃশ্য হবার পর দেও কে ডাকতে শুনেছি। থেমে থেমে কুকুরের গলায় দেও ডাকছিল!
যানজটে গাড়ি থেমে আছে। বাচ্চু সামনের রডের ট্রাকের দিকে তাকিয়ে খামাখাই হর্ন দিচ্ছে। আমার মনে হতে লাগল, বন্ধু আসগরের কথাই হয়ত ঠিক- প্রকৃতি মাঝে মাঝে তার রহস্যের দূ’ একটা বন্ধ দরজা আমাদের টর্চ মেরে দেখায়। আর আমরা সেই বন্ধ দরজায় মাথা কুটে মরি!