আপন লেখনী দিয়ে যারা কালের খেয়ায় জায়গা করে নিতে চান। চারপাশটা আলোকিত করে দিতে চান। যাদের ইচ্ছা হয় উত্তরসূরিদের কাছে নিজের বার্তা রেখে যেতে। যাদের ইচ্ছা হয় একটা অথবা অনেকগুলো বই প্রকাশ করে ইতিহাসের পাতায় একটু হলেও জায়গা করে নিতে। এই লেখা তাদের জন্য। হ্যাঁ। এই লেখা সেই সব স্বপ্নবাজ নবীন লেখকদের জন্য।
বইমেলায় বইয়ের সংখ্যা দেখে আমাদের যেমন উচ্ছ্বাস আসে। মান দেখে দীর্ঘশ্বাসও আসে। মান যদিও সন্তুষ্ট করে বইয়ের কাটতি হতাশ করে। নবীন লেখকরা যে উদ্যম নিয়ে বই প্রকাশ করেন, মেলা শেষে সে উদ্যম তলানিতে নামে। কেন এমন হচ্ছে? প্রযুক্তিতে, আধুনিকতায়, সুযোগ সুবিধায় ঈশ্বরচন্দ্র বঙ্কিমের চেয়ে আমরা কোন দিক দিয়ে পিছিয়ে? তারা সাহিত্যে নতুন ধারা তৈরি করেছেন, সমাজকে নতুন রূপ দিয়েছেন। আমরা কেন পারছি না? যদি বলেন আমাদের মেধায় কমতি রয়েছে। তবে তা আমি একদমই মানব না। কারণ সৃষ্টিকর্তাকে আমি অতখানি অবিবেচক মানতে নারাজ যে তিনি এক যুগকে যাবতীয় মেধাবী ঢেলে দেবেন আর এক যুগকে শূণ্য হাতে ফেরাবেন।
যদি বলেন মানুষ সাহিত্যবিরাগী বা বই বিরাগী হয়েছে। এখানে আমার প্রশ্ন আছে, তবে মানুষ অনুরাগী হয়েছে কিসে? যাতে অনুরাগী হয়েছে তার সাথে পাল্লা দিন। নিজের ক্ষমতাকে শাণ দিন। নিজেকে প্রস্তুত করুন বাস্তবিকই পাঠকের মনে জায়গা করে নেওয়ার মত করে।
মেপে জুখে, নিয়ম মেনে অথবা জোর করে যেমন লেখালেখি হয় না, তেমন কিছু মন্ত্র রয়েছে যা ভাল লেখক হওয়াকে অনেকখানি নিশ্চিত করে। তবে জানা যাক সে মন্ত্র?
আগে নিজেকে প্রশ্ন করুন আপনি কেন লিখিতে চান পরামর্শ স্বরূপ আমেরিকান লেখক জন গ্রিন বক্তব্যই তুলে দিচ্ছি,
“শুধুমাত্র টাকা উপার্জনের জন্য লিখবেন না। কারণ কখনোই আপনার যথেষ্ট টাকা উপার্জন হবে না। এবং বিখ্যাত হবার বাসনাতে লিখবেন না। কারণ কখনোই আপনি যথেষ্ট বিখ্যাত অনুভব করবেন না। মানুষের জন্য উপহার তৈরী করুন। এই উপহার গুলো তৈরী করতে কঠোর পরিশ্রম করুন যাতে লোকজন তা লক্ষ্য করে এবং পছন্দ করে।
হয়ত তারা বুঝতে পারবে আপনি কত কঠোর পরিশ্রম করেছেন । হয়ত পারবে না। তারা যদি লক্ষ্য না করে, তাহলে আমি বুঝতে পারছি এটা হতাশাজনক। কিন্তু আসলে মূল ব্যাপারটা হল, এতে কোন কিছুর পরিবর্তন হয় না। কারণ আপনার দায় দায়িত্ব মানুষের উপর না, যে উপহার আপনি তৈরী করেছেন, তার উপর”।
সাথে বঙ্কিমচন্দ্রের কথাটাও যোগ করা উচিৎ,
'যদি মনে এমন বুঝিতে পারেন যে, লিখিয়া দেশের বা মনুষ্যজাতির কিছু মঙ্গল সাধন করিতে পারেন, অথবা সৌন্দর্যসৃষ্টি করিতে পারেন, তবে অবশ্য লিখিবেন। যাহারা অন্য উদ্দেশ্যে লেখেন, তাহাদিগকে যাত্রাওয়ালা প্রভৃতি নিচ ব্যবসায়ীদের সঙ্গে গণ্য করা যাইতে পারে।'
কমপক্ষে ১০ বছরের পরিকল্পনা করুন আমাদের সবচেয়ে বড় মানসিক ত্রুটি হল আমরা খুব দ্রুত কর্মফল আশা করি। কখনো কখনো কাজের তুলনায় বেশি ফল পাওয়ার স্বপ্ন দেখি। কিন্তু বাস্তবতা আর স্বপ্ন ভিন্ন জিনিস। যদি আজ থেকে আপনি লিখতে চান তবে আগামী ১০ বছরের একটি ছক একে ফেলুন। এবং প্রতিমাসে অথবা অন্তঃত ৩ মাস পর পর নিজের কাজ যাচাই করুন যে আপনি প্লান অনুযায়ী আগাচ্ছেন কিনা। লেখালেখিতে কমপক্ষে ১০ বছরের আগে বিচলিত হওয়া উচিৎ নয়।
কথা কম, শোনা বেশি সাধারণ মানুষের আবেগ অনুভূতি বুঝতে হলে, সাইক্লোজি জানতে হলে, কথা শোনার এবং তা গভীর উপলব্ধি করার কোন বিকল্প নেই। আমি মনে করি যার উপলব্ধি ক্ষমতা যত বেশি সে তত বেশি ভাল লিখতে পারে।
লিখতে হলে পড়তে হবে এ বিষয়ে কারো দ্বিমত নেই নিশ্চয়? লেখক হতে হলে আগে পাঠক হতে হয়, একথা কারো অজানা নয়। তাই নিয়মিত পড়ুন। সমৃদ্ধ হোন। যেকোন বিষয়ে সফলতা পেতে হলে পরিশ্রমের কোন বিকল্প নেই।
মনে উকি দেওয়া আইডিয়াগুলো টুকে রাখুন দৈনিক অসংখ্য কথার মাঝে, অগণিত ভাবনার মাঝে কত ভাবনা যে হারিয়ে যায়! আমরা ভুলে যায়। সকালে হয়ত কোন গল্পের প্লট অথবা কবিতার ভাব মনে এল। তারপর আপনি আপনার নিত্যদিনকার কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। সন্ধ্যায় আপনার মন থেকে সকালের ভাবনা হারিয়ে যাবে, হয়ত মনে করতে পারবেন না। তার থেকে বরং মনে ভাবনা আসার সাথে সাথে তাকে বন্দি করে ফেলা ভাল না?
লিখতে হলে লিখতে হবে ধরুন,আমি গাছের চারা কিনে আনলাম, আর স্বপ্ন বুনতে থাকলাম যে এই গাছ একদিন অনেক বড় হবে, আমায় ফল দেবে, কিন্তু চারাটি রোপনই করলাম না। হাস্যকর বোকামি না? লেখক হতে চেয়ে লেখাই অলসতাও ঠিক একই রকম বোকামি। প্রচুর লিখুন। লেখা মাথায় না আসলে প্রিয়জনের কাছে একটা চিঠিই অন্তত লিখুন। লেখাকে নিত্যদিনকার অভ্যাস বানিয়ে ফেলুন।
নির্জনতা প্রয়োজন আধুনিকতার এই ব্যস্ত বগীতে আমরা একেকজন মাল্টি টাস্কার যাত্রী। নির্জন অবসর সময় বড় দুর্লভ। হয়ত টিভি দেখছি, লিখছি আবার পরিবারকে সময়ও দিচ্ছি। দয়া করে লেখাকে অতখানি অবহেলা করবেন না। লেখার জন্য এমন সময় নির্বাচন করুন, যে সময়টাতে আপনি নির্জনতায় ভর করে লেখার মাঝে ডুবে যেতে পারেন।
আগে লেখার কাঠামো নির্মাণ শক্ত নাকি নরম, সরল নাকি আঁকাবাঁকা কিভাবে লিখবেন তা লেখকের একান্তই নিজস্ব ব্যাপার। কিন্তু একটা ব্যাপারে খেয়াল রাখা জরুরী, শুরু আর শেষ এর মাঝে যেন যোগসূত্র থাকে। লিখতে লিখতে খেই হারানোর আগে শেষ এর কল্পনা করে নেওয়াই উত্তম নয় কি?
সৃজনশীলতা হোক লেখার মূলনীতি লেখক মাত্রই একজন শিল্পী। যিনি নিত্য নতুন প্যাটার্ন এর সাথে রঙ বেরঙের শব্দ মিলিয়ে অভিনব কিছু তৈরি করেন।
এক্ষেত্রে কবিগুরুর এই কথাটি চলে আসে,
আধুনিকতা ‘বিষয়’-কে নির্দেশ করে না, ‘নবরূপ’-কে নিয়ে সাহিত্যের আধুনিকতা বিনির্ণীত হবে। এ প্রসঙ্গে তাঁর উপস্থাপন, ‘পূর্বযুগের সাহিত্যই হোক, নবযুগের সাহিত্যই হোক, চিরকালের প্রশ্নটি হচ্ছে এই যে, হে গুণী কোন অপূর্ব রূপটি সকল কালের জন্য সৃষ্টি করলে।’
নিজেকে লেখক মানুন আপনি যদি মন থেকে চান একজন লেখক হতে তবে মনকে কুঁকড়ে রাখবেন না। যেকোন কাজে সফলতা পেতে, চাই আত্মবিশ্বাস। আপনি যে একজন লেখক সে কথাটি নিজেকে প্রতিনিয়ত বলুন। অন্যের কাছে নিজের লেখক পরিচয়টিও তুলে ধরুন।
ভাঙ্গা গড়া আর ঘষামাজার মাঝেই লেখার সৌন্দর্য লেখালেখিকে আমি হীরার সাথে তুলনা করি। একে যত বেশি সতর্কভাবে কাটা যাবে ততই দ্যুতি বাড়বে। অবশ্যই আপনি চান? আপনার লেখার মান উন্নত হোক? আপনার লেখা আলো ছড়াক? অন্যের মনে জায়গা করে নিক? এর জন্য লেখা বার বার সংশোধনের বিকল্প নেই।
পাঠক তৈরি করুন আপনি কেমন লিখছেন, অন্যরা তা কিভাবে নিচ্ছে এসব জানতে হলে লেখা অন্যকে দিয়ে পড়াতে হবে। যে লেখালেখি করেন, সে বিষয়ে জ্ঞান, অথবা যে কিছুই জানেন না শুধু তার অনুভূতি প্রকাশ করে আপনাকে উৎসাহ দেবেন এমন সকল লোক দিয়ে আপনার লেখা পড়ান। এগো টেগো ভুলে নিজের লেখা অন্যের হাতে তুলে দিন মূল্যায়নের জন্য।
পরামর্শ এবং সমালোচনাকে আশীর্বাদ হিসেবে নিন হতে পারে আপনার লেখা পাঠকের আকাঙ্ক্ষা থেকে ভিন্ন, হতে পারে আপনাকে শুধু হেয় করার জন্যই কেউ সমালোচনা করছে, হতে পারে বাস্তবিকই আপনি খারাপ লিখেছেন তাই শোধরানোর পরামর্শ দিচ্ছে। এক্ষেত্রে উচিৎ হল অতি উত্তেজিত না হয়ে আবার একেবারে আত্মবিশ্বাস না হারিয়ে সমালোচনা বা পরামর্শকে বিচার করা। তা সঠিক হলে কৃতজ্ঞতার সাথে গ্রহণ আর ভুল হলে বিনয়ের সাথে প্রত্যাখ্যান করা।
অবশ্যই ভিন্ন পেশায় যুক্ত থাকতে হবে এ আমার নিজস্ব মতামত। লেখক প্রতিকূল আমাদের এ দেশে লেখালেখির পাশাপাশি জীবনকে চালিয়ে নেওয়ার মত কিছু একটা করা উচিৎ। প্লান মাফিক ১০ বছর চলার পর আপনি যখন প্রতিষ্ঠিত লেখক তখন হয় শুধু লেখালেখি করলেন। কিন্ত প্রথম কমপক্ষে ১০ বছর আপনাকে সংগ্রাম করা লাগবেই। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের সেই সতর্কবাণী আর পরিণতি ত সকলের জানা,
“দুটো ভাত কাপড়ের ব্যবস্থা না করে কেউ যেন সাহিত্যে না আসে।”
অচিন্ত্যকুমারের এ কবিতাটি নতুন লেখকদের অনুপ্রাণিত করবে আশা করি,
এ মোর অত্যুক্তি নয়, এ মোর যথার্থ অহঙ্কার,
যদি পাই দীর্ঘ আয়ু, হাতে যদি থাকে এ লেখনী,
কা’রেও ডরি না কভু; সুকঠোর হউক সংসার,
বব্ধুর বিচ্ছেদ তুচ্ছ, তুচ্ছতর বন্ধুর সরণি !
পশ্চাতে শত্রুরা শর অগণন হানুক ধারালো.,
সম্মুখ থাকুন বসে’ পথ রুধি’ রবীন্দ্র ঠাকুর,
আপন চক্ষের থেকে জ্বালিব যে তীব্র তীক্ষ্ণ আলো
যুগ-সূর্য ম্লান তা’র কাছে | মোর পথ আরো দূর !
গভীর আত্মোপলব্ধি --- এ আমার দুর্দান্ত সাহস,
উচ্চকন্ঠে ঘোষিতেছি নব নর-জন্ম-সম্ভাবনা ;
অক্ষর তুলিকা মোর হস্তে যেন রহে অনলস,
ভবিষ্যৎ বত্সরের শঙ্খ আমি ---- নবীন প্রেরণা !
শক্তির বিলাস নহে, তপস্যায় শক্তি আবিষ্কার,
শুনিয়াছি সীমাশূন্য মহা-কাল-সমুদ্রের ধ্বনি
আপন বক্ষের তলে ; আপনারে তাই নমস্কার |
চক্ষে থাক্ আয়ু-উর্মি, হস্তে থাক্ অক্ষয় লেখনী!
পরিশেষ পাঠ্যাভ্যাস গড়ে তোলার পাশাপাশি লেখক অনুকূল পরিবেশ ও লেখক পাঠক সম্পর্ক নির্মাণ হোক বই দিবসের প্রতিপাদ্য।
সূত্রঃ
view this link
view this link
view this link
view this link
সতর্কীকরণ কিছু অনলাইন পোর্টাল ও ব্লগে আমার কয়েকটি লেখা, আমার নাম ছাড়াই প্রকাশ হয়েছে দেখলাম। আমি সতর্ক না করে কাউকে অপদস্থ করতে চাই না। লেখা চোরদের প্রতি সতর্কবাণী এ যে আমার আগামী কোন পোষ্টে নিজের ছবি অথবা অনলাইন ঠিকানা চোর হিসেবে দেখতে না চাইলে এই পোষ্ট চুরি করবেন না।
সর্বশেষ এডিট : ২২ শে এপ্রিল, ২০১৭ সন্ধ্যা ৭:০৬