গতকাল ছিল নিরস্ত্র মানুষের উপর গুলিচালনার সেই কুখ্যাত ঘটনার শতবর্ষ। শুধু রাজনীতিতে নয়, সাহিত্যেও তা রেখে গিয়েছে এক চিরস্থায়ী ছাপ। কবিতা, ছোটগল্প থেকে শুরু করে নাটক-উপন্যাসেও তারই প্রতিধ্বনি।
গৌতম চক্রবর্তী
১৪ এপ্রিল, ২০১৯,
ভাইয়ের বুলেটবিদ্ধ শরীরের রক্ত শুকোয়নি, তবু শামসাদ আর আলমাস সে দিন সাহেবদের সামনে নাচতে বাধ্য হয়েছিল। শামসাদ আর আলমাসকে আপনারা চেনেন না। আমাদের অমৃতসর শহরের নামকরা নাচনেওয়ালি।
থাইলা ওদেরই সহোদর। বেশ্যার ছেলে, বেশ্যার ভাই। কাজটাজ করত না। দিদিদের টাকায় মদ-জুয়ো আর বাবুয়ানি ছিল তার জীবন।
সেই সময়েই রক্তগঙ্গা শুরু। ১৩ এপ্রিলের জালিয়ানওয়ালা বাগ তখনও ঘটেনি। গাঁধীজি রাওলাট-সত্যাগ্রহকে আরও জোরদার করার জন্য অমৃতসরের পথে ট্রেনে দিল্লি রওনা হন। কিন্তু তার আগে পলওয়াল নামে এক ছোট্ট স্টেশনে ব্রিটিশ পুলিশ তাঁকে থামিয়ে বোম্বাই ফেরত পাঠিয়ে দিল।
সেটাই শুরু। ৯ এপ্রিল সন্ধ্যার মধ্যে অমৃতসরের ডেপুটি কমিশনারের কাছে দুই নেতা সত্যপাল ও কিচলুকে শহরছাড়া করার নির্দেশ এসে গেল। ডেপুটি কমিশনার প্রথমে রাজি ছিলেন না। খবরটা ছড়াতেই দলে দলে লোক ওঁদের মুক্তির দাবিতে পথে নামল। কিন্তু তখন কে কার কথা শোনে?
সাহেবদের বাংলো, অফিস, সবই ব্রিজ পেরিয়ে, শহরের ও দিকে, ‘সিভিল লাইন্স’-এ। সেই ব্রিজের পাহারায় তখন বন্দুক হাতে কয়েক জন গোরা সৈন্য। শহরময় হট্টগোল, রাস্তায় নানা কথা বলাবলি। এক জন বলে, ‘‘চল, পুলিশ-থানায় আগুন লাগিয়ে দিই।’’ অন্য জনের পরামর্শ, ‘‘তা হলে ব্যাঙ্কগুলোতেও আগুন দিই।’’ একটা চেনা গলা বলল, ‘‘তাতে কী হবে? চল, ব্রিজের ওপর গোরা সৈন্যগুলোকে খতম করে আসি।’’ চেনা গলা। বেশ্যার ছেলে, বেশ্যার ভাই সেই থাইলা।
স্লোগান দিতে দিতে ব্রিজের মুখে এসে পড়েছে থাইলা। ব্রিজের দু’ধারে দাঁড়িয়ে থাকা গোরা সৈন্যরা তাকে লক্ষ্য করে গুলি চালাল। থাইলার বন্ধুরা তত ক্ষণে পগার পার।
গুলি খেয়ে আহত সিংহের মতো টলতে টলতে থাইলা এগিয়ে গেল। তার জামা তত ক্ষণে রক্তে লাল। সেই অবস্থাতেই সে প্রাণপণ শক্তিতে এক ঘোড়সওয়ার সৈন্যের গলা টিপে ধরল। সঙ্গীকে বাঁচাতে ফের আর এক গোরা সৈন্যের বুলেটবর্ষণ। ঝাঁজরা হয়ে গেল থাইলার শরীর। কিন্তু ওই যে, এক সৈন্যের গলা টিপে ধরেছিল! সে বেচারির নিথর, নিস্পন্দ দেহ তখনও থাইলার হাতে।
পুলিশ পর দিন দেহটা পাঠিয়ে দিয়েছিল। বাইজি-মহল্লায় তখন কান্নার রোল।
কান্নার আয়ু কত ক্ষণ? দিন দুয়েকের মধ্যে এক দালাল সাহেবদের কানে শামসাদ আর আলমাসের খবর পৌঁছে দিল। ভাইয়ের মৃত্যুর দু’দিনও কাটেনি, সাহেবরা খবর পাঠাল, ‘‘অনেক দিন মৌজ-মস্তি হয়নি। দুজনেই এসে নাচ দেখিয়ে যাও তো!’’
দু’বোনই সে দিন পরির মতো সেজে সাহেবদের আড্ডায় গেল। চোখে সুর্মা, অলঙ্কার-ভরা গায়ে আতরের খুশবু। এক দিকে তাদের নাচগান, অন্য দিকে মদের ফোয়ারা। রাত দুটোয় এক সেনা-অফিসার বলল, ‘‘শেষ করো।’’
শেষ? দুই বোন সঙ্গে সঙ্গে শরীর থেকে খুলে দিল যাবতীয় আবরণ ও আভরণ। নগ্ন অবস্থায় তারা চেঁচিয়ে উঠল, ‘‘আমরা থাইলার দিদি। তোমরা ওর শরীরে বুলেট ভরেছ। এস, আমাদের শরীরে তোমাদের শরীরের গরম সিসে ঢালবে না? থু থু!’’
উর্দু ভাষার ছোটগল্পকার সাদাত হাসান মান্টোর এই গল্পের নাম ‘১৯১৯ সালের একটি ঘটনা’। কাশ্মীরি পরিবারের ছেলে মান্টো জালিয়ানওয়ালা বাগের ঘটনার সাত বছর আগে পঞ্জাবের লুধিয়ানায় জন্মেছিলেন। তাঁর লেখাতে এ ভাবেই এসেছে সে দিনের কথা।
জালিয়ানওয়ালা বাগ নিয়ে এই সব গল্প কি আজও নয় ভারতীয় সাহিত্যের প্রতিভূ? গল্প তো শুধু ১৯১৯ সালেই শেষ হয় না। এই পাঠের শেষে আমাদের মনে আচমকা হানা দেয় সত্তর দশকে লেখা মহাশ্বেতা দেবীর ‘দ্রৌপদী’। জোতদারকে খুন করে পালিয়ে-যাওয়া দোপ্দি মেঝেনকে গ্রেফতার করেছিল সশস্ত্র বাহিনীর কমান্ডার অর্জুন সেনানায়ক। আদিবাসী রমণীকে সে পাঠিয়ে দেয় অধস্তন অফিসারদের কাছে। গারদের ভিতরে দোপ্দি মেঝেনের শরীরটাকে নিয়ে ছিনিমিনি খেলে তারা। অতঃপর গল্পের শেষে মান্টোর শামসাদ আর আলমাসের মতোই নগ্ন দোপ্দি মেঝেন সেনানায়কের সামনে দাঁড়িয়ে। কমান্ডার ভয়ে চোখ বুজে ফেলে। সময়ের তফাত, ভাষা ভিন্ন, সমাজটাও ভিন্ন। তবু ভারতীয় সাহিত্য মানে যেন একটাই বই। সেখানে একটা গল্প মিলেমিশে বেঁকেচুরে ধাক্কা খায় অন্যটার সঙ্গে।
মান্টোর ওই ‘১৯১৯ সালের একটি ঘটনা’ গল্পের শেষটা যেমন! চলন্ত ট্রেনে এক ভদ্রলোক মান্টোকে শামসাদদের গল্পটা বলছিলেন। লেখক শেষে জানান, ‘‘কিন্তু আপনার স্বরে বেদনা টের পেলাম। গল্পের শেষটা কি বানানো?’’
লোকটা ট্রেনের জানলা দিয়ে থুতু ফেলল, ‘‘হ্যাঁ, ঠিক ধরেছেন। কুত্তি দুটো সে দিন নেচেছিল। শহিদ ভাইয়ের সম্মান ধুলোয় মিশিয়ে দিয়েছিল।’’
অসহায়তার এই গল্প গায়ে কাঁটা দেয়। কিন্তু ওই শহিদ-শ্রদ্ধালু, দেশপ্রেমী মেয়েদের যে ভাবে ‘কুত্তি’ বলে সম্বোধন করে, সেটাই ভারতীয় গল্প!
হিন্দি ভাষার অন্যতম নাট্যকার ভীষ্ম সাহনির ‘রং দে বসন্তী চোলা’ নাটকের কথাও ধরতে পারেন। নাটকের শুরুতে বৈশাখী মেলা থেকে ফিরে আসা মেয়েরা বলাবলি করে, ‘‘কী মজা! চুলের ক্লিপ, চুড়ি, কত কী পাওয়া যাচ্ছে।’’ সাহিত্যই জানিয়ে দেয়, প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর ১৯১৯ সালের অমৃতসরে কী ভাবে ঢুকে পড়ছিল শৌখিন পণ্য।
কিন্তু রতন দেবীর স্বামী সে দিন জালিয়ানওয়ালা বাগ থেকে ফেরেনি। সেনারা চলে যাওয়ার পর, অন্ধকার কারফিউয়ের মধ্যে স্বামীকে খুঁজতে বেরোয় রতন দেবী, তার পর এক সময় অন্ধকার মঞ্চে সে চেঁচিয়ে ওঠে, ‘‘পেয়েছি। কত বার বলি, বসে থাকো। কিন্তু চুপ করে বসে থাকা ওর ধাতে নেই। এখন দেখো, রক্তে মাখামাখি হয়ে কেমন ঠান্ডা হয়ে শুয়ে আছে।... যাও, আমি কাঁদব না। তোমার যাওয়ায় বাধা দেব না।’’
ইতিহাস বলে, রতন দেবী বাস্তব চরিত্র। সে দিন ডায়ারের গুলিতে তাঁর স্বামী চাজ্জু ভগৎ খুন হয়েছিলেন, রাতের অন্ধকার জালিয়ানওয়ালা বাগে স্বামীর মরদেহ আগলে বসেছিলেন মহিলা। পঞ্জাবি কবি জ্ঞানী হিরা সিংহ গর্দের কবিতায় আছে, ‘স্বামীর মাথা কোলে/ সারা রাত রতন দেবী কাঁদে।’ এই ভাবেই সে দিনের বাস্তব চরিত্রেরা চলে আসে কবিতায়, নাটকে। আর ভীষ্ম সাহনির নাটকে অন্ধকার মঞ্চে স্বামীর শব কোলে স্ত্রীর ওই আক্ষেপ তো মহাভারতের সৌপ্তিক পর্বকে মনে পড়িয়ে দেয়। সেখানে কৌরবপক্ষের বীর ভূরিশ্রবার ছিন্ন বাহু দেখে তার স্ত্রী গড়াগড়ি খায়, কুন্তী সহসা এসে ছেলেদের বলেন, ‘‘বৎসগণ, কর্ণের জন্য জলাঞ্জলি দাও। সে তোমাদের জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা ছিল।’’ রামায়ণ, মহাভারত, মিথ সবই যেন ভারতীয় ভাষাসাহিত্যে নিরুচ্চার ঢুকে পড়ে সে দিনের ট্রাজিক উপস্থাপনায়।
এই মিথকে এড়িয়ে যেতে পারেননি ইংরেজিভাষী ভারতীয় লেখকও! ১৯৭৭ সালে ইংরেজিতে সাহিত্য অকাদেমি জয়ী লেখক চমন নাহালের ‘দ্য ক্রাউন অ্যান্ড দ্য লয়েনক্লথ’ নামের উপন্যাস যেমন। নামেই মালুম, গাঁধীকে নিয়ে উপন্যাস। সেখানে ১৩ এপ্রিল দুপুরে ডায়ার ছাউনির সেনাদের রাইফেল প্র্যাকটিস করতে বলে। তার পর ভাবে, ‘হ্যাঁ, অর্জুনটা কে বেশ? রামায়ণের নায়ক। ওর ছেলের নাম অভিমন্যু, বউয়ের নাম সীতা।’ পরের লাইন, ‘ভারতীয় মিথে তার ব্যুৎপত্তি ভেবে ডায়ার খুশি হল, নিজেই নিজের পিঠ চাপড়ে দিল।’ আর আমরা শিউরে উঠি। ইতিহাস বলে, ব্রিগেডিয়ার জেনারেল রেজিনাল্ড ডায়ারের জন্ম এই ভারতবর্ষেই, মুরি শহরে। তার পরেও এ ভাবে চেনা মহাকাব্য গুলিয়ে যায় তাঁর কাছে? বোঝা যায়, যাবতীয় পুরাণ তছনছ করে উপন্যাস এগিয়ে চলেছে নিরস্ত্র মানুষের উপর গুলিচালনার নতুন পুরাণকল্প তৈরির দিকে। এখানেই সাহিত্যের বাস্তবতা!
মিথ কি শুধুই রামায়ণ, মহাভারত আর পুরাণের গল্প? ভারতীয় আধুনিকতাও কি নয় জগাখিচুড়ি এক পুরাণকল্প? ১৯১৯ সালের ৭ এপ্রিল, অমৃতসরে হরতালের মধ্যেই ইংরেজি-শিক্ষিত ডাক্তার আদম আজিজ তার বউ নাসিমকে বলেছিল, ‘‘কাশ্মীরি নয়, তোমাকে আধুনিক ভারতীয় মেয়ে হয়ে উঠতে হবে।’’ দূরে এক ছাউনিতে ডায়ার নামের এক জন তখন গোঁফে তা দিচ্ছেন।
হরতাল ও হট্টগোলের মধ্যে তার ডাক্তারি ব্যাগ নিয়ে আদম আজিজ বেরিয়ে যায়। যখন ফেরে, সাদা জামায় লাল ছোপ ভর্তি। নাসিম শিউরে ওঠে, ‘‘ওফ, রক্ত লাগিয়ে আনলে?’’ আজিজ হাসে, ‘‘রক্ত নয়, ওষুধ। মারকিউরোক্রোম। আহতদের কাটাছেঁড়ার চিকিৎসায় লাগে।’’
১৩ তারিখ বিকেলে জালিয়ানওয়ালা বাগে গিয়েছিল ডাক্তার আজিজ। দু’পাশে ৫০ জন রাইফেলধারী গোর্খা ও বালুচ সৈন্য নিয়ে ডায়ার তখন ঢুকে আসছে পার্কের সরু মুখটায়। র্যাট ট্র্যাট র্যাট ট্র্যাট... ১৬৫০ রাউন্ড গুলি। ডাক্তার আজিজের নাক সুড়সুড় করে, হাঁচির দমকে উল্টে পড়ে। আর তখনই টের পায়, তার উপরে কাটা কলাগাছের মতো আছড়ে পড়ছে একের পর এক রক্তাক্ত শরীর। রাতে কোনও মতে বাড়ি ঢুকতেই ‘আধুনিক ভারতীয় স্ত্রী’ আঁতকে ওঠে, ‘‘ফের জামায় মারকিউরোক্রোম ফেলেছ?’’ ‘‘না, রক্ত,’’ ক্লান্ত স্বরে জবাব দেয় আজিজ। সলমন রুশদির ‘মিডনাইট’স চিলড্রেন’ উপন্যাসে এ ভাবেই জালিয়ানওয়ালা বাগ আসে, রক্ত এবং মারকিউরোক্রোমকে একাকার করে দেওয়ার জাদুবাস্তবতায়।
এই জাদুবাস্তবতা অনেক পরে। অমিতাভ বচ্চনের প্রথম ছবি ‘সাত হিন্দুস্থানি’র পরিচালক খাজা আহমদ আব্বাস কান চলচ্চিত্র উৎসবে এক বার পুরস্কার পেয়েছিলেন। রাজ কপূরের ‘শ্রী ৪২০’, ‘আওয়ারা’ থেকে ‘ববি’— অনেক ছবির গল্পই তাঁর লেখা। এই খাজা আহমদ আব্বাসের ‘ইনকিলাব’ উপন্যাসে বালক আনোয়ার তার বন্ধু রতনের সঙ্গে এপ্রিলের ১৩ তারিখ জালিয়ানওয়ালা বাগে যায়। বিকেল সাড়ে ৪টা। চার দিকে চিৎকার, ‘ইনকিলাব জিন্দাবাদ’। স্লোগানের মানে দুই বালক জানে না, কিন্তু তাদের বুকে দ্রিমিদ্রিমি বাজে। জমাদার অজিত সিংহ খুঁজতে খুঁজতে বাগানে আসে, ‘‘আরে, তোমরা এখানে! চলো, ঘরে চলো।’’
এই সময়েই ডায়ার সৈন্যদের সঙ্গে ঢুকে আসেন। অজিত সিংহ গুলিবর্ষণের মধ্যে ছুটতে থাকে, ‘‘ও জার্নেল (জেনারেল) সাহেব, তোমরা কি পাগল হয়ে গিয়েছ? নিরস্ত্র মানুষের ওপর এই ভাবে গুলি চালানো যায় না। সাহেব দেখো, আমি তোমাদের হয়ে মহাযুদ্ধে গিয়েছি।’’ এক ইংরেজ অফিসারকে দেখে ছুটে যায় অজিত, ‘‘সরকার, আপনি মা-বাপ।’’ অভ্যাসবশত তার ডান হাত স্যালুটের ভঙ্গিতে কপালে গিয়ে ঠেকে। আর তখনই একটা বুলেট তাকে ছিন্নভিন্ন করে দেয়। পঞ্জাবের যে সৈন্যরা প্রথম মহাযুদ্ধে ব্রিটিশের হয়ে লড়তে গিয়েছিল, ব্রিটিশ শাসকের বিশ্বাসঘাতকতায় তাদের হতচকিত ভাব গল্পে স্পষ্ট।
হিন্দু রতন আর বালক আনোয়ারের বন্ধুত্ব? একশো বছর পরেও ওটাই জালিয়ানওয়ালা বাগের ঐতিহ্য। ডায়ারের গুলিচালনা সে দিন হিন্দু-মুসলমান-শিখ সকলের বুকের মধ্যে সমান তালে আগুন জ্বালিয়েছিল। নারী-পুরুষ ভেদ ছিল না। কৃষণ চন্দরের ‘অমৃতসর, আজাদি সে পহলে’ রচনাতেও তার প্রতিধ্বনি। অমৃতসরের একই এলাকায় থাকে সাদ্দিক আর ওমপ্রকাশ। সাদ্দিক গরিব, তার বাবার ছোটখাটো চামড়ার ব্যবসা। ওমপ্রকাশ বড়লোক, বাবা ব্যাঙ্কার। এক পাড়ায় থাকলেও দুজনে তাই বন্ধু নয়। পরস্পরের পরিচিতমাত্র।
অভিশপ্ত ১৩ এপ্রিলের বিকেলে দুই প্রতিবেশীর দেখা হয়ে যায় জালিয়ানওয়ালা বাগে। তার পরেই শুরু বুলেটবৃষ্টি। সিদ্দিক আর প্রকাশ দুজনে পাঁচিল টপকে পালানোর চেষ্টা করে। সিদ্দিক প্রকাশকে টেনে তোলে, ‘‘আসুন প্রকাশজি, লাফান।’’ কিন্তু প্রকাশ আর সাড়া দেয় না। পাঁচিল টপকানোর সময়েই বুলেট গেঁথে গিয়েছে তার পিঠে। সিদ্দিকও তত ক্ষণে আহত, রক্তাক্ত। প্রকাশের মরদেহ কাঁধে নিয়ে সে মহল্লার দিকে চলতে থাকে, তার পর এক সময় নিজেও মাটিতে লুটিয়ে পড়ে।
ওই সন্ধ্যাতেই বাজার থেকে সব্জি কিনে বেগম, পারো, জয়নাবের মতো চার মহিলা কুখ্যাত সেই গলির সামনে পৌঁছয়। তাদের কেউ মুসলমান, কেউ শিখ, কেউ বা হিন্দু। গলির মুখে দাঁড়িয়ে এক গোরা সৈন্য। ‘‘ইউনিয়ন জ্যাক। স্যালুট করো,’’ হুকুম দেয় সে। তার পর বলে, ‘‘যেতে হলে হামাগুড়ি দিয়ে যাও!’’ সামরিক শাসনের নির্দেশ ওই রকমই ছিল। অমৃতসরের ‘কুচা কৌরিয়ানওয়ালা’ গলিতে তখন ভারতীয়দের সবাইকে হামাগুড়ি দিয়ে যেতে হবে।
হতচকিত জয়নাব আর বেগম হাঁটু গেড়ে বসে। কিছু ক্ষণ ভয়ে ভয়ে হামাগুড়ি দিয়েই তারা ছুটতে শুরু করে। পিছন থেকে গুলি বিঁধে যায় তাদের পিঠে। পারো কাঁদতে কাঁদতে এক গোরা সৈন্যের কাছে আসে। তার মুখে সহসা থুতু ছিটিয়ে দেয়। অতঃপর পিছন থেকে একটা বুলেট তাকেও শুইয়ে দেয়। মহল্লার মেয়েরা বাজারহাট থেকে ফেরার সময়েও রাষ্ট্রশক্তি রেয়াত করে না... এই উপলব্ধিই জালিয়ানওয়ালা বাগ-সাহিত্যের উত্তরাধিকার।
সে ভাবে জালিয়ানওয়ালা বাগের সাহিত্য বলে আলাদা কিছু হয় আদপে? রক্ষান্দা জলিল ‘জালিয়ানওয়ালা বাগ: লিটারারি রেসপন্সেস ইন প্রোজ় অ্যান্ড পোয়েট্রি’ (নিয়োগী বুকস) নামে যে সঙ্কলনটি সম্প্রতি প্রকাশ করেছেন, তাতে রয়েছে মার্কিন লেখক স্ট্যানলি ওলপার্ট-এর লেখা ‘ম্যাসাকার অ্যাট জালিয়ানওয়ালা বাগ’। গল্প নয়, বাস্তব ঘটনা। তদন্ত কমিটিকে ডায়ার বলে, ‘‘যদি অল্প গুলি চালিয়ে ছেড়ে দিতাম, আদৌ ফল মিলত না। ওরা আমার মুখের ওপর হাসত।’’
পড়তে পড়তে আপাতদৃষ্টিতে, জালিয়ানওয়ালা বাগের সঙ্গে সম্পর্কহীন এক ব্রিটিশ লেখককে মনে পড়ে। জর্জ অরওয়েল। একদা মায়ানমারে এক পাগলা হাতিকে বধ করা নিয়ে তাঁর বিখ্যাত লেখা ‘শুটিং অ্যান এলিফ্যান্ট’। রাইফেল হাতে শিকারে যাচ্ছেন পুলিশ সার্জেন্ট অরওয়েল, তাঁকে ঘিরে কয়েকশো মানুষ। অরওয়েলের চিন্তা, ‘একটু দুর্বল দেখালে, গুলি ফস্কালেই ওরা হাসবে। আর প্রাচ্যে প্রতিটি শ্বেতাঙ্গের সংগ্রাম একটিই। কোনও ভাবে যাতে তাকে নেটিভদের কাছে উপহাসাস্পদ না হতে হয়।’ উপহাসের পাত্র হতে চায় না বলেই কি ক্ষমতা আজও ছররা বন্দুক চালিয়ে একের পর এক বালক-বালিকাকে জখম করে, মানুষকে জিপের সামনে ঢাল করে অ্যাক্সিলারেটরে পা চাপে?
বাঙালির কাছে জালিয়ানওয়ালা বাগ সাহিত্যের আরও মূল্য আছে। সুকান্ত ভট্টাচার্যের ‘জালিয়ানওয়ালায় যে পথের শুরু, সে পথে আমাকে পাবে’। হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের গাওয়া ওই গান আমাদের সংস্কৃতিতে আজ ইতিহাস।
আর সবচেয়ে বড় ইতিহাস অন্যত্র। ১৩ এপ্রিলের পর ব্রিটিশ সেন্সরশিপের ধাক্কায় অমৃতসরের খবর কোথাও নেই, দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন থেকে সকলে নীরব। লোকের মুখে মুখে সব শুনে ৫৯ বছর বয়সের এক বাঙালি কবি এন্ডরুজ় সাহেবকে এক প্রস্তাব দিয়ে পাঠালেন মহাত্মা গাঁধীর কাছে। তিনি ও মহাত্মা দুজনে যাবেন পঞ্জাব। দরকারে পুলিশ তাঁদের দুজনকে গ্রেফতার করুক।
এন্ডরুজ় ফিরে এলেন। গাঁধী বলেছেন, সরকারকে এখন তিনি বিব্রত করতে চান না। অতঃপর সারা রাত জেগে ৩১ মে প্রৌঢ় কবির বিখ্যাত চিঠি: ‘...such treatment has been meted out to a population, disarmed and resourceless by a power which has the most terrible efficient organisation for destruction of human lives...’
ইচ্ছাকৃত ভাবেই নাইট খেতাব ত্যাগের এই বিখ্যাত চিঠির আর বাংলা করলাম না। কারণ সে দিন ক’জন মারা গিয়েছিল, ব্রিটিশ সরকার এখনও ক্ষমা চায়নি কেন— এ সব প্রসঙ্গ এই জোরালো চিঠির পাশে অবান্তর।
প্রবল রাষ্ট্রক্ষমতা সহায়সম্বলহীন মানুষের উপর অত্যাচার করলে সবাইকে রুখে দাঁড়াতে হবে— এটাই জালিয়ানওয়ালা বাগের বার্তা। আজও!
নিচের ছবি কুলান বর্মণ
সর্বশেষ এডিট : ১৭ ই এপ্রিল, ২০১৯ রাত ২:৩৮