আমাদের উত্তর পাশের গ্রামে এক বাড়ীর নাম ছিল, বড় বাড়ী; ধনে-মানে, গুণে-জ্ঞানে, এরা বড় কিছু ছিলেন না, এরা জনসংখ্যার দিক থেকে বড় ছিলেন; লোক সংখ্যা বেড়ে যাবার পর, মাঠের অপর পাশে এরা আরেকটি বাড়ী করেছেন, সেটার নাম ছোট বাড়ী; সেখানেও অনেক পরিবার। এই বাড়ীর লোকেরা পেশার দিক থেকে কৃষক ছিলেন; চাষবাস করে ভালোই চলতেন। এই বাড়ীর নারীদের রূপের ও গুণের সুনাম ছিলো; এবং এই বাড়ীর লোকেরা নিজেদের মাঝে বিয়ে শাদীটা সেরে ফেলতেন; ফলে, এদের সুন্দরীরা নিজ বাড়ীতেই থেকে যেতেন। আমাদের সময়, এই বাড়ীর সবচেয়ে প্রসিদ্ধ লোক ছিলেন, পন্ডিত; উনার নাম আমার মনে নেই, সবাই উনাকে পন্ডিত নামেই চিনতেন, তিনি আশেপাশের কয়েক গ্রামে, রাতের আসরে, সুর করে পুঁথি পাঠ করতেন; এই পন্ডিতের ছিল খুবই রূপসী এক কন্যা, জোসনা।
জোসনার বয়স যখন ১০ বছর, তার মায়ের মৃত্যু হয়; জোসনা বাবার জন্য রান্না করতো, বাবার কাপড় চোপড় ধুয়ে দিতো, ঘরদোর পরিস্কার রাখতো; তারপর, আশে পাশের ৪ গ্রামে ঘুরে বেড়াতো; সব বাড়িতে তার নানী, দাদী, চাচী, সখি ছিলো। নিজ বাড়ীতেই জোসনার ২ খালা ছিলো , তারা মেয়ের পাড়া-বেড়ানো পছন্দ করতেন না; খালারাই জোসনাকে পাড়া বেড়ানোর কারণে পাগলী ডাকতেন; এতে গ্রামের অনেকেই তাকে পাগলী ডাকতেন; জোসসনা এই নিয়ে কখনো মন খারাপ করতো না, শব্দটাকে তার নামের পরিপুরক হিসেবে নিতো, মনে হয়।
জোসনা দুই এক সপ্তাহ পর, আমাদের বাড়ীও ঘুরে যেতো, আমাদের বাড়ীর মেয়েদের সাথে আড্ডা দিতো; আমি কাছারীতে থাকলে, কাছারীতে ঢুকে দেখা দিয়ে যেতো, বইপত্র উল্টায়ে দেখতো, বইয়ের ছবি দেখতো। আমি দশম শ্রেণীতে থাকাকালীন একবার আমার পড়ার সময় কাছারীতে এসেছিল, আমাকে পড়তে দেখে বলে,
-তুই খালি বই পড়িস, আমার সাথে একটু খেলতে পারিস না?
-কি খেলা তুই জানিস?
-যদু, মধু, রাম, সাম!
-এতো ৪ জনের খেলা, আর লোক কই?
-আরে বেকুব, আমার সাথে খেললে ৪ জন লাগবে না।
সে এক বিচিত্র হাসি হেসে চলে গেলো। আমাদের কাজের বুড়ো মিয়া ছিলেন সেখানে; তিনি এই নিয়ে অনেক দিন অবধি হাসতেন, বলতেন,
- আরে মিয়া, আপনি বেকুব, জোসনা আপনাকে ২ জনের যদু মধু খেলা শিখাতে চেয়েছিল, সেখানে রাম সাম নেই, আপনি বুঝেন নি।
কলজের প্রথম বর্ষে পড়ার সময় শীতের ছুটিতে বাড়ীতে এসেছি; লেখার কাগজ নেই; দুপুরবেলা মেঠো পথ দিয়ে, জোসনাদের বাড়ীর পাশ দিয়ে বাজারে যাচ্ছি; দুর থেকে কার শিশ শুনে পাশের দিকে তাকালাম; দেখি, জোসনা; ছোট বাড়ী থেকে দৌড়ায়ে আমার দিকে আসছে; এখন সে বড়, ১৫ বছরের মেয়ে।
-কই যাস? সে আমাকে প্রশ্ন করলো।
-বাজারে যাচ্ছি কাগজ কিনতে!
-তোর কাছে পয়সা আছে? আমার খুব সন্দেশ খেতে ইচ্ছে করছে!
-আছে, আমি নিয়ে আসবো।
-এখুনি আনবি। সে শাড়ীর আচলে বাঁধা গিটু থেকে ১টা সিকি বের করলো।
-ওটা রাখ, লাগবে না, আমার কাছে পয়সা আছে।
-তুই এখানে আসবি সন্দেশ নিয়ে, আমি বাড়ীর পেছন থেকে তোকে দেখবো।
বাজার ছিল কোয়ার্টার মাইলের ভেতরে, আমার মনে হচ্ছিল, এ যেন শত মাইল দুরে; এত উৎসাহ আমি জীবনে কখনো অনুভব করিনি; আমার এত ভালো লাগছে যে, জোসনার জন্য সন্দেশ কিনবো। আমি সব পয়সা দিয়ে ১৬ টুকরা সন্দেশ কিনলাম; বাতাসের বেগে ফিরে এলাম। জোসনা ছোট বাড়ীর দিক থেকে একটা ১০/১১ বছরের মেয়ের হাত ধরে আসলো, তার চাচাতো বোন, সীমা; আমার জন্য অপেক্ষা করছিল।
আমার হাতে সন্দেশের পাতিল দেখে বললো,
-তুই কাগজ কিনিস নাই? সব পয়সা দিয়ে সন্দেশ কিনেছিস?
-আমি বিকেলে কিনে নেবো।
-চল, বাড়ী চল।
-না, তুই যা।
-আমার সাথে সন্দেশ খাবি না?
-না, তোদের বাড়ীর লোকজন কি মনে করবে?
-তুই লজ্জা করিস? তুই বড় হয়ে গেছিস! আচ্ছা, চল এখানেই খাবো, বসে পড়।
সে পাতিলের কভার খুলে মেয়েটার হাতে সন্দেশ দিলো, এবার আমাকে খাইয়ে দিতে চাইলো; আমি হাতে নিলাম। সে খেলো। তারপর আমাকে বলে,
-তুই সীমাকে একটা সন্দেহ খাইয়ে দেয়, এটা তোর হয়ে যাক; দেখছিস কি সুন্দরী মেয়ে, আমার হৃদয়ের টুকরা; একে তোর জন্য রেখে দিবো, পড়ালেখা করাবো; তুই পড়ালেখা করছিস, আমি তো কোনদিন স্কুলে যেতে পারিনি।
সর্বশেষ এডিট : ১৪ ই জুলাই, ২০১৭ বিকাল ৫:৪৩