পাখীর সাথে আমি প্রথম শ্রেণী থেকে পড়েছি; গ্রামের সাধারণ ঘরের অসাধারণ প্রানবন্ত, হাসিখুশী মেয়ে; পড়ালেখার চেয়ে খেলাধুলা বেশী ভালোবাসতো; একটু ইমোশানেল, যা মনে আসে, সেটা করবেই। দ্বিতীয় শ্রেণীতে সে ছেলেদের সাথে ফুলবল খেলতে চেস্টা করলো, শিক্ষকেরা বাধা দিলেন। তৃতীয় শ্রেণীতে, পাখী মেয়েদের গ্রুপে সাতারে প্রথম হয়, আমি ছেলেদের গ্রুপে প্রথম; পানি থেকে উঠে, সে আমাকে বললো,
-আমি তোর থেকে দ্রুত সাতার কেটেছি!
-ভালো; তুই মাপলি কি করে?
-মাপামাপির দরকার হবে না, আমি তোর সাথে প্রতিযোগীয় যাবো, প্রমাণ করবো।
পাখী প্রতিদিন আমাকে এই প্রতিযোগীতার কথা মনে করায়ে দিতো; চতুর্থ শ্রেণীতে আমাদের ক্লাশমেটদের উপস্হিতিতে আমরা দু'জন পুকুরে নামলাম; পুকুরটা বেশ বড় ছিলো; পুকুরের মাঝ অবধি পাখী আমাকে চাপেই রাখলো; তারপর সে কিছুটা ক্লান্ত হয়ে উঠলো; আমি ঠিক করলাম, সে জয়ী হোক; আনুমানিক ২ গজ সামনে থেকে পাখী জয়ী হলো; আমার ছেলে বন্ধুরা হতাশ হলো; কিন্তু ক্লাশের সব মেয়ে ও পাখী সীমাতীত আনন্দিত হয়েছিল।
অষ্টম শ্রেণী অবধি, আমি ছেলেদের মাঝে প্রথম হয়েছি, আর পাখী মেয়েদের মাঝে; আমরা অনেক পুকুরে একত্রে সাতার কেটেছি, প্রতিযোগীতায় যাইনি। নবম শ্রেণীতে উঠার পর, সমস্যা দেখা দিলো: স্কুলের বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগীতায় নবম ও দশম শ্রেণীর মেয়েদের জন্য সাতার নেই; সাতার না থাকায় পাখীর মন খারাপ হলো; বার্ষিক ক্রীড়ার আগেরদিন, সব মেয়েরা পাখীর হয়ে, অংকের স্যারের কাছে প্রস্তাব করলো যে, পাখীকে ছেলেদের সাথে সাতারের সুযোগ দেয়া হোক; স্যার খেলাধুলার দায়িত্বে ছিলেন; স্যার মেয়েদের প্রস্তাব মেনে নিলেন। ক্লাশে মেয়েদের লীডার ছিল বীণা; সে আমার দিকে তাকিয়ে বললো,
-এক রাত আছে তোর হাতে, প্রেকটিস করগে!
-পাখী উড়েও আমাকে ধরতে পারবে না!
পাখী বললো, "চতুর্থ শ্রেণীর কথা ভুলে গেছিস?"
-ভুলিনি! আমি হাসলাম।
আমি এবারও পাখীকে ছেড়ে দিতে পারতাম; কিন্ত সিনিয়রদের সাতারে যেজন প্রথম হয়, সেই ইন্টার-স্কুল সাতারে যায়; পাখী অন্য স্কুলের ছেলেদের সাথে প্রতিযোগীতায় টিকবে না, আমাকেই থাকতে হবে।
সাতারের সময়, পাখী আমার পাশেই অবস্হান নিলো; পুকুর ছিলো খুবই বড়; পুকুরের মাঝ অবধি আমি সবার সাথে তাল মিলায়ে সাতার কাটলাম; এরপরে আমি গতি বাড়ালাম; একটু পরে, আমার পা লাগলো আলতোভাবে পাখীর গায়ে; মনে হয়, পাখী তার লাইন থেকে সরে এসেছিল। পাখী দ্বিতীয় হলো; পানি থেকে উঠে আমাকে বললো,
-তুই ছোট লোক হয়ে গেছিস, সামান্য সাতারে প্রথম হওয়ার জন্য আমাকে লাথি মেরেছিস।
আমি কিছু বলার সুযোগও পেলাম না, সে রেগে মেগে চলে গেলো; আমাদের ক্লাশের মেয়েরা তো আছে, এমন কি দশম শ্রেণীর সিনিয়র মেয়েরাও আমাকে ছোটলোক বলে গালি দিলো; বীণা গিয়ে স্যারের কাছে নালিশ করলো।যাক, স্যার কানে নেয়নি। সন্ধ্যায় পুরস্কার বিতরণী হলো; পাখীকে ২য় পুরস্কার হিসেবে দেয়া হলো খুবই দামী গ্লাসসেট। আমরা মিস্টি ও চা খেয়ে করিডোরে আড্ডা দিচ্ছি, একটু পরে নাটক শুরু হবে; এমন সময় আমাদের ক্লাশের সব মেয়ে ও পাখী আমার কাছে এলো; আমি ভাবছি, পাখী বকা দিবে; সে কিছু বললো না, আমার সামনে গ্লাস সেটটিকে পাশের ঝোপের মাঝে ফেলে দিলো। মেয়েদের লীডার বীণা আমাকে লক্ষ্য করে বললো,
-তুই আসলে ছোট লোক, তুই পাখীকে লাথি মেরেছিস!
আমি ব্যাখ্যা করতে গেলাম, পাখী কিছু না শুনে চলে গেলো। পরদিন ক্লাশে টিফিনের সময় বীণা কথাটি তুললো আবার, আমাকে বললো,
-তুই পাখীকে পেছনে ফেলতে লাথি মেরেছিস, এখন মাফ চেয়ে নেয়, ছোটলোক।
-ঠিক আছে, মাফ চাইলাম; কিন্তু আমি পাখীকে লাথি মারিনি; সে লাইন থেকে সরে আমার কাছে চলে এসেছিল, মনে হয়। সর্বোপরি, সে আমার সাথে পারার কথা নয়!
পাখী বললো, তুই শর্ট পরে সাতার কেটেছিস, আমাকে সেলোায়ার কামিজ পরে নামতে হয়েছে, ঠিক আছে?
-তুই ল্যাংটা হয়ে নামলেও আমার সাথে পারবি না!
ক্লাশের সবাই হৈচৈ করে উঠলো; কথাটা তাদের পছন্দ হয়েছে; আমি আরেকটু তেল ঢালার কথা ভাবছি; এমন সময় পাখী শক্ত বই দিয়ে আমার নাকের উপর একটা ঘা বসায়ে দিলো! আমার মাথা ঘুরায়ে গেলো, আধা মিনিট সবাই চুপ; ছেলেরা করিডোরে চলে গেলো; মেয়েরাও হতবাক। পাখী বললো,
-তুই ব্যথা পেয়েছিস?
-না।
সে বাইরে গিয়ে গ্লাসে করে পানি নিয়ে আসলো; রুমাল দিয়ে মুখ মুছে দিলো; বললো,
-মন খারাপ করেছিস?
-না।
-রাগ করিস না; তুই তো আমাকে জানিস!
( ****** আসল ঘটনাকে সামান্য বদলানো হয়েছে )
সর্বশেষ এডিট : ০৭ ই জুলাই, ২০১৭ রাত ১০:২৪