আমাদের বাড়ীর পুর্ব পাশে ধানের মাঠ; মাঠের দক্ষিণ পুর্ব পাশে আমাদের একটি ছাড়া-বাড়ি ছিল; বাড়ীটাকে আমরা খামার বাড়ীর মতো ব্যবহার করতাম,মোটামুটি নির্জন, আশে পাশের বাড়ীগুলো বেশ দুরে ছিল; বাড়ীতে প্রচুর জংগল ছিল, বর্ষায় মাঠের সব সাপ এখানে এসে আশ্রয় নিতো। আমাদের কাজের বুড়োমিয়া সাপের ভয়ে থাকতেন, এবং জংগল পরিস্কারের কথা বলতেন; আমি পরিস্কার করতে দিতাম না; কারণ, বাড়ীর পুর্বাংশের জংগলে বড় কয়েকটা গর্ত করে, এক শিয়াল দম্পতি থাকতো কয়েক বছর ধরে। গ্রামের মানুষের একটা বেদরকারী কর্তব্য ছিল: শিয়াল, বনবিড়াল ও সাপ মেরে ফেলা; আমি সবাইকে জানিয়ে দিয়েছিলাম যে, আমাদের বাড়ীতে ঢুকে কেহ যেন কোন প্রাণীকে মারার চেস্টা না করে।
বাড়ীতে মাত্র ৩টি আম গাছ ছিল, যেটি ছোট সেটিতে বেশী আম ধরতো ও খুবই সুস্বাদু ছিল; আমি আর বুড়ো মিয়াই এগুলো খেতাম; দশম শ্রেণীর বছর, ছোট গাছটায় আম পাকা শুরু করেছে; সকালে পাকা আম দেখি, বিকেলে নেই, কে নিয়ে যাচ্ছে! বাড়ীতে একটি ছোট কুঁড়েঘর ও গরুঘর ছিলো, বর্ষায় আমিও ওখানে মাঝে মাঝে থাকতাম, গরমে আমি থাকতাম না; বুড়োমিয়া কাজে ব্যস্ত, আম কে নিচ্ছে কে জানে! পরদিন আমি দুপুর বেলা ঘরের মাঝে চুপচাপ বসে পাহারা দিচ্ছি; দেখি, পাশের গ্রামের একটি ১২/১৩ বছরের পরিচিত মেয়ে একটি বাঁশের সাহায্যে আম পাড়ছে; আমি গেলাম, সে ভয় পেয়ে গেলো! মেয়েটার সামান্য মানসিক সমস্যা ছিল, সে কারো সাথে কথা বলতো না; ওদের পুকুর পাড় দিয়ে রাস্তা গেছে, স্কুলে যাবার সময় দেখতাম, সে পুকুর-ঘাটে থালি-বাসন মাজছে; আমি কিছু বললে সে উত্তর দিতো, অন্যদের সাথে সে তেমন কথা বলতো না।
তাকে ভীত দেখে আমি কিছুই বললাম না; সে চলে যাচ্ছিল, আমি বললাম
-ফাতেমা, আম নিয়ে যা!
সে রেগে গেলো,
-তোামাদের এত আম, আমি ২টা আম পাড়ছি, তাতে তুমি ঘর থেকে বের হয়ে এসেছ! আম তুমি খাওগে।
আমি থামাতে চেস্টা করলাম, সে কেঁদে ফেললো; চলে গেলো।
দুইদিন পর, ওর চাচাতো বোনকে দেখলাম মাঠ থেকে ছাগল নিতে এসেছে; আমি একটি থলেতে কিছু আম দিলাম, বললাম,
-তুই কিছু নিস, বাকীগুলো ফাতেমাকে দিস।
মেয়ে রহস্যময় হাসি হেসে বললো,
-এই তোমার অবস্হা?
যুদ্ধের সময় ওদের বাড়ী পোড়ায়ে দিয়েছিল; ওরা ২ গ্রামের পরের গ্রামে মামার বাড়ীতে ছিল; দারিদ্রতার কারণে এখানে আর বাড়ী তুলতে পারেনি, আর ফিরে আসেনি গ্রামে।
তারপর এত বছর কেটে গেছে, আমাকে চলে যেতে হয়েছে দুরে, ফাতেমার কোন খবর আমি জানি না। সেদিন খামার বাড়ীতে বসে সন্ধ্যায় চা খাচ্ছিলাম; এখন এটি বাড়ীতে পরিণত হয়েছে, আমার বড় ভাই পরিবার নিয়ে এই বাড়ীতে থাকেন। ভাবী বললেন,
-একজন মহিলা এসেছে তোমার সাথে দেখা করার জন্য, পাক ঘরে বসেছে।
পাক ঘরে ঢুকে দেখলাম মহিলাটি ফাতেমা; গায়ের জীর্ণ শীর্ণ কাপড় দেখে অবস্হা বুঝতে পারলাম; সে আমাকে জড়ায়ে ধরলো; কুশলাদি জামলাম; একত্রে চা খেলাম। সে চলে যাবে, হাতে কিছু টাকা দিলাম, বললাম রাতে খেয়ে যেতে; সে থাকলো না; শুধু বললো,
-ঈদে আমাকে একখানা কাপড় কিনে দিও।
-ঠিক আছে, তুই আমার মনে আছিস আজীবন; আমি তোর খবর নেবো।
ভাবী ও ভাইয়ের বড় মেয়ে হতবাক, এই মহিলা কিভাবে আমাকে জড়ায়ে ধরলো; বড়ভাইয়ের মেয়ে বললো,
-মহিলা তো পাগল!
-না, সে পাগল ছিলো না, অন্য রকম ছিলো।
সর্বশেষ এডিট : ২৬ শে ডিসেম্বর, ২০১৭ ভোর ৪:০৯