নাম তাঁর মোহাঃ নাজিমুদ্দিন এরবাকান। বাবা মোহাম্মাদ সাবরি এরবাকান এবং মা খামের এর তুরষ্কের সিনপ শহরের ঘরে ১৯২৬ সালের ২৬ অক্টোবর নাজিমুদ্দিন এরবাকান জন্মগ্রহণ করেন। বাবা মোহাম্মান সাবরি এরবাকান ছিলেন একজন সরকারী চাকুরীজিবী। ১৯৪৩ সালে মাধ্যমিক এবং উচ্চমাধ্যমিকের স্তর চুকিয়ে তিনি ভর্তি হন ইস্তুাম্বুল প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে। সে সময় ভর্তি পরীক্ষার প্রচলন না থাকলেও বিশেষ পরীক্ষা দিয়ে তিনি একেবার দ্বিতীয় বর্ষে ভর্তি হন। ১৯৪৮ সালে স্নাতক শেষ করা মাত্রই একই বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষানবিশ শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন। তিনি যন্ত্র প্রকৌশল অনুষদের অটোমোবাইল বিভাগে যোগদান করেন। এখান থেকেই তাঁর কর্মজীবনের সূচনা হয়।
১৯৫১ সালে ইস্তাম্বুল বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে নাজিমুদ্দিন এরবাকানকে জার্মানির বিখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয় `Aachen Technical University' তে উচ্চ শিক্ষার জন্য পাঠানো হয়। জার্মান সেনাবাহিনীর জন্য প্রতিষ্ঠিত DVL গবেষনা কেন্দ্রে প্রফেসর স্কিমিদ এর সাথে কাজ করার সুযোগ পান। দেড় বছরের এই গবেষনা কাজে তাঁর দায়িত্ব ছিল একটি সমীক্ষা রিপোর্ট তৈরী করা। কিন্তু তিনি এতো বেশি প্রখর মেধার অধিকারী ছিলেন যে, ঐ সময়ের মধ্যে তিনি তিনটি সমীক্ষা রিপোর্ট তৈরী করেন এবং জার্মানি থেকে ডক্টরেট ডিগ্রী অর্জন করেন। এরপর তিনি আরো কয়েকবছর জার্মানির বিভিন্ন অটোমোবাইল কারখানায় কাজ করার সুযোগ লাভ করেন। সেই প্রতিষ্ঠানগুলোতে কাজ করার সময় তিনি উপলবদ্ধী করেন, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরও যদি জার্মানরা ‘ভারী শিল্পে’ সফলতা লাভ করতে পারে, তবে তুরষ্ক কেন পারবে না?
এই চিন্তা থেকেই তিনি তুরষ্কে ফিরে আসেন। এসময় তুরষ্ক ছিল কৃষিপ্রধান দেশ। তুরষ্কের মানুষ কৃষি উৎপাদন করা ছাড়া আর কিছুই পারতো না। আর এই চাষবাষ ছাড়া তারা কিছুই ভাবতেও পারতো না। একারণেই তুরষ্ককে প্রতি বছর কৃষিকাজের জন্য বিভিন্ন যন্ত্রপাতি আমদানি করতে হতো। এতোসব চিন্তাভাবনা থেকে নাজিমুদ্দিন এরবাকান ২০০ দেশ প্রেমিক উদ্যোক্তাকে নিয়ে প্রতিষ্ঠা করেন, ‘গোমুশ ইঞ্জিন ফ্যাক্টরী’। এই ফ্যাক্টরীর অন্যতম প্রধান উদ্দেশ্য ছিল তুরষ্ককে প্রযুক্তিগত দিক থেকে উন্নত করা। এই ফ্যাক্টরী প্রতিষ্ঠা করা হলেও উপর সরকারের কালো নজর পড়ে। সরকার এই ফ্যাক্টরীর অস্তিত্ব সহ্য করতে পারতো না। তাই তো গোমুশ ফ্যাক্টরীর উৎপাদিত প্রথম মটরের নমুনা সংশ্লিষ্ট মন্ত্রনালয়ে পাঠানো হলে তারা এটিকে মানসম্তত নয় বলে ঘোষনা করেন। কারণ হিসেবে বলেন, ইউরোপীয় স্ট্যান্ডার্ডনুযায়ী প্রতি ঘন্টায় এটার জ্বালানী হতে হবে ৫.৬ লিটার। কিন্তু গোমুশ উৎপাদিত মটরটিতে জ্বালানী দিতে হতো ৫.৭ লিটার। প্রথম বাধা পাওয়ার পর গোমুশ ফ্যাক্টরীর ইঞ্জিনিয়াররা আবারো গবেষণা শুরু করল। এবার তারা অভাবনীয় সাফল্য অর্জন করল। এবার প্রতি ঘন্টায় ৫.৫ লিটার জ্বালানীতে নামিয়ে আনল। এরপর ইঞ্জিনের নমুনা আবারো মন্ত্রনালয়ে পাঠানো হলে, তারা সেটিকে আবারো বাজারজাতের অগ্রনযোগ্য বলে ঘোষনা দেয়। কিন্তু নাজিমুদ্দিন এরবাকান এবং তার সঙ্গি সাথীরা দমানোর পাত্র নয়।
১৯৬০ সালের দিকে গোমুশ ফ্যাক্টরী পরিদর্শনে আসেন, আদনান মেন্দরেস। তিনি যেদিন আসেন সেদিনই তিনি প্রথম জানতে পারেন তুরষ্কে মটর উৎপাদিত হচ্ছে। তিনি এই ফ্যাক্টরী দেখে কি পরিমান খুশি হয়েছেন তা বলার অপেক্ষা রাখে না। গোমুশ ফ্যাক্টরীর মন্দাবস্থা কাটিয়ে উঠার জন্য ফ্যাক্টরীতে ১ মিলিয়ন মার্কিন ডলার সহায়তা প্রদান করেন। ফ্যাক্টরীর কর্মকর্তা এবং কর্মচারীদের উদ্দেশ্যে মরহুম আদনান মেন্দরেস বলেন, “আমি একজন কৃষক। এসব মটর থেকে আমিও ব্যবহার করেছি। এখন এই একই মটর/ইঞ্জিন তুরষ্কে উৎপাদিত হচ্ছে। আর আমি খুব ভালো করেই জানি যে, এটা কত বড় একটা পদক্ষেপ। আমি আজ সত্যিই আনন্দিত ও পুলকিত যে আমার দেশে আজ এই সব যন্ত্র উৎপাদিত হচ্ছে।” এভাবেই নাজিমুদ্দিন এরবাকান তুরষ্কের ভারি শিল্পে অভাবনীয় বিপ্লব সংগঠিত করেন।
ঐ সময় তুরষ্কের ক্রেডিট ইউনিয়ন (The union of chamber and comodity exchange of Turkey) রপ্তানি আয় ও আমদানির অর্থসমূহ নিয়ন্ত্রন করত এবং এতে করে আয়ের সিংহ ভাগই চলে যেত আমদানিকারকদের হাতে। উদাহারণস্বরূপ ২০ মিলিয়ন ডলারের যদি বাণিজ্য হতো সেখান থেকে ১৯ মিলিয়ন ডলারই দিতে হতো ইস্তাম্বুলের বিভিন্ন আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানকে। আর বাকি ১ মিলিয়ন ডলার থাকতো দেশীয় ব্যবসায়ীদের হাতে। একারণেই দেশীয় ব্যবসায়ীদের উন্নতি হচ্ছিল না। ব্যবসায়ীদের মধ্যে সমতা বন্টনের দায়িত্বভার ছিল TOBB এর উপর। এই প্রয়োজন মাথায় রেখেই TOBB এর শিল্পবিভাগে প্রবেশ করেন নাজিমুদ্দিন এরবাকান এবং ১৯৬৬ সালে শিল্পবিভাগের প্রধানের দায়িত্বপান। এরপর থেকেই বৈদেশিক মুদ্রা এবং বাণিজ্যিক লোন সমতার ভিত্তিতে বন্টন শুরু করেন। এই সুষম বন্টনের ফলও কিছুদিনের মধ্যে তুরষ্কের বাজারে প্রত্যক্ষ করা যায়। এভাবেই নাজিমুদ্দিন এরবাকান দেশীয় ব্যবসায়ীদের প্রতিষ্ঠা লাভের দ্বার উন্মুক্ত করনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। আর এই সব গুরু দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে তুরষ্কের সেনাবাহিনীরও কুনজরে বড়ে বেশ কয়েকবার কারাবরণ করতে হয়।
একবার কারা প্রকোষ্ঠে জিজ্ঞাসাবাদের সময় একজন কর্মকর্তা প্রশ্ন করেন, ‘আপনি শিক্ষাগত জীবনে সারাজীবন প্রথম হয়েছেন। প্রখর মেধা ও প্রতিভার অধিকারী একজন মানুষ আপনি। বিজ্ঞান ও গবেষনার নতুন প্রযুক্তি উদ্ভাবন করেছেন। একজন বিজ্ঞানী হিসেবে যদি আরো নতুন নতুন আবিষ্কারের মাধ্যমে মানুষের সেবা করতেন, সেটা অনেক বেশি ভালো হতো না?’
জবাবে নাজিমুদ্দিন এরবাকান বলেন, ‘একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর হতে পারি। নোবেল পুরষ্কারও হয়তো পেতে পারি কিন্তু আমার দেশের মানুষ যদি আজকের মত ক্ষুধা ও দারিদ্রে ভোগে, দুর্বিপাক ও দুর্বিসহ জীবন যাপন করে দুনিয়াতে ৩ লাখ শিশু প্রতি বছর ক্ষুধায় ও অপুষ্টিতে মৃত্যুবরণ করে তাহলে আপনার সে নোবেল কোন কাজে আসবে?’
এই মহান ব্যক্তিটি এভাবেই আপন দেশ তুরষ্ককে গড়ার কাজে নিজের জীবন এবং ক্যারিয়ারকে বিসর্জন দিয়ে গেছেন। আর এই দেশ গড়ার কাজ চলাকালীন সময়েই ২০১১ সালের জুলাই মাসে সকলকে কাঁদিয়ে ইহজগত ত্যাগ করেন মহান উস্তাদ নাজিমুদ্দিন এরবাকান। তাঁর মৃত্যুর পর গোটা তুরষ্কে শোকের ছায়া নেমে আসে। তাঁর জানাযাটি ছিল তুরষ্কের ৩০০ বছরের ইতিহাসের মধ্যে সবচেয়ে বড় জানাযা। মিডিয়ার ভাষ্যমতে প্রায় ৩৫-৪০ লাখ মানুষ নাজিমুদ্দিন এরবাকানের জানাযায় অংশগ্রহণ করেন। এই মহান উস্তাদের লাশের খাটিয়া নিয়ে কবরস্থান পর্যন্ত যাত্রা করেছিলেন, তাঁরই সন্তানতুল্য দুই ছাত্র তুরষ্কের প্রেসিডেন্ট নিও অটোম্যান রজব তাইয়্যেব এরদোগান এবং আব্দুল্লাহ গুল।
সেই শোকাবহ দিনে নাজিমুদ্দিন এরবাকান নামের মানুষটির মৃত্যু হলেও তাঁর কাজগুলো তুরষ্কের বুকে সাক্ষি হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। উস্তাদ নাজিমুদ্দিন এরবাকানদের সেই আত্নত্যাগের ফলাফল আজ গোটা তুরষ্ক ভোগ করছে। ধন্য তুমি হে মহান নেতা। ধন্য তোমার জীবন।
সর্বশেষ এডিট : ১২ ই জানুয়ারি, ২০১৭ বিকাল ৩:১২