পুরোনো সেই দিনের কথা (নবম বারো)
পুরোনো সেই দিনের কথা (অষ্টম বারো)
পুরোনো সেই দিনের কথা (সপ্তম বারো)
পুরোনো সেই দিনের কথা (ষষ্ঠ বারো)
পুরোনো সেই দিনের কথা (পঞ্চম বারো)
পুরোনো সেই দিনের কথা (চতুর্থ বারো)
পুরোনো সেই দিনের কথা (তৃতীয় বারো)
পুরোনো সেই দিনের কথা (দ্বিতীয় বারো)
পুরোনো সেই দিনের কথা (প্রথম বারো)
109. আমাদের ছেলেবেলায় মুক্তিযুদ্ধের বছরকে বলা হতো গন্ডগোলের বছর। আমরা বড় হয়েছি ২৬ মার্চ মেজর জিয়ার স্বাধীনতার ঘোষণার মাধ্যমে যুদ্ধ আরম্ভ হয় তাই জেনে। এর আগে আর কিছু ছিল না। মুক্তিযোদ্ধার শৌর্য-বীর্য নিয়ে কমই লেখা বা আলোচনা হতো। সবত্রই তাদের কৃপার দৃষ্টিতে দেখা হতো। আজ আবার সেই অবস্থাই হতে যাচ্ছে; মুক্তিযোদ্ধার নাতিদের জন্যে সরকারী চাকরিতে কোটা রেখে সরকার তাদের হেয় করছে।
110. ’আবার তোরা মানুষ হ’ চলচ্চিত্রকে কেন যে লোকে মুক্তিযুদ্ধের চলচ্চিত্র বলে বুঝতে পারি না। তারেক মাসুদের ‘মুক্তির গান’ এর টিকিট মানুষ কিউ এ দাঁড়িয়ে কিনে দেখেছিল। ‘আগুনের পরশমনি’ মুক্তিযুদ্ধের সময় ঢাকার কিছু অংশের প্রতিচ্ছবি তুলে ধরেছিল।
111. ১৯৯২ সালে ২৬ মার্চ ছিলাম সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের গণআদালতে। সেদিন বিএনপি সরকার কোনো মাইক ব্যবহার করতে দেয় নি। ট্রাকের ওপর দাঁড়িয়ে শহীদ জননী জাহানারা ইমাম রায় ঘোষণা করেন। আমরা বিস্তারিত জানতে পারি পরের দিনে পত্রিকা পড়ে।
112. প্রেসিডেন্ট জিয়ার ঢাকার মানিক মিয়া এভিনিউ এর জানাজায় মানুষের ঢল নেমেছিল। বেগম জিয়া ওই সময় নিভৃতেই থাকতেন; তাকে টিভিতে একটু দেখার জন্যে আগ্রহী কম ছিল না। যেদিন প্রেসিডেন্ট জিয়া হত্যার জন্যে মুক্তিযোদ্ধা অফিসারদের ফাঁসি দেয়া হয় সে রাতে মুক্তিযোদ্ধারা বিক্ষোভ করে, আমাদের ক্যাম্পাসের মাঠে ভীত মানুষের গাড়িতে ভরে গিয়েছিল।
113. ১৯৯০ সালের ২৭ নভেম্বর ঢাকা বিক্ষোভে ফেটে পড়ে, স্কুল ফেরত ছোটোবোনকে নিয়ে আটকা পড়েছিলাম ঢাকা টিচার্স ট্রেনিং কলেজে বন্ধুর বাসায়। বাসায় সবাই ছিল টেনশনে। দুপুরের পরে পরিস্থিতি একটু স্বাভাবিক হলে বাসায় ফিরি। ডাঃ মিলন সেদিন শহীদ হন। কারফিউ ঘোষণা করা হয়। ৪ঠা ডিসেম্বর, টিভিতে বিশেষ ঘোষণা আসলো, এরশাদ পদত্যাগে সম্মত হয়েছে। আমরা রাস্তায় নেমে গেলাম। একজনকে দেখলাম বিটিভির তৎকালীন মহাপরিচালক চামচা সাইফুল বারীর বাসা লুটে একগাদা বই নিয়ে যেতে। সে সময় বই-কে অনেক মূল্য দেয়া হতো। ৬ ডিসেম্বর এর আগে সাধারণভাবে কেউ জানতো না বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতির নাম কি? শুধু টিভিতে প্রেসিডেন্ট এর শপথ অনুষ্ঠানে প্রধান বিচারপতিকে দেখা যেতো। ১৯৯৬ সালের পর থেকে প্রধান বিচারপতি পদ নিয়ে শুরু হয় রাজনীতির নোংরা খেলা।
114. বাটাকে বলা হতো অক্ষয় কোম্পানী। যদিও সেই দিন আর নেই। দাম লেখার ক্ষেত্রে বাটা কুশলী ছিল। ২০০ না লিখে লেখা হতো ১৯৯.৯৫, পরে ১৯৯.৫০ আরো পরে ১৯৫.০০।
115. শারমীন রীমা হত্যা মামলা বেশ আলোড়ন তুলেছিল ১৯৮৯ সালে, পত্রিকার প্রথম পৃষ্ঠায় মাস্ট লিড হিসেবে থাকতো, বিচারে স্বামী মুনিরের ফাঁসি ১৯৯৩ সালে হয়; ধানমন্ডির মেহেরুন্নেসা ক্লিনিকের মালিক ডাঃ মেহেরুন্নেসার সন্তান সে; মায়ের ক্লিনিকের নার্স মিনতির সাথে সম্পর্ক ছিল, সম্পর্ক ছিল খুকু নামের কলগার্লের সাথে। প্রভাবশালী পরিবারের বখে যাওয়া এই সন্তান ছাড়া পেয়ে যাওয়ার আশংকা ছিল। যা সাংবাদিকদের কারণেই এক প্রকার হতে পারে নি। রীমার বাবা মুক্তিযুদ্ধে শহীদ সাংবাদিক নিজামউদ্দিন আহমেদ। ফাঁসি হওয়ার পরও লাশ দেখতে না দেয়ায় জনমনে প্রশ্ন ছিল আসলেই ফাঁসি দেয়া হয়েছিল কি না।
116. শবে বরাতের রাতে আমরা বোমা ফাটাতাম; আসলে আরো কয়েকদিন আগে থেকে শুরু হয়ে যেতো। রকেটবাতি, তারাবাতি, মরিচাবাতি ছিল; ছিল কাঠি বোম, গোল বোম, চকলেট বোম। দেশীয় প্রযুক্তিতে টাইম বোমও করা হতো। সারারাত শব্দকম্প চলতো।
117. সাধারণ লবণই খাবারে ব্যবহৃত হতো, অপরিষ্কার লবণই ডাইনিং টেবিলে দেয়া হতো। সম্ভবত লবণক্ষেত থেকেই তুলে বস্তায় ভরে বাজারজাত করা হতো সে সময়। আয়োডিনযুক্ত লবণ আসে বেশ পরে। এতো পরিষ্কার লবণ হতে পারে আমরা ভাবতেই পারি নি। ছেলেবেলায় আখের চিনিই বেশী পাওয়া যেতো; লাল আর ভেজা ভেজা।
118. এ সপ্তাহে চীনের মহাকাশ স্পেস স্টেশন তিয়াংগন-১ ভূপৃষ্ঠে পড়ছে। ১৯৭৯ সালে এ রকম একটি খবর আমাদের আতঙ্কিত করেছিল। আমেরিকার তৈরি স্কাইল্যাব যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পৃথিবীর দিকে ধেয়ে এসেছিল। আমরা ছোটোরা খুব ভয় পেয়েছিলাম, আশঙ্কা করেছিলাম যদি ঢাকাতে আমাদের বাসার ওপরে পড়ে; বড়রা ইত্তেফাক পড়ে আশ্বস্ত করেছিল, বিজ্ঞানীরা বলেছেন, বাতাসের ঘর্ষণে স্কাইল্যাব জ্বলে পুড়ে যাবে আর সাগরে পড়বে। তাই ঘটেছিল অবশেষে।
119. এরশাদের সময় ১২ জন মন্ত্রী আর সম্ভবত দৈনিক খবর পত্রিকার সম্পাদক মিলে নিজেদের ছবি দিয়ে পত্রিকায় পূর্ণ পৃষ্ঠা বিজ্ঞাপন দেয় ‘জ্যোতি হিমেল পাউডার’এর। সায়েদাবাদের তথাকথিত পীর এর আবিষ্কৃত এই পাউডার ব্যবহারে সর্বরোগ ভালো হয় বলে মন্ত্রীরা সার্টিফিকেট দিয়েছিল। কোনো আমলেই আমাদের মন্ত্রীরা সত্য বলতো না। আসলে সে সময় পীরদের জয় জয়কার ছিল। ফরিদপুরের আটরশি তো জাতীয় পীর হয়ে গিয়েছিল।
120. এরশাদ জুম’আর নামাজে বিভিন্ন এলাকার মসজিদে যেয়ে একটি অসত্য কথা বলতো নির্লজ্জের মতো। তার টাইটেল নানা কারণেই তখন হয়ে গিয়েছিল ‘বিশ্ব বেহায়া’। সে না কি আগের রাতে স্বপ্নে দেখেছে যে এ দিন এই মসজিদে জুম’আর নামাজ আদায় করছে তাই এসেছে। অথচ সাত দিনের বেশী আগে থেকেই নিরাপত্তা বাহিনী মসজিদে ব্যস্ত ছিল।
সর্বশেষ এডিট : ৩১ শে মার্চ, ২০১৮ সন্ধ্যা ৬:৩৬