গত ডিসেম্বার মাসের ১৬ তারিখে ভারতের দিল্লীতে এক মেডিকেল ছাত্রী কয়েকটি নরপশুর হাতে চলন্ত বাসে নির্মমভাবে ধর্ষিত হয়ে প্রায় দু’সপ্তাহ পর মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে। এ ঘটনায় যখন ভারতে তোলপাড় চলছে, তখন আমাদেরই অনেককে বলতে শুনে ছিলাম যে, – ‘ভারত সবচেয়ে বেশি ধর্ষণ হয়’, ‘ভারতেই এমনটা হয়, বাংলাদেশে হয় না’, ‘ভারত বলেই এই রকম ঘটনা ঘটছে’ ইত্যাদি ইত্যাদি। আমাদের সেই আত্মতৃপ্তির ঢেঁকুর গলা দিয়ে বেরোনোর আগেই খবর পাওয়া গেল টাঙ্গাইলে একটি স্কুলপড়ুয়া মেয়েকে আটকে রেখে কয়েকটি নরপশু ৩ দিন ধরে ধষর্ণ করে এবং মেয়েটিকে ১০ই ডিসেম্বর অজ্ঞান অবস্থায় রেলাইনের ওপর পাওয়া যায় । খবরটি হয়তো আমাদের সবারই নজর এড়িয়ে যেতো যদি না তখন ভারতে দিল্লীর ধর্ষণ ঘটনায় এমন তোলপাড় না চলতো!
তবে যথারীতি আমরা বাংলাদেশের সেই মেয়েটির কথাও এখন ভুলে গেছি, জানি না সে সুস্থ হয়েছি কিনা, জানি না সে ন্যায় বিচার পাবে কিনা? অবশ্য আমরা তেমনভাবে কোন দাবীও করিনি সে জন্য! সে খবরের জাবর কাটা শেষ হতে না হতেই জানুয়রি মাসে মানিকগঞ্জে একজন গার্মেন্টস কর্মী বাসের ড্রাইভার ও হেলপার কর্তৃক চলন্ত বাসে ধর্ষিত হল। খবর ব্যাস এই টুকুই। অপরাধী গ্রেপ্তার হয়েছে এটুকু যদি খোজ নেই সেটাই আমাদের ব্যাস্ত জীবনের জন্য ঢের বেশি! আমরা আমাদের তৃপ্তির ঢেঁকুর গিলে ফেলে যার যার কাজে আবার ব্যাস্ত হয়ে পড়ি। এর মধ্যে আরো কত ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে তা আমাদের জানার ফুরসোতই হবে না। এর মধ্যেই আবার ঘটে গেল টঙ্গীর স্কুল পড়ুয়া আরেকটি মেয়ের ৫৫ দিন ধরে ধর্ষিত হবার ঘটনা!!
ধর্ষণ চলছেই – এবং আমরাও নির্বিকার ভাবে খবরের পাতা উল্টিয়ে আরো ধর্ষণের খবর দেখি। সকালের চায়ের সাথে মনোযোগ দিয়ে পড়ি সংবাদপত্রে ছাপানো ধষর্ণের রগরগে ডিটেইল – কিভাবে ধর্ষিত হলো, কতটা বিভৎস্যতা ছিল, কয়জন মিলে ধর্ষণ করলো ইত্যাদি ইত্যাদি! অনেকে মনে মনে আফসোস করি, ‘আহারে, মেয়েটা নষ্ট হয়ে গেল’, অনেকে ভাবি ‘নিশ্চই মেয়েটির কোন দোষ ছিল’, অনেকে বসুন্ধরার সামনে দেখা আ্টোসাটো পোষাক পরা মেয়েটিকে ভেবে (যার দিকে লোলুপ দৃষ্টিতে অনেকেই তাকিয়েছিল) চিন্তা করে: ‘মেয়েরা যে রকম বেহায়া হয়ে গেছে, তাতে ঠিকই হয়েছে’! আবার অনেক শিশ্নব্যাধীগ্রস্থ পশু এই খবরে তার শিশ্নপীড়ার তাঁড়ন নুতনভাবে অনুভব করে...
এ কোন সমাজে আমরা বাস করছি?? আমরা কি একবারও ভাববো না যে আমাদের সবার ঘরে অর্ধেকই নারী! আমাদের কন্যা, মা, বোন, স্ত্রীদের কথা কি আমরা ভুলে যাই সে সময়? ‘ধষর্ণের ঘটনা আজ নতুন নয়, সেই প্রাচীনকাল থেকেই এটা ঘটে আসছে’ – এই ধারণা নিয়ে আমরা যারা বসে আছি তারা কি একবারো ভেবেছি যে এটা একটা মধ্যযুগীয় ধারণা?
অনেকেই জানতে চায় এই সমস্যার সমাধান কোথায়? পন্ডিতেরা ভাবতে ভাবতে মাথার চুল পাতলা করে ফেলছেন, সরকার ভিকটিমদের জন্য সাপোর্ট সেন্টার/শেল্টার খুলে দেখাতে চাইছে তাদের দায়িত্বশীলতা। এনজিওরা পুনর্বাসনের নামে প্রশিক্ষণ আর সেলাই মেশিন দিয়ে বাহবা নিতে চাইছে ডোনারদের কাছে। এভাবেই গরিব মেয়েটির একটা রফা হয়ে গেল! আর যদি ধনীর মেয়ে হয়, তবে বিত্ত আর সামাজিক মর্যাদার ভারে ধর্ষণের মতো চরম অপরাধটি শেষমেষ ধামাচাপা পড়ে যায়। মেয়েটির কথা কেউ ভাবে না।
আসলে এই সমস্যার সূত্রপাত মাথায়, – কিছু শিশ্নপীড়াগ্রস্থ নরপশু আমাদের সমাজে আছে। এরা ভালমানুষের ছাল পড়ে আমাদেরই আশেপাশে ঘুরঘুর করে, ঘাপটি মেরে থাকে। আর সুযোগ পেলেই তাদের কামার্ত লোলুপতায় একটি নারীর জীবন তছনছ করে দেয়, - হোক সে শিশু বা বৃদ্ধা।
এদের ওষুধ একটাই – ভয়। এদের ভয় দেখাতে হবে – যদি এ কান্ড করো তবে চরম শাস্তি পাবে। এবং সেই শাস্তির উদাহরণ থাকতে হবে – ভুরি ভুরি। ধর্ষণ ঘটনাগুলো বার বার ঘটবার একটাই করান – এর কোনটাতেই কখনো কারও শাস্তি হয় না। আমি আমার জীবনে অজস্রবার দেখেছি ধর্ষণের ঘটনা পত্রিকার খবর হতে। প্রায় প্রতিদিনই পত্রিকা এক আধটা ধর্ষণের রিপোর্ট থাকবেই এবং ধর্ষণ কিভাবে হলো তার রগরগে বর্ণনা দিতেই যেন পত্রিকাওয়ালাদের আগ্রহ বেশি। ধর্ষণের বর্ণনা দিয়ে যতটা রিপোর্ট হয় তার অর্ধেকও ফলোআপ রিপোর্ট আসেনা – আমরা জানিই না অপরাধীরা ধরা পড়লো কিনা। যদিও বা কখনো কিছু অপরাধী ধরা পড়ার খবর আসে, তার একশ ভাগের একভাগ খবরও পাই না এসব অপরাধের বিচার বা বিচারের রায় হলো কিনা।
আর বিচারের রায় কার্যকর হবার খবর, এখনো আমি কোন পত্রিকার পাতায় কখনো দেখিনি!!!!!!!!!!!!
তাই আসুন, এবার আহা উহু বাদ দেই। সবাই প্রতিজ্ঞা করি অন্তত:পক্ষে একটা হলেও ধর্ষণ ঘটনার বিচারের রায় কার্যকর করতে যা যা করা লাগে আমরা করবো, – যদি রাস্তায় নামতে হয় তাও নামবো। তবু বিচারের রায় কার্যকর না হওয়া পর্যন্ত থামবো না।
এবং সেই ধর্ষকের কতটা নির্মম ভাবে ফাঁসি হলো তা দেশব্যাপী ছড়িয়ে দেব। দেখি না ঠিক হয় কিনা...
সর্বশেষ এডিট : ০৩ রা জুন, ২০১৩ রাত ১১:৫৬