আমি নারী ... কারও মা, কারও বোন, কারও স্ত্রী, কারও বা কন্যা।
...
না!
সবার আগে একটা মানুষ! হাত-পা-মুন্ডু-মগজ সম্বলিত একটা স্বাধীন মানুষ!
আর দশটা মানুষের মতন আমার স্বাধীন ইচ্ছা আছে, রঙিন স্বপ্ন আছে, বিচিত্র শখ আছে।
আমারও ইচ্ছা করে ঘুরে বেড়াই, উড়ে বেড়াই,ছুটে বেড়াই,নেচে বেড়াই, ভেসে বেড়াই, হেসে বেড়াই...বিস্তৃত আকাশ জুড়ে, দিগন্তের পর দিগন্ত জুড়ে,খোলা মাঠ জুড়ে।
আমি আদর্শ নারী নই, আদর্শ নারী হবার প্রয়াস নিয়ে জন্মাইনি, সেই উচ্চাকাঙ্ক্ষা নিয়ে জীবন যাপনে বদ্ধপরিকরও নই!
বলেছি তো! আমি আর দশটা সাধারণ মানুষ!
আমি যদি আদর্শ নারী হই তবে-
আমি কারও মা, তাই বাচ্চা পালনের গুরুদায়িত্ব বহন করতে গিয়ে আমাকে চাকরি ছাড়তে হবে,
আমি কারও বউ, তাই ছোটবেলার নাচ-গানের চর্চা আমার বাপের বাড়িতেই ফেলে আসতে হবে,
আমি কারও বোন, তাই বয়ঃসন্ধি পেরোনোর পর আমার পুরোনো মাঠে খেলার অভ্যাস ছাড়তে হবে,পাছে আমার ভাইকে কেউ দুটো কটূক্তি শোনায়।
আমি কারও মেয়ে,তাই পরিণত বয়সে নিজের নারীদেহ নিয়ে জড়সড় হয়ে থাকতে হবে যাতে সবাই ভদ্র বলে।
পুরুষতান্ত্রিক পরিবারে জাত থাকে পুরুষের, তাই একটুতেই তাদের আবার জাতও যায়, মেয়েছেলে এই করলে জাত যায়, অই করলে মানইজ্জত ক্ষয়।
কই তোমরা যখন থ্রি-কোয়ার্টার প্যান্ট পরে,লুঙ্গি ধরে হাঁটু পর্যন্ত উঠিয়ে হাট,বীরদর্পে বিড়ি ফুকাও, রাস্তার পাশে প্যান্টের চেইন খুলে মূত্রত্যাগ কর- তাতে তো তোমার সংশ্লিষ্ট নারীর মানসম্মানের ব্যাপার জড়ায় না!এসবের কারণে তোমরা টিজিংএর স্বীকারও হও না!
বাচ্চা মানুষ হচ্ছে না, চাকরি ছাড়- এই বলে তো কোন নারী তোমাদের দিকে চোখ মটকায় না!!
আমি কোন গৃহপালিত জন্তু নই যে আমার সার্বক্ষণিক অভিভাবকের প্রয়োজন আছে,
একটা শিশুকে (ছেলে বা মেয়ে) চোখে চোখে রাখার দরকার হয়, তারা হাটতে পারে না, কথা বলতে পারে না, চিন্তা করতে পারে না। তাদেরকে গাইড করা দায়িত্ব, অধিকার কর্তব্য,
আমি কোন অবুঝ শিশু নই যে পরিণত বয়সেও একটা "পুরুষ"মানুষের গাইডের প্রয়োজন হবে!
কি বুঝ দাও আমাকে? আমি মুল্যবান সম্পত্তি তাই আমাকে পাহারা দেয়া অবশ্য কর্তব্য?
কে বলেছে আমি "মুল্যবান সম্পত্তি" হয়ে ঘরের শোভা বৃদ্ধি করতে চাই?
আমি তো বাতাস হতে চাই, শীতল বাতাস, উষ্ণ বাতাস, ঘুরে বেড়াব, ভেসে বেড়াব এ ঘর থেকে ও ঘরে, ফুটপাথ থেকে চৌরাস্তা...এমাথা থেকে তেমাথা।
তোমাকে দুইটা দিন "মুল্যবান সম্পত্তি" নামে ঘরের কুটো বানিয়ে বসিয়ে রাখি, তাহলে কদিন পরেই ছাইড়া দে মা কেঁদে বাঁচি বলে দৌড়াবে।
অই দেখা যায় পুরুষ,তারা কি সুন্দর দিনে-দুপুরে-সন্ধ্যা-রাতে রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে আড্ডা দেয়, আমারও তো মন চায় তেমনি আড্ডা দিতে।
তারা মন চাইলেই ঘুরতে যেতে পারে,আমি পারি না, মা বলে বিয়ের পরে জামাই নিয়ে ঘুরবি... কই সেই ছেলেটা তো বউয়ের জন্যে বসে থাকে একটামুহুর্তও...
তারপরেও... আমি নিজের সাধ্যির মধ্যে, সীমাবদ্ধ গন্ডির মধ্যে হাটি,ছুটি, খেলি বেড়াই... তাতেও খুব দোষ... প্রতিনিয়ত কিছু রাস্তার বেওয়ারিশ কুকুরের মতন অচেনা নোংরা পুরুষেরা যেচে পরে আমাকে আমার চারিত্রিক সার্টিফিকেট ধরিয়ে দেয়। যেই পুরুষের দল সারারাত একটা মেয়েকে ধর্ষণ করে আসল বা কোন মানুষকে নৃশংসভাবে হত্যা করল তারাও হয়ত আমার ওড়না সরে যাবার সাথে সাথে গালি দিবে বেশ্যা মাগী বলে।
আমি ভাবি কেজিদরে কোথায় মেয়েদের চারিত্রিক সার্টিফিকেট বেচা হয় জানতে পারলে ভালো হত, সেই বাজারে কেরোসিন ঢেলে আগুন লাগিয়ে দিয়ে আসতাম।
আচ্ছা, আমি যদি কারও পাকা ধানে মই না দিয়েও ভালো থাকি আনন্দে থাকি তবে তোমাদের এত মাথাব্যথার কি হেতু? আমি খুশি থাকা মানে তো এই না যে তোমার সুখ শান্তি কেড়ে কমিয়ে দিয়েছি।