দাড়ি-গোঁফের মাঝে আমরা মৌলবাদের উকুঁন আর ধর্মান্ধতার ছারপোকা খুজঁতে অভ্যস্ত। বিটিভির 'তুখোড়' নামের এক কুইজ প্রতিযোগিতায় প্রখ্যাত কবি নির্মলেন্দু গুণের ছবি দেখিয়ে যখন জিজ্ঞাসা করা হলো এটি কার, নটরডেম কলেজের মেধাবী ছাত্ররা উত্তর দিলো, 'ওসামা বিন লাদেন'!!!
অপরদিকে খোঁচা খোঁচা দাড়ি হলো দেবদাস, পাগল, পড়ুয়া বা প্রচন্ড ব্যস্ত মানুষের মুখোচ্ছবি। সতের-আঠারো বছর বয়সে ছেলেদের দাড়ি-গোঁফ না উঠলে পাড়াপরশীর ঘুম নষ্ট হবার যোগাড় হয়। বন্ধু মহল থেকে মাকুন্দ, পুরুষত্বহীন বিবিধ শব্দ শুনতে পাওয়া যায়। কিন্তু আশ্চর্য লাগে যখন দাড়ি-গোঁফ উঠলেই ততক্ষণাত তা কামিয়ে ফেলাটাই হয় পুরুষত্ব রক্ষার কাজ। না উঠলেও দোষ, আবার উঠলে পড়ে ুক্ষুরের কোপ। নারীদের মত দাড়ি-গোঁফ না উঠলেই তো ভালো-সেভ করার উটকো ঝামেলা থাকতোনা।
ভদ্র সমাজে দাড়ি-গোঁফকে 'নোংরা জঙ্গল' হিসেবে গণ্য করা হয়। পরিপাটি ঘন চুল কিন্তু 'জঙ্গল' নয়। আসলে ব্যাপারটা হলো দৃষ্টি ভঙ্গির। জন্মের পর হতে পুরুষ বলতে দেখে আসছি বা চোখের সামনে ভেসে উঠেছে শ্মশ্রুমুন্ডিত মুখ। রুচিবান সভ্য পুরুষ মাত্রই সেভ করেন । ভারতের পুরুষেরা ঐতিহ্য গত ভাবেই গোঁফকে পুরুষত্বের প্রতীক হিসেবে গণ্য করে। কিন্তু আধুনিক মানুষ পাশ্চাত্যের প্রভাবে স্বঐতিহ্য ফেলে গোঁফ কামানোটাই সৌন্দর্য জ্ঞান করছে। পাশ্চাত্যের ফর্সা লাল মুখ ও দাড়ি-গোঁফ কামানো পুরুষের চেহারা দেখে নারী ভেবে অনেকেই বিভ্রান্ত হন। অথচ তারা এদেরকেই সুদর্শন-সুপুরুষ মনে করেন।
আব্দুল্লাহ আবু সাঈদ স্যার যথার্থই বলেছিলেন, "বাংলা ছবির নায়কদের মুখ হলো ফর্সা গোলগাল টমাটো মার্কা...।" আমরা দাড়ি-গোঁফহীন মেয়েলি চেহারার পুরুষদের সুদর্শন মনে করে আসছি। আসলে পুরুষদের দাড়ি রাখাটা যদি স্বাভাবিক ঘটনা হতো, তবে দাড়ি কাটাটা হতো মাথা মুন্ডানোর মতই বীভৎসতা। বন্ধুরা বলতো, "কীরে তুই গাল কামিয়েছিস!! তোকে তো হাফ লেডিস-নাদান ছেলে লাগছে।" সৈয়দ মুজতবা আলীর ভ্রমণ বিষয়ক গল্প গ্রন্থে পাবেন ফরাসি বিপ্লবের আগে নারীরা দাড়িহীন পুরুষকে কতটা অনীহার চোখে দেখত এবং ফরাসি বিপ্লবের পর পরেই গণ হারে দাড়ি মুন্ডানোর হিড়িক পড়ে যায়। রুচিবোধের বাতাস তারপর থেকে সেদিকেই চলেছে।
পাশ্চাত্য কেন্দ্রীক যে চলনসই রুচিবোধ তাতে গা ভাসিয়ে পুরুষরা ক্লিন সেভ করছে যাতে পরিচ্ছন্নতা গন্ধ পাওয়া যায়-অথচ বগলে চুলের ব্যাপক আবাদ হচ্ছে- যা দেখা যায়না বলে কাটারও প্রয়োজন মনে করা হয়না। নারীদের মাঝে যেটা অনুপস্থিত, শুধু পুরুষ সুলভ-সেটাই হলো পুরুষত্বের প্রতীক। অথচ নিয়ম দোষে এটাই নারীদের কাছে ঘৃণিত। নারীরা তাদের মতই পুরুষের লোমহীন মুখ পছন্দ করে। তাই বলে তা কখনই পুরুষত্বের বড়াই হতে পারেনা।
আমাদের দেশে দাড়ি-গোঁফ দেখলেই ধরে নেওয়া হয় তিনি ধর্ম ভিত্তিক রাজনৈতিক দলের নেতা-ক্যাডার বা হুজুর। সংকীর্ণ এ মানসিকতা আজ সংক্রামক ব্যাধির মত ছড়িয়ে পড়েছে। এ কারণে দলনিরপেক্ষ, শান্তিপ্রিয় শ্মশ্রুধারীদের সমাজে, দেশে-বিদেশে, চাকুরি ক্ষেত্রে, বিয়ের বাজারে, ভিসা অফিসে ব্যাপক হয়রানি আর প্রশ্নবাণের সম্মুখীন হতে হচ্ছে। কলেজ জীবনে অধ্যক্ষকে দেখেছি দাড়ি রাখার অপরাধে এক ছাত্রকে তিরষ্কার করছেন এ বলে যে, "দাড়ি কেন? মাওলানা হবার শখ নাকি?" পরে দেখা গেল ছেলেটি হিন্দু, এক আত্মীয়ের মৃত্যুর কারণে কিছুদিন ক্ষৌরকর্ম হতে বিরত আছে।
যীশুর দাড়ি-গোঁফ ছিল এবিষয়ে কোন মতবিরোধ নেই । প্যাশন অব ক্রাইস্ট ছবিতে আমরা শ্মশ্রুধারী এক পবিত্র মানুষকেই দেখি। অথচ আজ পর্যন্ত কোন পাদ্রী, ফাদার, আর্চ বিশপ, কার্ডিনাল, পোপ বা যীশু ভক্তের দাড়ি-গোঁফের কোন নমুনা দেখলামনা। আগেই বলেছি, খিষ্ট ধর্ম প্রভাবিত হলেও অতীত ভুলে পাশ্চাত্যের সমাজ কিন সেভ করাটাকেই সুপুরুষের বৈশিষ্ট্য মনে করে। এরপরও অভিনেতা আসাদুজ্জামান নূর, আলী যাকের, কথাসাহিত্যিক শওকত ওসমান, প্রয়াত জাতীয় অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাক, কবি গুরু রবীন্দ্রনাথ, কার্টুনিস্ট শিশির ভট্টাচার্য, গায়ক মাহামুদুজ্জামান বাবু, পরিচালক সুভাষ দত্ত দেশের বাইরে চলচিত্র পরিচালক পিটার জ্যাকসন, স্টিভেন স্পিলবার্গ, লেখক সালমান রুশদী, নোবেলবিজয়ী লেখক ভি,এস,নাইপল, বিপ্লবী নেতা ফিদেল ক্যাস্ত্রো, গায়ক লুসিয়ানো পাভারত্তি, রূপ কুমার রাঠোর আরো অনেক বিখ্যাত বুদ্ধিজীবী, অভিনেতা, গবেষক, বিজ্ঞানী, অধ্যাপকের দাড়ি-গোঁফ আছে এবং কেউ বলবেন কী কোন দৃষ্টিভঙ্গি থেকে তাঁরা গালে 'জঙ্গল' চাষ করছেন? এতে আদৌ তাদের কুৎসিত দেখায় কী? 'দি লাস্ট সামুরাই' চলচিত্রে সুদর্শন অভিনেতা টম ক্রুজকে যতটা সুপুরুষ বলে মনে হয়েছে-আগে কোথাও ততটা মনে পড়েনি।
প্রকৃতি শুধু পুরুষকে দাড়ি-গোঁফ দিয়েছে-তাই এটা পুরুষের অলংকার। দাড়িহীন অনেক পুরুষ তৎক্ষনাৎ অনেক নারীদের দাড়ি-গোঁফ ওঠার কথা তোলেন-যেটা নেহাতই একটা অস্বাভাবিক, নিয়ম বর্হিভূত ও দুর্লভ ঘটনা। এখানে নারী পুরুষের অসমতার কোন বিষয় নেই বরং স্বকীয়তার বিষয়টিই মুখ্য। কিন সেভ করে লম্বা চুল রেখে পুরুষরা স্পষ্টতই নারীদেরই অনুকরণ করছে। নারী সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে, পাশ্চাত্যের গোলগাল লালটু চেহারাকে ষ্মার্টনেস ভেবে পুরুষরা প্রকৃত 'ম্যানলি এপিয়ারেন্স' এর সংজ্ঞা ভুলে গিয়েছে-চলছে প্লাস্টিক সার্জারি, লিঙ্গান্তর, কানে দুল ইত্যাদি। বয়স কম দেখায় বলে সেভ করার পিছনে যুক্তি দেখানো হয়। ক্লিন সেভ করে হলেও নারী-শিশু সুলভ তুলতুলে পটাটো মার্কা চেহারা দেখিয়ে নিজেদের সুদর্শন পুরুষরা ভেবে আত্মতৃপ্ত হই। তাই বলে খোঁচা খোঁচা দাড়িকে কখনই ভালো বলা যাবেনা।
কিন্তু পুরোদস্তুর দাড়ি রেখেও যখন পরিচিত মহলে শুনে বিব্রত হই, "কী ব্যাপার দাড়ি!! কেটে ফেলেন! সেভ করে আসুন, তারপর চাকুরি! ছবি তুলবেন, সেভ করে আসেন! দাড়ি রাখলে একালে বিয়ে হবেনা" তাহলে তো মাথার জঙ্গলও সাফ করতে হয়। খুব ফর্সা এক যুবককে দেখলাম মাথা, গাল কামিয়ে এসেছে কিন্তু কালো ভ্রু জোড়ার কারণে তাকে বীভৎস দেখাচ্ছে।এখন সেটাও কামানো দরকার।
চুল ও ভ্রু হলো সাধারণ মানবীয় অলংকার-আর গোফ-দাড়িটা কেবল পৌরুষের বহিপ্রকাশ-এটা নারীরা স্বীকার নাই করুন, তথাকথিত রুচিবান পুরুষেরা নাই মানেন- যুক্তি কখনও তাদের প েযাবেনা। যারা 'দাড়িওয়ালা' বলে টিটকারী দিয়ে মানুষকে বিব্রত করেন-যদি বলি আপনারা দেখতে গোফ- দাড়িহীন নপুংশকের মত তবে সেটা কী ভালো শুনাবে? ভাঙ্গা গাল আর মেয়েলি চেহারার পুরুষদের জন্য গোফ-দাড়ির আর কী বিকল্প আছে? গোফ-দাড়ি রাখা না রাখার মত নিরাপরাধ স্বাধীনতার উপর হস্তপে করাটা বাবা-মার পুরোপুরি অন্যায় অনাধিকার চর্চা। পরিমিত আকারে গোছনো গোফ-দাড়িতে পুরুষদের কখনই এতটা কুৎসিত লাগেনা যে সবসময় তা সেভ করার তাগিদ দিতে হবে। নারীদের চুলের মতো পুরুষের গোফ-দাড়ির যে কত বৈচিত্র্য আর ফ্যাশন হতে পারে তা নিয়ে আমরা চিন্তা করিনা কারণ পুরুষের গালে জঙ্গল হয় তা কামিয়ে ফেলার জন্য-ফ্যাশানের অনুষঙ্গ এটা নয়।
পাশ্চাত্যের যুবারা মূলত ফ্রেঞ্চ কাট দেয় বলে শুধু সে ধরনটাই আমাদের কাছে গ্রহণযোগ্য। অনেককেই দেখা যায় ধর্মের কারণে গোফ কামিয়ে বিশাল দাড়ি রাখে-এটা সামঞ্জস্যহীন ও দৃষ্টি কটু। নগরের অতি ব্যস্ত মানুষ পরিমিত গোফ-দাড়ি রেখে অর্থ ও সময় সাশ্রয় করতে পারবেন, অলসতার কারণে খোঁচা খোঁচা দাড়ির অপবাদ হতে রেহাই পেতে পারেন। পেতে পারেন কাটাছেড়ামুক্ত ঝামেলাহীন জীবন। রেজরের বিজ্ঞাপনে গোঁফ-দাড়ি শূণ্য পুরুষকে রূপবান বলাটা আমাদের অনভ্যস্ত চোখের বিভ্রম । নারীদের রুচি বা পছন্দ কী পুরুষের মুখ ও ফ্যাশানের প্রভাবক হওয়া উচিৎ? বরং পুরুষের নিজস্ব রুচিবোধ প্রকাশ করতে পারাটাই তাদেও স্বাতন্ত্র্য ও স্বকীয়তার পরিচয়বহ।
যেকোন ডাক্তারের পরামর্শ নিন-তিনি দাড়ি সেভ করলে ত্বক ও স্নায়ু তন্ত্রের ক্ষতির কথা উল্লেখ করে সপ্তাহে তিনবারের বেশি সেভ করতে নিষেধ করবেন। পুরুষের চেহারায় কিছুটা গাম্ভীর্য ও কাঠিন্য থাকাটাই শোভনীয়। গোফ-দাড়ি গাম্ভীর্য ও কাঠিন্য আনে। এটা ব্যক্তিত্ব্য, জ্ঞান ও পবিত্রতার প্রতীক। প্রফেসর-বিজ্ঞানী বলতেই চোখের সামনে দাড়ি-গোফ মন্ডিত মুখ-একটা আলাদা ভাব-গাম্ভীর্য আসে। এটাকে শুধুই বার্ধক্যের অনুষঙ্গ মনে করাটা অযৌক্তিক।
তারপরও গোফ-দাড়ি কেটে নারীর সাদৃশ্য গ্রহণ করবেন এটা আপনার ইচ্ছা। তাই বলে শ্মশ্রুধারীদের বিব্রত করা, গালি দেওয়া, কাটার পরামর্শ দেয়া (যদি খোঁচা খোঁচা না হয়), রাখার কারণ জানতে চাওয়া, হয়রানি করা, বিশেষ বিতর্কিত দলভুক্ত মনে করে হেয় বা ঘৃণা করা, এক ঘরে করে রাখাটা পুরোপুরি যুক্তিবিরুদ্ধ, অন্যায় অনধিকার চর্চা। সজ্ঞানে পৌরুষের পোশাক ফেলে দিয়ে অন্যের পোশাকের যৌক্তিকতা ধরে টানাটানি করাটা আদৌ ভদ্রোচিত, বিবেকবান ও বুদ্ধিমানের কাজ নয়।