এমিলি তার প্রেমিকের সাথে ড্রাইভ করে পাহাড়টিতে উঠেছিল। কে জানতো এই যাত্রাই শেষ যাত্রা এমিলির। যাত্রা পথে প্রেমিকের সাথে কথা কাটাকাটি হয় এবং এমিলি তেজ দেখিয়ে গাড়ি থেকে নেমে গহীন পাহাড়ে বেরিয়ে পরে। এর পর থেকে আর এমিলিকে কোথাও খুঁজে পাওয়া যায়নি। তারপর পেরিয়ে গেছে বহু বছর, এখনো প্রচলিত আছে সাধা ধবধবে পোশাকে পাহাড়ের রাস্তায় এখনো এমিলির ভাটাকতে হুয়ে আতমাকে দেখতে পাওয়া যায়। কোন পর্যটক মানুষ ভেবে পাহাড়ের চূড়ায় নিয়ে গেলে আবার অদৃশ্য হয়ে যায় এমিলি। এটি একটি লোককথা, এরকম অজস্র লোককথা প্রচলিত আছে মাউন্ট লেমনকে ঘিরে। মাউন্ট লেমন আমেরিকার এরিজোনার বিখ্যাত এক পাহাড়, পাহাড়টি অদ্ভুত সুন্দর এবং ভৌতিক, ভূমি থেকে এর উচ্চতা গড় উচ্চতা ৯০০০ ফুটের বেশী। আমি প্রায় প্রতি সপ্তাহেই বেরিয়ে পরি কোথাও না কথাও। সপ্তাহ দুয়েক আগের রবিবার ঘুরে এলাম এই মাউন্ট লেমনে। আমি সাধারণত রবিবারে ঘুরাঘুরি এড়িয়ে চলার চেষ্টা করি যেহেতু সোমবারে অফিস শুরু আবার তবে সেই সপ্তাহের শনিবারে বাসায় দুটি ফ্যামিলিকে ভূরিভোজের আমন্ত্রণ জানিয়েছিলাম বিদায় রবিবারেই বেরিয়ে এসেছিলাম মাউন্ট লেমনে।
যাত্রা পথে গাড়ি থামিয়ে ছেলের একটি ছবি।
আমি আমেরিকার এরিজোনার টুসন শহরে থাকি আর এই পাহাড়টিও এই শহরেই অবস্থিত। সেই হিসেবে আমার বাসা থেকে প্রায় ৪০ মাইল দূরে অবস্থিত মাউন্ট লেমন। আমেরিকায় এই দুরুত্ব খুবই মামুলি ব্যাপার। আমি মাউন্ট লেমনের কথা প্রথম শুনি আমার বসের মুখে, আমি এরিজোনায় মুভ করার পরে তার সাথে প্রথম আড্ডায় তিনি আমাকে জানালেন আমার নাকি মাউন্ট লেমনে যাওয়া ফরজ বাকি সব নফল। তবে এই কয়েকমাস এই ফরজ কাজটি ফেলে রেখে আশেপাশের লেইক, ষ্টেট পার্ক-সহ পুরো শহর ঘুরে ঘুরে তেজপাতা বানিয়ে ফেলেছি। ভাবছিলাম একটু ঠাণ্ডা পরলেই মাউন্ট লেমন গিয়ে ফরজ কর্মটি সম্পাধান করব। এই মাসের তাপমাত্রা কমেছে, আবহাওয়াও এখন দারুণ সহনশীল থাকছে, একেবারে যাকে বলে খাপে-খাপ।
পাহাড়ের সরু রাস্তা।
আমি পরিবার-সহ রোববার সকাল সকাল বেরিয়ে পরলাম। আমাদের বাসা থেকে ১০-১৫ মাইল গাড়ি চালানোর পরই এই পাহাড় শুরু, বাকি পঁচিশ মাইল আসতে আসতে উপরে উঠতে হয় পাহাড় বেয়ে। ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে মাইলের পর মাইল ড্রাইভ করে এর চূড়ায় উঠতে হয়। আমরা দুপুর ১ টার দিকে রওনা দিয়েছিলাম, রাস্তা যেন শেষ হয় না। পাহাড়ের বুক বেয়ে এগিয়ে চলছি, উঁচু নিচু পাহাড়, বেয়ে উঠে চলছি পাহাড়ে, নীরব রাস্তা, গাড়ি খুব একটা দেখা যাচ্ছিল না। আকা-বাঁকা গহীন রাস্তা, গাড়ির গতি বেশী বাড়ানো যায় না, তার উপর একটু চালানোর পর দেখি গাড়ি স্পিড বারে না, খাড়া পাহাড়। আমার গাড়ি যে ছোট তেমন না। আমার SUV বড় গাড়ি, তারপরও গাড়ি উঠার সময় মনে হয় গাড়ির অবস্থা হালুয়া টাইট হয়ে যাচ্ছে! ভাবতে অবাক লাগে এই বিশাল ভৌতিক পাহাড়টি সারা প্লামপার লেমন ( botanist Sara Plummer Lemmon) নামক মহিলাটি পায়ে হেটে পারি দিয়েছিল! সারা লেমন পেশায় একজন উদ্ভিদ বিজ্ঞানী ছিলেন, এই মহীয়সী নারী ১৮৮০ সালে তার স্বামীকে নিয়ে সর্বপ্রথম এই পাহাড় জয় করেন! অথচ সেই সময় না ছিল গাড়ি, না পাহাড়ে কোন রাস্তা। তার উপর বিষাক্ত সাপ, পাহাড়ি সিংহ এবং ভাল্লুকের ভয়তো ছিল, এখনো পাহাড়ী ভাল্লুক এবং পাহাড়ী সিংহ আছে এখানে! এই সব বাধা পেরিয়ে কয়েক দিন সফর করে সাঁরা এবং তার স্বামী প্রথম এই পাহাড় জয় করেন। তাই সারা লেমনের নাম অনুসারেই এই পাহাড়ের নাম করন করা হয় মাউন্ট লেমন।
আমরা দুজন।
প্রকৃতির অপার সৌন্দর্য্য
"লেডি অব লেইক" বাংলায় তর্জমা করলে যার অর্থ দাঁড়ায় লেইকের মহিলা, তবে এটা সাধারণ কোন মহিলা নন, ভাটাকতে হুয়ে আতমা। মাউন্ট লেমনের উঠার সময় ছোট বড় অসংখ্য পাহাড় পারি দিয়ে যেতে হয়, রাস্তায় পরে কিছু লেইক। প্রচলিত লোককথা অনুসারে এই লেইক গুলোর কোন এক লেইকে থাকে এই মহিলার আতমা। কথিত আছে এই লেডি অব লেইকের ভবলীলা সাঙ্গ হয়েছিল এখানকার কোন এক লেইকে ডুবে। কথিত আছে মাঝে মাঝেই এই ভাটাকতে হুয়ে মহিলার আতমাকে লেইকেই পাশে দেখা যায়। তবে আমাদের ভাগ্য ভাল বলতে হয়, লেইকের পাশ দিয়ে ড্রাইভ করে যাবার সময় কোন আতমা-মাতমা আমার চোখে পরেনি। এরিজোনা তাপমাত্রা অনেক গরম এবং শুষ্ক তবে এই পাহাড়ের উপরের তাপমাত্রা নীচের তুলনায় ১৫ ডিগ্রির-মত কম। তাছাড়া মরুভূমির এই এখানেও এই পাহাড়ের উপর শিতের সময় বরফ পরে, এখানে স্কি করা যায়। এরিজোনায় এমন কোন জায়গা থাকতে পারে এখানে আসার আগে আমার ধারনাই ছিল না। আমরা যাত্রা পথে জায়গায় জায়গায় ব্রেক দিয়ে গাড়ি থেকে নেমে প্রকৃতির এই অপার সৌন্দর্য ভক্ষন করছিলাম।
এই ছবিটি পাহাড়ের একেবারে চূড়ায় উঠে তুলেছিলাম। যখন পৌছালাম প্রায় সন্ধ্যা হয়ে আসছিল।
আমরা সারাদিন ঘুরাঘুরি করে সন্ধ্যার দিকে বাসায় রওনা দিলাম। আসার সময় সুপার মার্কেট হয়ে কিছু কেনাকাটা করে পৌছে গেলাম বাসায়। এই ভ্রমনটি অনেকদিন স্মৃতিতে রয়ে যাবে।
আরো কিছু ছবিঃ