এক.
গ্রাভিটেশনাল ফোর্সের তারতর্মের জন্য ল্যাবরেটরির জিনিষপত্রগুলো দুলে উঠল। টেবিলে রাখা অসিলেস্কোপ এবং মাল্টিমিটার যন্ত্রটি বাতাসে ভেসে আচরে পড়ল মেঝেতে। মাথার উপরে ঝুলে থাকা লাইটটি তীব্র আলোর ঝলকানি দিয়ে আবার স্বাভাবিক হয়ে গেল।
' গ্রাভিটিশনের সাথে সময়ের একটি নিবিড় সম্পর্ক আছে, বুঝলেন-তো ?' ক্ষুদ্র একটি ইলেকট্রনিক ডিভাইস পরীক্ষা করতে করতে বললেন বিজ্ঞানী গেইল।
উত্তরের অপেক্ষা না করেই বললেন ' এখন আমরা গ্রাভিটিকে যদি নিয়ন্ত্রণ করতে পারি তাহলে কিন্তু সময়কে নিয়ন্ত্রণ করতে পারব। আমরা জানি গ্রাভিটির সাথে আবার ভরের একটি সম্পর্ক আছে, যেমন হালকা বস্তুর তুলনায় ভারি বস্তুর গ্রাভিটি বেশী। যদি একটি নিদিষ্ট রেডিয়াসের ভিতর অসীম ভর যুক্ত বস্তু তৈরি করতে পারি তাহলে সেখানে উচ্চ মাত্রা গ্রাভিটি পাব। ঠিক কিনা ?'
সামনের চেয়ারে বসা দীর্ঘদেহী লোকটি ঈষৎ বিরক্তি নিয়ে কথাগুলো শুনছিল। লম্বা দাড়িতে মুখমণ্ডল ঢেকে আছে, ঘন প্রশস্ত গোঁফ, তাতে অনবরত তা দিয়ে চলেছেন তিনি।
' হুম' বলেই অনিচ্ছা সত্বেও মাথা ঝাঁকিয়ে সমর্থন জানালেন লোকটি। গেইলের কথায় তার কোন ভ্রূক্ষেপ নেই দেখেই বুঝা যাচ্ছে। লোকটি বেশ অস্বস্তি নিয়ে চারদিকে তাকিয়ে পরখ করে নিচ্ছে।
হাতে ধরে থাকা ছোট ডিভাইস দেখিয়ে বললেন 'আমার স্বপ্ন আমি টাইম মেশিন বানাব, পৃথিবীর বিভিন্ন সময়ে ঘুরে বেড়াব, ইতিহাসের ঐতিহাসিক ঘটনাগুলো প্রত্যক্ষ করব, ভাবুনতো একবার আপনি আইনস্টাইনের সাথে বসে চা খাচ্ছেন অথবা নিউটনের সাথে বসে মাথায় আপেল পরা নিয়ে খোশ-গল্প করছেন! কেমন লাগবে ব্যাপারটা ?' গেইলের চোখটা খুশিতে চিক চিক করে উঠল।
তিনি বলে চললেন 'এই ডিভাইসটি বানিয়েছি যাতে একটি নিদিষ্ট রেডিয়াস জুড়ে গ্রাভিটি নিয়ন্ত্রণ করা যায়। দেখতেই পাচ্ছেন এখনও পুরোপুরি সফল হইনি।'
এর ফিজিক্সটা কি আপনাকে বুঝিয়ে বলি বলেই বেশ উৎসাহ নিয়ে বলে চললেন গেইল 'ডিভাইসটার ভিতরে একটি অতি ক্ষুদ্র পারমাণবিক ব্যাটারি আছে যেটা দিয়ে ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক ফিল্ড তৈরি করা হয়। এই ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক ফিল্ড ক্রমাগত ফোটন ট্রান্সমিট করে। এই ফোটনের নিজস্ব ভর আছে। এখন যদি অসীম সংখ্যক ফোটন জেনারেট করে এর ভরকে এমপ্লিফাই করা যায় তাহলে কিন্তু অসীম ভর পাব যা দিয়ে সহজেই গ্রাভিটিকে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। আর গ্রাভিটিকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারলে টাইম ট্রাভেল করা সম্ভব।'
যতটা উৎসাহ নিয়ে বলছে গেইল, তততাই নিরুৎসাহিত হয়ে শুনছে আগন্তুক।
আরো কিছু বলতে যাচ্ছিল গেইল। তাকে থামিয়ে দিয়ে আগন্তুক প্রসঙ্গ পাল্টানোর সুরে বললেন 'আপনি একাই থাকেন ?'
'একাই থাকি বলা যায় না। এই যে ল্যাবরেটরিটা দেখছেন এটা আসলে একটি স্টোরেজ রুম ছিল, এটাকে এখন ল্যাবরেটরি বানিয়েছি। উপরের তলাতে আমি আমার পরিবার নিয়ে থাকি, পরিবার বলতে আমি আর আমার স্ত্রী এইতো। জনের কাছ থেকে নিশ্চয়ই আমার সম্পর্কে জেনেই এসেছেন, আমরা খুবই ভাল বন্ধু ছিলাম কলেজ লাইফে। জন কেন পাঠিয়েছে বলবেন ?'
'বলছি! আপনার স্ত্রীকে দেখছিনা আজ ?' গোঁফে তা দিতে দিতে বলল লোকটি
'বাসায় নেই এখন।'
'ওহ তাহলে আপনি একা ?' বলল লোকটি। চেহারায় শরিফ ভাব ছিল এতক্ষণ, সেটা উবে গিয়ে একটি ধুরন্ধর একটি ভাব ফুটে উঠল সেখানে।
একটি কৃত্রিম হাসি দিয়ে পুনরায় আগন্তুক বলল 'আমাকে কি চিনতে পেরেছেন ?'
'না! তবে কিছুটা চেনা চেনা লাগে! আমার কি আপনাকে চেনার কথা ?' বেশ বিভ্রান্ত হবার ভঙ্গিতে বলল গেইল।
লোকটি বেশ মজা পেল বলে মনে হল। নিজের মুখে লেগে থাকা কৃত্রিম লম্বা দাড়িয়ে টান দিয়ে খুলে ফেলল। তারপর টেবিলে ঝুঁকে এসে পড়ল।
গেইল আগন্তুকের চেহারায় তাকিয়ে যা দেখল তাতে ভূত দেখার মত চমকে উঠল।
'এটা কিভাবে সম্ভব ?' গেইলকে দেখে বুঝার উপায় নেই কত বড় বিস্ময় নিজের বুকে চাপা দিয়ে রেখেছে।
'আমি গেইল, আজ থেকে দশ বছর পরের গেইল।' বলেই পুনরায় চেয়ারে হেলান দিল লোকটি।
'আমি বুঝলাম না ?' শুকনো গলায় বলল গেইল।
'তুমি মানে আমরা দুজন সফল হয়েছি। আমাদের পরিশ্রম সফল হয়েছে, মানুষের যেই অধরা স্বপ্ন ছিল, যাকে এতদিন অসম্ভব ভেবে এসেছে, আমরা দুজন সেটাকে সফল করেছি। অবশেষে আমরা টাইম মেশিন বানাতে পেরেছি।'
গেইল বুঝতে পারছে না তার এই মুহূর্তে কি করা উচিৎ। প্রচণ্ড ভালোলাগা এবং বিস্ময়ের একটি মিশ্র অনুভূতি বুকের মাঝে ছড়িয়ে পরছে।
দুই.
'কিভাবে সম্ভব এটা ? কবে তৈরি হল আমাদের এই টাইম মেশিন? এখনও পর্যন্ত গ্রাভিটি ভালভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে পারছি না, কিভাবে হল? ' গেইলের প্রশ্ন যেন শেষই হচ্ছে না, বুকের ভিতর ধড়ফড় করছে তার।
হাফাতে থাকে গেইল, কথা বলতে বলতে ষ্টকের অক্সিজেন ফুরিয়ে গেলে লম্বা একটি দম নিয়ে ফের জিজ্ঞেস করল 'কবে সম্বব হল এটা ? '
'শান্ত হও জুনিয়র গেইল, আসতে আসতে সব বলছি! তুমি আমার দশ বছর আগের ভার্সন, সেই হিসেবে তোমাকে জুনিয়র গেইল বলতে পারি। আমি তোমার সিনিয়র তাই তুমি আমাকে সিনিয়র গেইল বলতে পার! কি বল ? ' হো হো করে শরীর ঝাঁকিয়ে হেসে বলল সিনিয়র গেইল।
'হুম' উৎসুক হয়ে তাকিয়ে জবাব দিল।
'আজ থেকে সাত বছর পর আমার মানে আমাদের দুজনের এই গবেষণা সফল হয়েছে। আমাদের হাইপোথেসিস কাজ করেছে, তবে ব্যাপারটা যত সহজে বললাম ব্যাপারটা তা নয়, অনেক ইরর এবং ট্রায়ারের ভিতর দিয়ে যেতে হয়েছে আমাদের, টাইম সমীকরণের বিভিন্ন মানের জন্য পরীক্ষা করতে হয়েছে।' জীব দিয়ে ঠোট ভিজিয়ে বলল সিনিয়র গেইল।
'নিশ্চয়ই পৃথিবীতে তুমি বিখ্যাত হয়ে গেছ, টাকা পয়সার অভাব নেই, সুখে শান্তিতে আছ, নিজের খ্যাতিকে উপভোগ করছ ? '
'সময়ের সাথে মানুষের জীবনের পারসেপশন পরিবর্তন হয়, মানুষ এক সময় যেই জিনিষটাকে না পেলে জীবন বৃথা ভাবে, জীবনের একটা সময়ে মনে হয় সেই জিনিষটার পিছনে বৃথাই সময় নষ্ট করেছে। জীবনের চলার পথে নতুন অভিজ্ঞতা হয়, নিজের ব্যক্তিত্বের, আদর্শের জায়গার পরিবর্তন এবং পরিমার্জিত হয়ে পরিপূর্ণতা লাভ করে! সাফল্য বলতে আমি দশ বছর আগে মানে তুমি এখন যা ভাবছ এক সময় পরিবর্তন হবে।' বলেই থেমে যায় সিনিয়র গেইল।
নীরবতা ভেঙ্গে আবার বলে 'সফলতা বলতে যদি ভাব টাকা পয়সা, খ্যাতি তা হলে বলতে পার আমি সুখে আছি!' কেমন কৃত্রিম একটি হাসি দেয়।
'আমি ঠিক বুঝলাম না ? '
'দিনকে দিন তুমি আরও ব্যস্ত হয়ে পরবে, টাইম মেশিন বানানোর নেশা তোমাকে পেয়ে বসবে, নিজের ব্যক্তিগত এবং পারিবারিক জীবন থেকে দূরে সরে যাবে, তোমার স্ত্রী তোমাকে ছেড়ে চলে যাবে, এক সময় তুমি একা হয়ে যাবে আমার মত।' সিনিয়র গেইলের কণ্ঠে হতাশা ঝরে পড়ে।
একটু থেমে আবার বলে 'আমাদের প্রজেক্ট সফল হয়েছে, তবে একটা সমস্যা আছে' দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে সিনিয়র গেইল।
'কি সমস্যা ? '
'টাইম ট্রাভেল করে শুধু অতীতে যেতে পারি, কিন্তু ভবিষ্যতে ফিরতে পারি না! বুঝতেই পারছ আমি আর ভবিষ্যতে ফিরে যেতে পারব না।'
'তোমার সেই টাইম মেশিনটা কোথায়? সেটি পরিবর্তন করে দুজন মিলে হয়ত ভবিষ্যতে যাবার উপযোগী করতে পারি' বলল জুনিয়র গেইল।
'তুমি টাইম মেশিনটাকে মনে হয় পোর্টেবল ডিভাইস ভাবছ, ব্যাপারটা তেমন নয়, সেটা ভবিষ্যতে আছে। তাছাড়া আমি ফিরে যাবার জন্য আসিনি। আমি আমার জীবন নতুন করে শুরু করতে চাই, আমি জীবনে যেই ভুলগুলো করেছি, সেগুলো আর করতে চাই না।' বলেই ধূর্তের মত হাসি দিল সিনিয়র গেইল।
'বুঝলাম না।'
'বুঝতেই পারছ। একই সময় দুই গেইল এক সাথে থাকতে পারবে না! হয়তো তুমি নয়ত আমি, দুজনের একজন থাকতে হবে!আমি ব্র্যান্ড নিউ জীবন শুরু করতে চাই।' বলেই পকেটে হাত দিয়ে লেজার গানটা বের করে সিনিয়র গেইল।
বুকের ভিতরটা মোচর দিয়ে উঠে জুনিয়র গেইলের।
'এটা তুমি করতে পার না!' আতঙ্কিত কণ্ঠে বলে জুনিয়র গেইল।
লেজার গান দিয়ে শূর্ট করে জুনিয়র গেইলের কপাল বরাবর।
কয়েক মিনিট পরে দরজায় কড়া নারার শব্দে পিছনে তাকায় সিনিয়র গেইল। কেউ একজন লেজার গান দিয়ে তাকে গুলি করে বলে 'আমি আবার তোমার দশ বছর পরের গেইল, ব্র্যান্ড নিউ জীবন শুরু চাই।' কিছুক্ষণ পর আরেকজন এসে তাকে আবার গুলি করে বলে 'আমি তোমার দশ বছর পরের ভার্সন, ব্র্যান্ড নিউ জীবন শুরু চাই।' এভাবে চলতেই থাকে চক্র, এক জনের পর আরেক জন এসে নিজেই নিজেকে মারতে থাকে।
সর্বশেষ এডিট : ২৯ শে অক্টোবর, ২০১৮ রাত ৮:১২