পর্ব ১: টাইম মেশিন কল্প না বাস্তবতা, থিওরিটিকাল বিজ্ঞান কিন্তু বলে এটা সম্ভব
এই সিরিজের প্রথম পর্বে নচিকেতার একটা গানের কলি দিয়ে শুরু করেছিলাম, '' যখন সময় থমকে দাঁড়ায়,নিরাশার পাখি দু’হাত বাড়ায় '' ! এই গানের কথামত সময়কে কি সত্যিই থমকে দেয়া যায়! অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি অন্তত বিজ্ঞান বলে সময়কে থামিয়ে দেয়া সম্ভব। আগের পর্বে সময়কে থামিয়ে দেবার একটা তরিকা সম্পর্কে আলোচনা করেছিলাম, এই পর্বে সময়কে থমকে দেবার আরেকটি তরিকা সম্মন্ধে আলোকপাত করব। শুধু সময়কে থমকে দেয়া নয় সাথে কিভাবে একটি ছায়াপথ, মহাজগৎ থেকে অন্য ছায়াপথ এবং মহাজগৎ-এ পারি দেয়া যায় সেই ব্যাপারগুলো তুলে ধরার চেষ্টা করব।
আমরা স্থান এবং কালকে আলাদা হিসেবে বিবেচনা করি। কিন্তু বিজ্ঞানীরা স্থান এবং কালকে আলাদা হিসেবে ধরেন না বরং তারা এটাকে বলেন স্থান-কাল বা স্পেস-টাইম। স্থানের সাধারণত তিনটি ডাইমেনশন থাকে এবং সময়কে আরেকটি ডাইমেনশন হিসেবে ধরে স্থান-কালকে বলা হয় চতুর্থ ডাইমেনশন।
আইনস্টাইনের স্পেশিয়াল থিওরি অব রিলে-টিবিতে স্থান-কালের এর মাঝে সম্পর্ক খুব সুন্দরভাবে ব্যাখ্যা করেছেন এবং তিনি দেখিয়েছেন কিভাবে এই সূত্র কাজে লাগিয়ে টাইম মেশিন বানান যায়। আমি আমার আগের কোন এক লেখায় এই বিষয়ে লিখেছিলাম(আইনস্টাইনের আপেক্ষিক তও্ব) ।
টাইম মেশিন মানে সময়কে থমকে দেয়া বা পারি দেয়ার আরেকটি পদ্ধতির মধ্যে অন্যতম হল ওয়ার্ম-হোল।ওয়ার্ম-হোল একটা কনসেপ্ট যেটা ব্যাবহার করে বিলিয়ন বিলিয়ন আলোকবর্ষ পরিমাণ দুরুত্ব খুবই অল্প সময়েই পার হওয়া যায়। ধরুন বিশাল একটি দুরুত্বের স্থান-কাল আছে। ওয়ার্ম-হোল সাধারণত এই বিশাল দুরুত্বকে একটি শর্টকাট টানেলের মাধ্যমে সংযুক্ত করে। এই বিশাল দুরুত্বটা হতে পারে কয়েক মিলিয়ন/বিলিয়ন আলোক বর্ষ।এই দুরুত্বটা একটা ইউনিভার্সের ভিতরও হতে পারে অথবা দুইটা ইউনিভার্সের ভিতরকার দুরুত্বও হতে পারে।
এবার এর টেকনিক্যাল ব্যাপারটা খুব সংক্ষেপে ব্যাখ্যা করা যাক। আমরা জানি ব্ল্যাক-হোল হল উচ্চমাত্রা গাভীটি সম্পূর্ণ বস্তু যেখানে স্বয়ং আলো প্রবেশ করলেও সেখান থেকে বের হতে পারে না। ব্ল্যাক হোলের প্রচণ্ড গ্রাভিটি ফলে সেখানে সময়ও স্থির।বিজ্ঞানী নিউটনের সূত্র মতে প্রতিটি বস্তুরই একটা সমান এবং বিপরীত মুখী ক্রিয়া এবং প্রতিক্রিয়া আছে। যেহেতু ব্ল্যাক-হোল উচ্চ মাত্রার গ্রাভিটি সম্পূর্ণ বস্তু তাই এর বিপরীত মুখী একটা প্রতিক্রিয়াও থাকাটাও আবশ্যক।অস্টিয়ান পদার্থবিদ Ludwig Flamm এই ব্যাপারটা সর্বপ্রথম অনুধাবন করেন, এবং তিনি এই বিপরীত ক্রিয়ার নাম দেন হোয়াইট-হোল যেটা ব্ল্যাক হোলের বিপরীত একটি ক্রিয়া। যার মানে দাঁড়াচ্ছে এই ব্ল্যাক-হোলের অপর প্রান্তই হল এই হোয়াইট-হোল। এই দুই হোলই মূলত দুইটা সম্পূর্ণ বিশাল দুরুত্বের স্থান-কালকে টানেলের মাধ্যমে সংযুক্ত করেন। ১৯৩৫ সালে আইনস্টাইন তার বিখ্যাত থিওরি জেনারেল থিওরি অব রিলেটিভিটি দিয়ে ওয়ার্ম-হোলের অস্তিত্ব ব্যাখ্যা করেন।
ওয়ার্ম-হোল ব্যাপারটাকে একটি উদাহারণ দিয়ে খুব সহজ ভাষায় বলা যাক। ধরুন একটি কাগজের টুকরো আছে। এই কাগজটাকে ’U’ শেইপ করুন। লক্ষ্য করুন এই ’U’ শেইপের শেষে দুইটা প্রান্ত আছে, এখন একটা প্রান্ত থেকে আরেকটা প্রান্তের দুরুত্ব মাপা যাক। এই ’U’ শেইপের এক প্রান্ত থেকে পুরো ’U’ শেইপ ঘুরে অপর প্রান্তের দুরুত্বটা যদি মাপি তাহলে এর দুরুত্বটা অনেক বেশী হবে। আরেকভাবে আমরা এই দুরুত্ব মাপতে পারি, এই পুরো ’U’ শেইপ না ঘুরে সরাসরি দুইটি প্রান্তের দুরুত্ব মাপতে পারি। ওয়ার্ম-হোল মূলত এই কাজটাই করে, পুরো ’U’ না ঘুরে একটি টানেলের মাধ্যমে সরাসরি দুইটি প্রান্তের মাঝে সংযোগ স্থাপন করে।
উপরের উদাহরণটাতে সামান্য একটু পরিবর্তন করুন কল্পনা করুন। আইনস্টাইন তার জেনারেল থিওরি অব রিলেটিভিটিতে এই স্থান-কালকে একটি ফেব্রিক বা চাদরের সাথে তুলনা করেছেন। তাই এবার কাগজের জায়গায় একটি চাদরকে কল্পনা করুন। ধরুন আমাদের এই ইউনিভার্সটা একটি বিশাল চাদর, আমাদের গ্রহ ,উপগ্রহ , নক্ষত্র এবং ছায়াপথগুলো এই চাদরের উপরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। এই বিশাল চাদরটা বিভিন্ন আকৃতির হতে পারে। চাদরটা যদি ’U’ শেইপের হয় তাহলে বুঝতেই পারছেন ওয়ার্ম-হোল ব্যাবহার করে আমরা চাদরের এক পাশে ছিদ্র করে অপর প্রান্তে খুব সহজেই পৌঁছে পারি। সাধারণভাবে স্থান-কালের দুরুত্ব পারি দিতে যেখানে লাগবে কয়েক বিলিয়ন আলোক বর্ষ সেইখানে ওয়ার্ম-হোলের ছিদ্র দিয়ে টানেলের মাধ্যমে গেলে আমরা হয়ত কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই এক ছায়াপথ থেকে আরেক ছায়া পথে পৌছাতে পারি।
ওয়ার্ম-হোলের ব্যাপারটা ব্যাখ্যা করা গেল, এবার এই ওয়ার্ম হোল দিয়ে কিভাবে টাইম মেশিন বানান যায় তার তরিকা সম্পর্কে আলোকপাত করা যাক। আইনস্টাইনের স্পেশিয়াল থিওরি অব রিলেটিভিটিতে বলেছেন কোন বস্তু যখন আলোর গতির কাছাকাছি বা বেশী গতিতে যায় তাহলে সে সময় পরিভ্রমণ করতে পারে। লক্ষ্য করে দেখুন ওয়ার্ম-হোল মূলত দুইটা আলাদা স্থান-কালকে একটি টানেলের মাধ্যমে সংযুক্ত করে যার দুরুত্ব অনেক।উপরে উদাহারনে দেখলাম আমরা অনেক বড় দুরুত্বকে ওয়ার্ম-হোলের মাধ্যমে পার হতে পারি আমরা, ওয়ার্ম-হোল ব্যাবহার না করে গেলে হয়ত কয়েকশত আলোকবর্ষ লাগতে পারত। এই কয়েকশত আলোক বর্ষের দুরুত্ব কয়েক ঘন্টায়ই পার হওয়া যায় মানে আলোর গতির বেশী গতিতে যাওয়া যায়। তাই আইনস্টাইনের স্থান-কালের সূত্র অনুসারে ওয়ার্ম-হোলও টাইম-ট্রাভেল মেশিন হিসেবে ব্যাবহার করা যায়। এবার আপনি ধরুন ওয়ার্ম-হোলের এক প্রান্ত দিয়ে সকাল নয়টায় রওনা দিয়ে অন্য-প্রান্তে পৌঁছালেন দুপুর বারটায় আবার সেখান থেকে পুনরায় নিজের স্থানে ফিরে এলেন তিনটায়। আপনি এসে হোঁচট খেলেন, মাত্র ছয় ঘণ্টা পর আপনার গন্তব্যে এসে দেখলেন পেরিয়ে গেছে প্রায় কয়েকশত বছর।
আইনস্টাইনের স্পেশাল থিওরি অব রিলেটিভিটি সূত্র অনুসারে টাইম মেশিন বানাতে হলে আপনাকে এমন এক যান বানাতে হবে যার গতি আলোর গতির সমান অথবা বেশী। একমাত্র আলো মাস-লেস/ভরবিহীন ফোটন এই গতিতে যেতে পারে, যেহেতু যানের নিজস্ব ভর আছে তাই বাস্তবিকতা চিন্তা করলে এমন কোন যান বানানো সম্ভব না যেটা কিনা আলোর গতির কাছাকাছি বা তা অতিক্রম করতে পারেন। সেই ক্ষেত্রে ওয়ার্ম-হোল ব্যাবহার করে টাইম মেশিন বানানোর পদ্ধতিটাই অনেক বেশী লজিকাল।
যাইহোক, ওয়ার্ম হোলের একটা প্রতিবন্ধকতা আছে, বিজ্ঞানীদের মতে ব্ল্যাক হোলের যেই ওয়ার্ম-হোল তৈরি হয় তার ছিদ্রটা খুবই ক্ষুদ্র যেটা একটা ফোটনের সমান, সেটা দিয়ে কোন স্পেস যান সেখান দিয়ে যেতে পারবে না। তাছাড়া এই ওয়ার্ম-হোল খুবই আন-স্টেবল , তবে বিজ্ঞানীরা আশাবাদী যদি এমন কোন কণা পাওয়া যায় যেটা এই আন-স্টেবলকে স্টেবল করতে সক্ষম তাহলে সত্যি সত্যিই হয়ত একদিন ওয়ার্ম-হোল কাজে লাগিয়ে এক ইউনিভার্স থেকে আরেক ইউনিভার্সে যাওয়া যাবে।
টাইম ট্রাভেলের বেশ কিছু প্যারাডক্স আছে যেমন তার মধ্যে গ্র্যান্ড-ফাদার প্যারাডক্স অন্যতম। এখানে কিছু প্যারাডক্স নিয়ে আলোচনা করা যাক।
১। গ্র্যান্ড-ফাদার প্যারাডক্স
গ্র্যান্ড-ফাদার প্যারাডক্স অনেক কমন একটা ব্যাপার। এটা অনেকেই জানেন হয়ত, তারপরও এটা সম্পর্কে বলা যাক। ধরুন আপনি টাইম ট্রাভেল করে অতীতে এমন এক সময়ে চলে গেলেন যেখানে আপনার বাবার জন্ম হওয়াতো দুরের কথা আপনার দাদারই তখন বিয়ে হয় নাই। সেখানে গিয়ে যদি আপনার হবু দাদা/দাদিকে মেরে ফেলেন তাহলে আপনার এই ভুবনে তশরিফ আনাতো দুরের কথা বাবারই জন্ম হবে না।
তবে এখানে অনেকে একটি ব্যাখ্যা দাড় করানো যায় , যেই মুহুত্যে আপনি আপনার দাদাকে হত্যা করলেন সেই মুহুত্যে আরেকটি প্যারালাল ইউনিভার্স তৈরি হবে যেখানে সব ঠিকই থাকবে শুধু আপনি থাকবেন না।প্যারালাল ইউনিভার্স সহজ ভাবে বুঝার জন্য চিন্তার করুন রেডিও এর কথা। একটি রেডিওতে আমরা বিভিন্ন চ্যানেল দেখি বিভিন্ন ফিকুয়েন্সিতে। প্যারালাল ইউনিভার্সের ব্যাপারটাও এরকম, একই জায়গায় আরেকটা ইউনিভার্স কিন্তু তাদের ফিকুয়েন্সি আলাদা তাই একটা আরেকটার সাথে কোন সংঘর্ষ হবে না।
২। আমাদের এ ইউনিভার্সে যে কোন একটা সময়ে যত এনার্জি,অণু, পরমাণু, ভর আছে তার কোন ধ্বংস নেই বরং তার শুধু রূপ পরিবর্তন ঘটে। ধরুন আপনি বর্তমান সময় থেকে অন্য একটা সময়ে চলে গেলেন যার মানে দাঁড়াচ্ছে বর্তমান সময়ের যেই মোট এনার্জি/ভর ছিল তা কমে গেল এবং যেই সময়ে পৌঁছলেন সেখান মোট ভর/এনার্জি বাড়ল। পদার্থ বিজ্ঞান সূত্র অনুসারে সেটা হতে পারে না কারন আপনি কোন একটা সময়ে ইউনিভার্সের মোট ভর কমাতে বা বাড়াতে পারবেন না।
ব্যাপারটা যাই দাঁড়াক, এই প্যারাডক্স/ম্যারাডক্স কিন্তু বিজ্ঞানীদের দমিয়ে রাখতে পারছে না। তারা তাদের মত গবেষণা করে যাচ্ছে। তাহলে শুভ কাজে আর দেরি কেন, ওয়ার্ম-হোল কাজে লাগিয়ে আপনিও বানিয়ে ফেলুন টাইম মেশিন, ও আচ্ছা ওয়ার্ম-হোল বানানোর আগে আপনাকে ব্ল্যাক-হোল বানাতে হবে। ব্ল্যাক-হোল বানানর তরিকা সম্পর্কে আমি এই সিরিজের আগের পর্বে বিস্তারিত ব্যাখ্যা করেছি।
সর্বশেষ এডিট : ১৯ শে মার্চ, ২০১৮ সন্ধ্যা ৭:৫৩