ইহ-জিন্দেগিতে একবার হলেও আমেরিকা যাবার স্বপ্ন ছিল ! তবে সেটা নিজের দিনার খরচ করে নয় ! এতদিন চাতক পাখির মত একটা সুযোগের অপেক্ষায় ছিলাম ! অবশেষে মওকা পেলাম, আমার একটা পেপার কনফারেন্স -এ একসেপ্ট হল ! এর আগেরবার জার্মানিতে কনফারেন্সে গিয়েছিলাম একা, বৌ ছেলেকে নিয়ে যেতে পারি নাই কারণ আমার ছেলের পাসপোর্ট তখনও হয় নাই ! এবার যেহেতু ছেলের পাসপোর্ট আছে তাই ভাবলাম পরিবারসহ ঘুরে আসি, কনফারেন্স এটেন করলাম সাথে পরিবার নিয়েও ফ্রি-তে উইন্টার ভেকেশনটাও কাটানো হল , তাছাড়া সাধারণত কনফারেন্স -এ গেলে নিজের পেজেন্টেশন শেষে চম্পট মারাটা আমার পুরানা দিনের খাসলত !
বছর খানেক আগে বৌ ছেলে নিয়ে নিজের পয়সা খরচ করে সুইডেনের রাজধানী স্টকহোম গিয়েছিলাম, নিজের টাকা খরচ করতে কেন জানি বুকের ভিতর কেমন জানি চিন-চিনাইয়া ব্যথা করে তাই স্টকহোমে সস্তা হোটেল নিয়েছিলাম! কথায় আছে সস্তার তিন অবস্থা , কথাটার শানে- নজুল হারে হারে টের পেয়েছিলাম তখন! সেটাকে হোটেল বললে সত্যিকারের হোটেলও মাইন্ড করবে ! খুবই ছোট কামরা, তার উপর ডাবল বেডের জায়গায় দেখি দুইটা দোতলা সিঙ্গেল বেড, একটার উপর আরেকটা ! অথচ হোটেল বুকিং এর সময় ছবিতে দেখেছিলাম সুন্দর ডাবল বেডের বিছানা! বিছানা দেখেই আমার চান্দি গরম হয়ে গিয়েছিল ! কিছু বলতেও পারি না আবার কইতেও পারিনা! বৌ এর কাছে আমার পেস্টিজ পানচার হয়ে গিয়েছিল !
এবারের ট্যুর এর খরচাপাতি সব যেহেতু ল্যাব বহন করবে তাই এবার হোটেল খুঁজার সময় দাতা হাতেম তাই বনে গেলাম! কারণ এবারের সংগ্রাম বৌ এর কাছে নিজের হারানো ইমেজ ফিরে পাবার সংগ্রাম , এবারের সংগ্রাম প্রাণ খুলে খরচ করার সংগ্রাম ! সানফ্রানসিসকো এয়ারপোর্টের কাছাকাছি সমুদ্রের তীরে মনোরম পরিবেশে বেশি দিনার খরচ করে একটা হোটেল নিলাম ! হোটেল থেকে আমার কনফারেন্স ভেনু সমুদ্রের পার দিয়ে হেটে যেতে ১৫/20 মিনিট লাগে !
২৭ জানুয়ারি ১৮, যাত্রা শুরুর দিন :
ইন্টারনেটে সার্চ দিয়ে মোটামুটি গুগলে সব কিছু বের করে ফেললাম। আমি কোথাও যাবার আগে কোন কোন জায়গায় যাব, আশেপাশের হালাল হোটেল , টুরিস্ট স্পট সমস্ত কিছু বের করে ফেলি সাথে গুগল ম্যাপ প্রিন্ট করে নিয়ে যাই যাতে কোন সমস্যা হয় না। এবারো তার ব্যতিক্রম হয়নি। সকালে ফ্লাইট তাই ভোর রাতে রওনা দিতে হবে ! আমি ইউরোপে থাকি, সাধারণত কোন কারণে এয়ারপোর্টে গেলে বাস এবং ট্রেনে করে যাই , ট্যাক্সিতে করে ভুলেও যাই না কারণ এখানে ট্যাক্সিতে খরচ অনেক বেশি হয় ! নিজের দিনার খরচ করতে বুকের ভিতর আমার সবসময়ই চিন-চিনাইয়া ব্যথা করে ! তবে এবার যেহেতু ল্যাবের টাকায় যাচ্ছি তাই বৌ কিভাবে যাব জিজ্ঞেস করতেই হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে জানিয়ে দিলাম বাস-মাসে যাবার পাত্র আমি নই! বাসা থেকে রওনা দেবার আগে ট্যাক্সির জন্য ফোন দিলাম , তেলেসমাতি কারবার কিছুক্ষণের মাঝেই ট্যাক্সি এসে হাজির হল !! বৌ বাচ্চা নিয়ে রওনা দিলাম! আমার ট্রানজিট ছিল জার্মানিতে , অনেক লম্বা ট্রানজিট ছিল, প্রায় ছয় ঘণ্টা ঝিম মেরে বসে ছিলাম জার্মান এয়ারপোর্টে I বিকেল ৩/৪টা নাগাদ আমেরিকার সানফ্রানসিসকো পৌঁছলাম ! এয়ারপোর্ট থেকে সোজা ট্যাক্সিতে করে হোটেলে পৌঁছলাম।
ছবিটা আমাদের হোটেল এর সামনে থেকে তোলা। হোটেলের নাম রেড রুফ।
এই রুমেই ছিলাম প্রায় ৭ দিন।
এসেই দেখি খুদায় পেট চো-চো করছে। হোটেলে চেক-ইন করে গোসল করে নিচে খেতে নামলাম । হোটেল নিচেই সুন্দর খাবারের রেস্তরাঁ আছে । নিচে গিয়ে আরামছে ভোজন কর্ম সম্পাদন করলাম। এরই মদ্যে প্রায় সন্ধ্যা হয়ে গেল তাই সেদিন আর বাহিরে বের হতে মন চাইল না , আমার এক রাশিয়ান ল্যাব-মেট বলে দিছে রাতে ৬টার পর বের হইয়ো না, ইউ এস ততটা নিরাপদ নয় ইউরোপের মত!
২৮ জানুয়ারি ১৮, ২য় দিন :
আমাদের কনফারেন্স এয়ারপোর্টের পাশের হোটেলেই কিন্তু হোটেল নিয়েছি কনফারেন্স ভেনু থেকে একটু দূরে, সমুদ্রের তীর ঘেঁষে ১৫/২০ মিনিট লাগে হোটেল থেকে কনফারেন্স ভেনুতে আসতে ।
এই সমুদ্রের পার দিয়ে হেটে হোটেল থেকে কনফারেন্স ভেনুতে যেতাম । সকাল সকাল বিবি-বাচ্চা নিয়ে কনফারেন্স ভেনুতে গিয়ে রেজিস্টেশন সম্পূর্ণ করলাম। এই দিন আর চম্পট দেবার সুযোগ হয়নি কারণ কনফারেন্স থেকে দুইটা শর্ট কোর্স নিয়েছিলাম যা ২৮ তারিখে একটা আরেকটা ২৯ তারিখে হয়েছিল।
২৯ জানুয়ারি ১৮, ৩য় দিন :
সকাল সকাল কনফারেন্স ভেনুতে গেলাম। কারণ এই দিন সকালে আমার পেজেন্টেজন আছে। বিশাল একটা রুম তার উপর কয়েকশত মানুষ রুমটাতে ! পেজেন্টেশন দিতে এমনিতেই শুরুতে একটু নার্ভাস লাগে তার উপর এত মানুষ দেখে কিছুটা ঘাবড়ে গিয়েছিলাম, যাইহোক শুরুতে নার্ভাস লাগলেও পরে ঠিক হয়ে গিয়েছিল।
উপরের ছবিতে আমাদের কনফারেন্স ভেনু দেখা যাচ্ছে ।
এই রুমটাতে আমার পেজেন্টেশন হয়েছিল।
৩০ জানুয়ারি ১৮, ৪র্থ দিন :
নিজের পেজেন্টেশোন শেষ তাই এবার চম্পট দিলাম পূর্ব প্লান মত। আমাদের প্লান ছিল পুরো ‘San Francisco’ শহর , টুরিস্ট স্পটগুলো যেমন ‘Golden gate bridge’ , ‘Aquarium of the bay’ এবং ‘madame tussauds museum’ ঘুরে দেখা । তাই প্রথমে ‘San Francisco’ ডাউন টাউনে যাবার করলাম কারণ ডাউন টাউন থেকে ‘Hop on & off’ বাস ছাড়ে। ‘San Francisco’ ডাউন টাউনে জন্য প্রথমে এয়ারপোর্টে যেতে হবে কারণ সেখান থেকেই ‘BURT’ ছাড়ে ডাউন টাউনে উদ্দেশ্যে । সকাল সকাল হোটেলের সাটেলে চড়ে চলে গেলাম এয়ারপোর্টে।
এই ‘BURT’ করেই চলে গেলাম ডাউন টাউন। খুদায় দেখি পেটের অবস্থা খারাপ তাই ‘Hop on & off’ বাসে চড়ার আগে ইন্ডিয়ান খাবারের দোকান খুঁজে বের করে করলাম।
ইন্ডিয়ান রেস্টুরেন্ট থেকে মটুরশুটির পোলাও, সাধা ভাত, মুরগির মাংস, ডাল দানার-দান খানা খাদ্য পেটের ভিতর চালান করলাম। ছবিতে কিছু দিলাম ব্লগের নওজোয়ানদের জন্য !
‘Hop on & off’ বাস ট্যুর :
কেউ যদি ‘San Francisco’ যায় তার অবশ্যই ‘Hop on & off’ বাসে চড়া আমি মনে করি ফরজ কর্ম বাকি সব সুন্নত কারণ এই বাসে চরলে পুরো শহর ঘুরে দেখা যায়। আমরা দুজনের জন্য দুটি টিকিট কিনলাম ১০৬ ডলার দিয়ে, বাচ্চা-কাচ্চা ফ্রি তাই আমার ছেলের আর টিকিট লাগে নাই। এই বাসে সুবিধা হল এটা আকর্ষণীয় স্থান গুলোর সামনে দিয়ে যায় এবং চাইলে নেমে দেখা যায়। প্রতি ২০ মিনিট পরপর বাস আসে তাই কেউ চাইলে নামতে পারে এবং পরবর্তী বাসে আগের টিকিট দেখিয়ে উঠতে পারে। তাছাড়া ‘Hop on & off’ টুরিস্ট গাইড থাকে একজন যে সারাক্ষণই বিভিন্ন জায়গা সম্পর্কে বকবক করতে থাকে !।
ছবিগুলো ‘Hop on & off’ বাস থেকে তোলা।
ছবিতে দেখা যাচ্ছে শহরের পিরামিড বিল্ডিং।
‘Golden gate bridge’
‘San Francisco’ শহরের মূল আকর্ষণীয় স্থানের ভিতর অন্যতম স্থান হল এই গোল্ডেন গেট ব্রিজ। এই ব্রিজটা সামনা সামনি দেখতে চমৎকার লাগে। প্রচুর দর্শনার্থীদের আগমন ঘটে এই ব্রিজের সামনে।
ব্লগের নওজোয়ানদের জন্য ‘Golden gate bridge’ এর কিছু ছবি দিলাম। আমার উদ্দেশ্য বিরহি কবিতা ছেড়ে মিষ্টি মধুর প্রেমের কবিতা লেখুক এবং বিয়ে-সাদি করে এখানে ঘুরতে যাক !
‘Aquarium of the bay’
‘San Francisco’ শহরের আরেকটি মূল আকর্ষণ হল এই একুরিয়াম !।আমরা অবশ্য ভিতরে ঢুকি নাই , এর সামনের অসাধারণ মনোরম দৃশ্য উপভোগ করেছি। এর চারপাশটা দেখতে দারুণ, সমুদ্রের কোল ঘেঁষে রয়েছে এই একুরিয়াম। এখানেও প্রচুর টুরিস্ট আসে। যথারীতি ‘Hop on & off’ বাস থেকে নেমে গেলাম এই সৌন্দর্য উপভোগ করার জন্য।
ছবিতে দেখা যাচ্ছে এর প্রাকৃতিক দৃশ্য।
‘madame tussauds museum’
বিভিন্ন সফল ব্যাক্তি এবং সেলিব্রেটিদের মূর্তি দিয়ে সাজানো এই মিউজিয়াম। ইচ্ছে মত ছবি তোলা যায় এই মূর্তিগুলোর সাথে। টুরিস্টদের কাছে এই মিউজিয়াম খুবই জনপ্রিয়! এই মিউজিয়ামে ঢুকতে ২০ ডোলার লাগে জন প্রতি।
মিউজিয়ামের ভিতরের কিছু ছবি দিলাম।
সারাদিন ঘুরে ঘুরি করে চলে এলাম হোটেলে।
৩১ জানুয়ারি , ১ এবং ২ ফেব্রুয়ারি ১৮, ৫ম,৬ষ্ট, ৭ম দিন :
এই তিনদিন আর বেশী দূর যাই নি। আশেপাশের এলাকাতেই ঘুরাঘুরি করেছি। চম্পট অনেক দিলাম এবার কনফারেন্সে কিছুটা সময় দিলাম এবং আশেপাশের লেকের ছবি।
গতকাল দীর্ঘ ভ্রমণ ছেড়ে চলে এলাম পূর্বের ঠিকানায়।
খোদা হাফেজ!
আজ এ পর্যন্তই ! জগতের সকল প্রাণী সুখী হোক ! (রোহিঙ্গাদের খবর কি ?)