বর্তমানে এই গ্রহের শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞানী ষ্টিফেন হকিং এর সর্বশেষ পাঠকপ্রিয় পুস্তক ''দ্যা গ্র্যান্ড ডিজাইন'' । আমরা কেন এখানে ? এই বিশ্ব জগত কেন নিদিষ্ট কিছু সূত্র মেনে চলছে। এই সূত্রগুলোই শুধু কেন ? অন্য সূত্র নয় কেন? সূত্রগুলোর মানতো অন্যরকম ও হতে পারত। Why there is something instead nothing ? এরকম অনেকগুলো দার্শনিক প্রশ্ন এবং তার উত্তর নিয়ে এই পুস্তকটি রচনা করেছেন। তার আগের পাঠকপ্রিয় ''কালের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস'' পুস্তকটিতে তিনি স্রষ্টার অস্তিত্বের কথা পরোক্ষভাবে স্বীকার করলেও এবার তিনি তার পূর্বের অবস্থান থেকে একশত আশি ডিগ্রি এঙ্গেলে সরে এসেছেন। তিনি এতদিন ধরে যেই প্রশ্নগুলোর উত্তর খুঁজছিলেন এবার তার উত্তর পেয়েছেন বলে মনে হয়। আমি এই সিরিজটাতে যেহেতু মহাজগৎ এবং সৃষ্টির রহস্য নিয়ে লেখছি তাই এই পর্বে মূলত ষ্টিফেন হকিং এর ''দ্যা গ্র্যান্ড ডিজাইন'' পুস্তকটির বিষয়বস্তু নিয়ে আলোচনা করব।
ষ্টিফেন হকিং ''দ্যা গ্র্যান্ড ডিজাইন'' এর প্রথম চ্যাপ্টারে প্রাচীন গ্রিক সময়কাল থেকে শুরু করে বর্তমান সময় পর্যন্ত বিজ্ঞানের অগ্রগতি বিশেষ করে মহাকাশ-বিদ্যা এবং আধুনিক কসমোলজি নিয়ে বিশদ আলোচনা রাখেন। তার মধ্যে মানব ইতিহাস সংক্ষিপ্ত আকারে উল্লেখ্য করেন। মানব স্পেসিস হোমো সেপিন (Homo sapiens) নাযিল হয় খৃষ্টপূর্ব ২ লক্ষ্য বছর আগে আফ্রিকাতে (sub-Saharan Africa )। মানুষ যোগাযোগ বা মনের ভাব প্রকাশের জন্য হস্ত লেখা আবিষ্কার করেন খৃষ্টপূর্ব প্রায় ৭০০০ বছর আছে। তবে আধুনিক সিভিলাইজেশোন শুরু হয় মাত্র ৫০০ খৃষ্টপূর্বে আগে।এই সময়কাল পর্যন্ত মানব জাতি মহাজগৎ এবং তার রহস্য নিয়ে খুব একটা মাথা ঘামাত না, পরবর্তীতে দার্শনিক থেলস সর্বপ্রথম উপলব্ধি করেন যে আমাদের এই বিশ্ব জগতকে বিজ্ঞান দিয়ে ব্যাখ্যা করা সম্ভব।ধরে নেয়া যায় এর পর থেকেই মূলত বিভিন্ন দার্শনিক এবং বিজ্ঞানীরা সৃষ্টির রহস্য নিয়ে গবেষণা পরিচালনা করা শুরু করেন।
যাইহোক এবার মূল বিষয়ে আশা যাক। বিজ্ঞানীরা এতদিন আশা করেছিলেন যে এমন একটা সূত্র আবিষ্কার করা সম্ভব যেটা দিয়ে এই মহাজগতকে ব্যাখ্যা করা যাবে। এই সূত্রটিকে বিজ্ঞানীরা বলেন ''থিওরি অব এভরিথিং'' তবে ষ্টিফেন হকিং তার পুস্তকের ৫ম চ্যাপ্টারে বলেন এরকম কোন সূত্র আবিষ্কার করা সম্ভবনা নেই কারণ কোন নিদিষ্ট একটা সূত্র দিয়ে আমরা আমাদের এই মহাজগৎকে ব্যাখ্যা করতে পারব না।বরং পদার্থ বিজ্ঞানের প্রত্যেকটি সূত্র যেমন গ্রাভিটি, রিলেটিভিটি এবং ইলেক্ট্রো-মেগনিটিজম ইত্যাদি এই প্রত্যেকটা সূত্র দিয়ে আমরা আমাদের এই মহাজগতের বিভিন্ন প্রোপারটিগুলোকে আলাদাভাবে ব্যাখ্যা করতে পারব।যার মানে দাঁড়াচ্ছে এরকম একটা কোন সূত্র পাওয়ার সম্ভাবনা নেই যেটা দিয়ে সব কিছুকেই ব্যাখ্যা করা যাবে।
উদাহারনসরূপ বলা যায় গ্রাভিটির কথা। আমাদের ছায়াপথ, নক্ষত্র এবং সর্বোপরি এই বসবাসযোগ্য গ্রহের পিছনে গ্রাভিটি অসাধারণ ভূমিকা পালন করেছে। গ্রাভিটি দিয়ে আমরা নিদিষ্ট কিছু ব্যাখ্যা করতে পারব সব কিছু নয়। বিজ্ঞানী হকিং তার ''কালের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস'' পুস্তকে এই বিষয়ে দেখিয়েছেন যে গ্রাভিটি কিভাবে আমাদের ছায়াপথ, অগণিত নক্ষত্র এবং গ্রহ তৈরিতে গুরুত্বপূর্ন ভূমিকা পালন করেছে। আমি এই ব্যাপারগুলো বিশদ আলোচনা করেছি আগের পর্বে (মহাবিস্ফোরণের আদি-কথা এবং যেভাবে সৃষ্টি হল আমাদের এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ড)। এই রকমভাবে রিলেটিভিটি এবং ইলেক্ট্রো-মেগনিটিজম এই সূত্রগুলো দিয়েও একেকটা বিষয়কে ব্যাখ্যা করা যায়।
যাইহোক এখন প্রশ্ন হল আমাদের এই মহাজগৎ-এ এই সূত্রগুলো কিভাবে আসলো । এই ব্যাপার গুলোর উওর পাওয়া গেলে বিশ্ব সৃষ্টির রহস্য সম্পর্কে ধারনা পাওয়া যাবে। ষ্টিফেন হকিং বলেছেন এই ব্যাপারগুলো ব্যাখ্যা করা যায় ''এম থিওরি'' দিয়ে। তিনি তার পুস্তকের চ্যাপ্টার সিক্সে বলেছেন এম থিওরি অনুসারে কোন কিছু নাই হতে ননস্টপ স্বতস্ফূর্তভাবে অসংখ্য মহাজগৎ তৈরি হওয়া সম্ভব যা কম করে হলেও ১০৫০০ , যার মানে দাঁড়াচ্ছে ১০ কে ৫০০ বার গুন করলে যা হয় তার সমান সংখ্যক মহাজগৎ এবং প্রত্যেকের আলাদা আলাদা নিদিষ্ট কিছু সূত্র নাযিল হওয়া সম্ভব। একটু বিস্তারিত বলতে গেলে এই মহাজগৎ এর বাইরেও বিলিয়ন বিলিয়ন মহাজগৎ, তার মাঝে বিলিয়ন বিলিয়ন ছায়াপথ, নক্ষত্র এবং গ্রহ থাকতে পারে ।
তবে এখানে একটা কথা বলা প্রয়োজন আমাদের গ্রহের অবস্থান, পদার্থের সূত্রগুলোর মান এমন সূক্ষ্মভাবে নির্ধারিত হয়েছে যে এর একটু হেরফের হলে জীবনই সৃষ্টি হত না। এমনকি আমাদের এই নক্ষত্রের সংখ্যাও যদি একাধিক হত তাহলেও আমাদের অস্তিত্ব এই ধরায় থাকত না। এই বিষয়গুলো সম্পর্কে আরেক বিখ্যাত বিজ্ঞানী নিউটন বলেছেন স্রষ্টা ছাড়া এই সৃষ্টি ব্যাখ্যা করা সম্ভব নহে। তবে ষ্টিফেন হকিং এই বিষয়ে বলেন এম থিওরি অনুসারে যেহেতু বিলিয়ন বিলিয়ন মহাজগত তৈরি হওয়া সম্ভব তাই কাকতালীয় ভাবে আমরা বসবাস যোগ্য এই ধরা পেয়েছি। এখানে স্রষ্টার কোন ভূমিকা নেই বরং পদার্থ বিজ্ঞানের এই সূত্রগুলোই এই ধরা সৃষ্টি করেছে কাকতালিয়ভাবে ।
এর পরের আলোচনাগুলো অবিশ্বাসীদের জন্য নহে। অবিশ্বাসী কেহ থাকলে স্লিপিং মুডে চলে যান।
উপরে ষ্টিফেন হকিং এর ''দ্যা গ্র্যান্ড ডিজাইন'' পুস্তক সম্পর্কে আলোচনা করলাম। ষ্টিফেন হকিং মহাজগৎ তৈরির ম্যাথম্যাটিকাল একটা ব্যাখ্যা দাড় করানর চেষ্টা করেছেন এক্ষেত্রে তাকে সাধুবাদ দিতেই হয়। তবে তার পুস্তকটা পড়ে তার আগের লেখা ''কালের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস'' এর থেকে খুব বেশী একটা আলাদা মনে হয়নি বরং নতুন হিসেবে তথাকথিত এম থিওরি নিয়ে তিনি কিছুটা আলোকপাত করেছেন।এছাড়া নো-বাউন্ডারি থিওরিটা তিনি এই পুস্তকেও ব্যাখ্যা করেছেন যদিও আমি পূর্বের পর্বে এটা নিয়ে লিখেছিলাম তাই এবার আর সেই একই ত্যানা পেঁচালাম না। উপরের আলোচনা থেকে দুইটা পয়েন্ট নিয়ে নিচে আমার মতামত তুলে ধরেছি ।
১। এম থিওরি মতে বিলিয়ন বিলিয়ন মহাজগৎ তৈরি হয়েছে। যেহেতু বিলিয়ন বিলিয়ন মহাজগৎ তাই কাকতালিয়ভাবে আমরা আমাদের এই মানুষ বসবাসের উপযোগী গ্রহ পেয়েছি ।
২। স্রষ্টা নয় বরং ''ল অব নেচারই'' এই মহা জগত তৈরিতে ভূমিকা রেখেছে।
প্রথম পয়েন্টে হকিং সাহেব উল্লেখ্য করেছেন কাকতালীয়-ভাবে আমরা আমাদের এই গ্রহ পেয়েছি। গ্রহের অবস্থান, গাণিতিক সূত্রগুলোর মান এবং তার থেকে প্রাণের সৃষ্টি এইসব কিছুই কাকতালীয় ভাবে হয়েছে।আমি আমার এই সিরিজের প্রথম পর্বে শুরু করেছিলাম মানুষের একটি উদাহারন দিয়ে সেটা আবারো এখানে সংক্ষেপে উল্লেখ্য করছি ব্যাখ্যার সুবিধার্থে । তার কাকতালীয় তও্ব মেনে নিলে এও মেনে নিতে হবে মানুষের মেরুদণ্ডের ঠিক দুই পাশে দুটি কিডনি যা কিনা মাতৃগর্ভ থেকে শুরু করে মৃত্যুর মুহূর্ত পর্যন্ত বিরামহীনভাবে কাজ করতে থাকে, কিডনির সাহায্যে নাইট্রোজেনযুক্ত বর্জ্য পদার্থ বা মূত্র নিষ্কাশিত হয় , ফুসফুস নামের যন্ত্র দিয়ে কার্বন ডাই-অক্সাইড, ত্বকের সাহায্যে ঘর্ম জাতীয় পদার্থ নিষ্কাশিত হয়, মানব চোখের মত জটিল ডিজাইন যা দিয়ে আমরা দেখি এই ব্যাপারগুলো সবকিছুই কাকতালিয়ভাবে হয়েছে ।কথায় আছে ঝড়ে বক মরে ফকিরের কেরামতি বাড়ে। কাকতালিয়ভাবে একটা ঘটনা ঘটতে হতে পারে কিন্তু এরকম অগণিত ম্যাথম্যাটিক্যালই সূক্ষ্ম জিনিষ এক সাথে ঘটতে পারে না।
দ্বিতীয় পয়েন্টে আমি বলব হকিং সাহেব ''ল অব নেচারের'' অস্তিত্বের উপর ঈমান এনেছেন কিন্তু এর মানগুলো কাকতালিয়ভাবে নাযিল হয়েছেন বলে যেই মত প্রকাশ করেছেন তা আমার কাছে অযৌক্তিক মনে হয়েছে।
পরিশেষে বলব ষ্টিফেন হকিং এর বইটা মানুষের চিন্তার জগতে দারুণভাবে আলোড়ন তুলতে সক্ষম হবে। অনেক গুলো দার্শনিক ভাবনাগুলো তিনি তার এই বইতে উল্লেখ্য করেছেন যেগুলো হয়ত যারা দর্শন চর্চা করেন তাদের ভাবনার বিষয় ছিল কিন্তু হকিং তার পুস্তকের শুরুতে বলেছেন বর্তমানে দর্শন অন্ধ মোট কথা মৃত। বিজ্ঞান প্রযুক্তির সাথে তাল মিলিয়ে দর্শন এগুতে পারেনি। সেই হিসেবে হকিং সাহেব দর্শনের বিষয়গুলো নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছেন বলে প্রশংসা পেতেই পারেন। তবে তার পুস্তকে তিনি সৃষ্টির রহস্য উন্মোচন করেছেন বলে যেই দাবি তিনি করেছেন সেটা আমার কাছে কনভিন্সিং সহজ করে বললে যৌক্তিক মনে হয়নি। শেষে বলব আমাদের এই মহাজগত স্বয়ং আল্লাহতালাই সৃষ্টি করেছেন তাকে ছাড়া সৃষ্টির ব্যাখ্যা করা সম্ভব নহে।
আগের পর্ব
মহাজগৎ এবং সৃষ্টি ( ১ম পর্ব ): স্রষ্টাকে কে সৃষ্টি করল, নাস্তিকেরাই কি অন্ধ বিশ্বাসী নয় !
মহাজগৎ এবং সৃষ্টি ( ২য় পর্ব) : ধর্ম এবং উন্নয়ন কি সাংঘর্ষিক বিষয় !
মহাজগৎ এবং সৃষ্টি ( ৩য় পর্ব ) : মানব মস্তিষ্কের আকার ছোট হয়ে আসছে ! বিজ্ঞান এবং প্রযুক্তি আমাদের পিছনে নিয়ে যাচ্ছে নাতো ?!
মহাজগৎ এবং সৃষ্টি ( ৪র্থ পর্ব ) : বিগ ব্যাং কি আমাদের মহাবিশ্ব সৃষ্টির ব্যাখ্যা দিতে পারে ? ষ্টিফেন হকিং এর সাথে আমার দ্বিমত
মহাজগৎ এবং সৃষ্টি ( ৫ম পর্ব ) : বিবর্তন তও্বের পোষ্টমোর্টেম রিপোর্ট
মহাজগৎ এবং সৃষ্টি ( ৬ষ্ট পর্ব ) : আইনস্টাইনের আপেক্ষিক তও্ব এবং আমাদের তকদীর
মহাজগৎ এবং সৃষ্টি ( ৭ম পর্ব) : মহাবিস্ফোরণের আদি-কথা এবং যেভাবে সৃষ্টি হল আমাদের এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ড
সর্বশেষ এডিট : ০৬ ই আগস্ট, ২০১৮ বিকাল ৩:২২