ইঞ্জিন নৌকার বিরক্তিকর অথচ ছন্দময় ভটভট আওয়াজ ছাড়া পুরো এলাকা কবরের মতই নীরব, নিস্তব্ধ। হাতের বামে সুপারি বাগান ডানে চা বাগান। চারপাশটা শুধু সবুজ আর সবুজ। মধ্যে মধ্যে মাটিতে পোতা লাঠির আগায় বাঁধা সাদা পতাকা হাল্কা বাতাসে উড়ছে। এটা নাকি সীমানা নির্ধারক। ওপারে ভারত, এপারে বাংলাদেশ। আর পানি? অদ্ভুত সুন্দর। এগজ্যাক্ট বলতে গেলে বলতে হবে পানির রঙ টার্কিশ ব্লু। তবে তীর থেকে বেশ খানিকটা দূরে গিয়ে তবে দেখা মেলে পানির এই রঙয়ের। হ্যা। ঠিক ধরেছেন। কথা বলছি সিলেটের বিখ্যাত লালাখাল নিয়ে। জৈন্তাপুর বাজার থেকে ডান দিকে মোড় নিয়ে গ্রামের ভেতরের রাস্তা ধরে একদম শেষ প্রান্তে উপস্থিত হলে পেয়ে যাবেন লালাখাল।
নিতুল আপুর প্ল্যানে মাত্র এক সপ্তাহের নোটিশেই লালাখাল ট্যুরের জন্য তৈরি হলাম আমরা মোট ৯ জন। এরমধ্যে বাবা মা ছাড়া এটাই অন্তরার প্রথম লং ট্যুর। স্বভাবতই মেয়েটা অনেক উৎসাহিত ও উত্তেজিত। মারশিয়া আপুর প্ল্যানে থাকার হোটেল ও ঘোরাঘুরির জন্য গাড়ির ব্যবস্থা হয়ে গেল। সবকিছু ঠিকঠাক করে রওনা হলাম ২৮ এপ্রিল রাত সোয়া বারোটার বাসে। কিন্তু হেভি ট্র্যাফিকের জন্য ঢাকা থেকে বের হতে হতে বেজে গেল রাত পৌনে ২ টা। ঢাকা ফকিরাপুল থেকে রওনা হয়ে সিলেট বাস টার্মিনালে আমরা পৌঁছলাম সকাল ৭ টার দিকে।
রিচমন্ড হোটেল এন্ড এপার্টমেন্টস চমৎকার একটা জায়গা। ফ্রেশ হয়ে চলে গেলাম বিখ্যাত “পাঁচভাই হোটেলে”। অদ্ভুত ঝাক্কাস ভুনা খিচুড়ি দিয়ে সকালের নাস্তাটা হল আনন্দে কাহিল হয়ে পড়ার মত একটা কিছু। তারপর হযরত শাহজালালের মাজার জিয়ারত করে এয়ারপোর্ট রোডের দিকে গাড়িটা নিয়ে একটা চক্কর মারতে গিয়ে আমাদের রেজার স্থানীয় বন্ধুবর সাফওয়ানের সাথে পরিচিত হলাম। একসাথে চা সাথে টা খেতে খেতে আড্ডা চলল কিছুক্ষণ। তারপর আবারো হোটেলে ফিরে এবার রওনা হলাম সেই বহু আকাঙ্ক্ষিত লালাখালের উদ্দেশ্যে।
সিলেট শাহজালালের মাজার এলাকা থেকে লালাখাল প্রায় দেড় ঘণ্টার পথ। রাস্তা প্রায় সবটুকুই ভালো। তবে একদম শেষের দিকে লালাখালে যাওয়ার পথে গ্রামের ভেতরের রাস্তাটা বেশ সরু। ৯ জন মিলে গাড়িতে হইহল্লা করতে করতে পৌঁছে গেলাম আমরা। এবার নৌকা ভাড়া করার পালা। নৌকার রেট নাকি ফিক্সড। ৬০০ থেকে ৭০০ টাকা প্রতি ঘণ্টা। চাইলে লালাখাল হয়ে জাফলং, জিরো পয়েন্ট পর্যন্ত যাওয়া যায়। তো নিজেরা কথা বলে ঘণ্টা প্রতি ৭০০ টাকা ফিক্স করে একটা নৌকা ভাড়া করলাম। ইঞ্জিনের কর্কশ আওয়াজে শুরু হল আমাদের জার্নি বাই লালাখাল।
পানির প্রতি প্রচণ্ড ভীতির কারণে বরাবরের মত আমি এই টার্কিশ ব্লু পানিতে নামবো না। ভেবেছিলাম এই দলে আমি একাই। পরে দেখি উহু, আরও একজন আছে। পানিতে বাকিদের দাপাদাপি দেখতে দেখতেই কেটে গেল প্রায় ২ ঘণ্টা। একদম নিঝুম এলাকা এই লালাখাল। ধারে কাছের মধ্যে মানুষ দেখা যায় বেশ কম। পাখির ডাক, মৃদু বাতাস, সবুজে ঘেরা চারপাশের টিলা-পাহাড় ইত্যাদি সব মিলিয়ে লালাখাল এক অন্যরকম অনুভূতির নাম। প্রকৃতির এই বিমুগ্ধতায় ২ ঘণ্টা পার করে দেয়ার পর মনে হল যাবার সময় হয়েছে।
ঘাট লাগোয়া একটা ছোট্ট হোটেল কাম চায়ের দোকানে সবাই মিলে বসলাম। লবণ ছাড়া বানানো ছোট্ট ছোট্ট পিয়াজু, শুকনা ছোলা মুড়ি, ড্যাম হয়ে যাওয়া চিপস, পানির বোতল ও কোল্ড ড্রিঙ্কস সহকারে বিকালের নাস্তাটা খারাপ হল না। এবার ফেরার পালা।
সেই ঘণ্টা দেড়েক পর হোটেলে ফিরে ফ্রেশ হয়ে এবারের গন্তব্য শাহপরান। জিয়ারত শেষে সবাই মিলে খাওয়াদাওয়ার উদ্দেশ্যে ঢুকলাম আরেক বিখ্যাত হোটেল “পানসী”তে। প্রচণ্ড ভিড়। বিভিন্ন টেবিলের পাশে কাস্টমাররা দাঁড়িয়ে রয়েছে। অনেকটা চর দখলের মত ব্যাপার। টেবিল খালি হওয়ার আগেই দখল। ইতিউতি তাকিয়ে টেবিল পাচ্ছি না। এমন সময় ডানা মুশকিল আসান করে দিল। একটা টেবিলে দেখলাম ৬-৭ টা ছেলে খাওয়া শেষ করে কোল্ড ড্রিঙ্কস খাচ্ছে। ডানা সোজা ছেলেগুলোর মাঝখানে দাঁড়িয়ে আমার দিকে তাকিয়ে বলা শুরু করল, ভাইয়া উনাদের তো খাওয়া শেষ, সো উনারা তো উঠেই যাবে। চিন্তা নেই। এই টেবিলটাই আমরা পাচ্ছি। ছেলেগুলো ঘুরে একবার করে ডানাকে দেখে কোল্ড ড্রিঙ্কসের বোতল নিয়েই নিতান্ত অনিচ্ছা সত্ত্বেও টেবিল ছেড়ে উঠে গেল। ব্যস। কাহিনী খালাস...
বিস্তর রকমের ভর্তাভাজি দিয়ে শুরু করা খাওয়ায় শেষে আরও আইটেম যুক্ত হল। অভিজ্ঞতা অস্থির। খাবারের মান ঝাক্কাস। আর দামের কথা ভাববেন না। রিজনেবল প্রাইস বলতে আমরা যা বুঝি, এখানেও তাই।
রাতের সিলেটে একটু ঘোরাঘুরি করে শেষপর্যন্ত ফিরে এলাম হোটেলে। ট্রেনের টিকেট আগেই কনফার্ম করা হয়ে গেছে। সকাল ৭ টায়। তাই আর কিছু করার নেই শুধু আড্ডা ছাড়া। আড্ডা চলল প্রায় পৌনে ৪ টা পর্যন্ত। তারপর সকালে কোনোরকম ঘুম থেকে উঠেই সোজা রেল স্টেশন।