somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

পোস্টটি যিনি লিখেছেন

ফেলুদার তোপসে
নিষ্পত্তি কি সব সময়ে জয়-পরাজয়ে? ময়দানি ধুলোয় তার বাইরেই যে পড়ে থাকে খেলার আসল-নকল গল্পগুলো৷ ময়দানের ঘাস-ধুলো যাঁর প্রিয়তম বন্ধু, তাঁর কলমে অভিজ্ঞতার দস্তাবেজ৷

বিধবা ঠাকুমা'কে মাছ খাইয়ে দিতাম

১০ ই মে, ২০১৬ রাত ১০:১৮
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


সেটা নভেম্বর-টভেম্বর হবে, কলকাতার গা-লাগা সেই শহরটায় জাঁকিয়ে শীত পড়েছে। লেপেরা বেরিয়ে পড়েছে তারও অনেক আগে। ভোর হয়েছে কি হয়নি, ঘুম শেষ হওয়ার তখনও অনেকটা বাকি, মা লেপে টান মেরে ডেকে তুললেন, ‘মনে নেই আজকে কে আসছে? তাড়াতাড়ি তাড়াতাড়ি, কখন থেকে ডেকে যাচ্ছি, ক্রুশ্চেভ আর বুলগানিন আসছেন, এক্ষুনি চলে আসবেন। আমার রান্না অর্ধেক রেডি।’ ভয়ংকর উত্তেজনায় ভরা মা’র গলা থেকে কথাগুলো বেরিয়ে আসছে ঢাকাইয়া বাঙাল ভাষায়।

ঠান্ডা জলে স্নান করে, হি-হি করে কাঁপতে কাঁপতে, প্যান্টু পরে, ভাইবোনেরা লাইন করে মা’র সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। চিরুনি হাতে চেয়ারে বসে মা একে একে আমাদের সবার পাতা কেটে চুল আঁচড়ে দিলেন।

বললাম, কেমন দেখতে ক্রুশ্চেভ? কেমন দেখতে বুলগানিন? আমাদের মতো ডাল-ভাত-মাছের ঝোল, এইগুলোই খায়?

— খাইব না ক্যান? তুইও মানুষ অরাও মানুষ। মানুষে সব খায়।

১৯৫৫ সাল। আমি ক্লাস ফোরে পড়ি, আর ভারতবর্ষ স্বাধীন হয়েছে মাত্র কয়েক বছর আগে। গরিবগুর্বো দেশ, তেমন কোনও বন্ধু নেই বান্ধব নেই, রাশিয়াকে পেয়ে ‘হিন্দি-রুশি ভাই ভাই’ করতে করতে দৌড়ে গিয়ে জাপটে ধরেছে।

ছোটবোনকে কোলে নিয়ে ছুটতে শুরু করলাম। আগে-পিছে বাকি ভাইবোনেরা। বাড়ির সামনেই বড় রাস্তা, গ্র্যান্ড ট্রাংক রোড। রাস্তাটা প্রায় ঢুকে গেছে বিশাল বড় একটা বটগাছের পেটের ভেতর। কেউ বলে দশ হাজার বছর পুরনো, কেউ বলে তিরিশ হাজার, কেউ বলে তিনশো-টিনশো তো হবেই। কেউ বলে, এই বটগাছের তলায়ই নাকি রামের সঙ্গে সীতার প্রথম দেখা। যে যা-ই বলুক, গাছের ভেতর দিয়ে আরও গাছ, তার পর আরও গাছ, আরও আরও গাছ, তার পর আরও আরও আরও গাছ— বিশাল এক বটগাছ। বিদেশ থেকে কেষ্টবিষ্টু যে-ই কলকাতায় আসত, সবাইকে নিয়ে যাওয়া হত সেই গাছের কাছে। এই ভাবেই কত জনের সঙ্গে যে আমাদের দেখা হয়েছে সেই ছোট্টবেলা থেকে, আর প্রত্যেক বারই মা ভয়ংকর উত্তেজিত হয়ে ঘুম থেকে ডেকে দিয়েছেন শেষ রাতেই, ভাবখানা এমন, যেন নেহরু থেকে আরম্ভ করে বাকি সবাই মা’র রান্না মাছের ঝোল খেয়ে, আমাদের বাড়িতে একটু জিরিয়ে নিয়ে বাকি পথটা যাবেন।

চার পাশের সারি দেওয়া জনস্রোত চিরে টাকমাথা নিকিতা ক্রুশ্চেভ যখন হাত নাড়তে নাড়তে এগিয়ে যাচ্ছেন, আমার ঠাকুমা তখন বারান্দার কোণে দাঁড়িয়ে, ঘোমটার তলায় ব্যাপক জোরে ফুঁ দিয়ে চলেছেন শাঁখে। তখন মানুষ কত বোকা ছিল, কিন্তু ভাল ছিল।

ঠাকুমা আমাদের সঙ্গেই থাকতেন। আঠারো বছর বয়সে বিধবা হন। কঠোর বৈধব্যের অদ্ভুত সে জীবন আমার তখনই হাস্যকর লাগত। বাড়িতে ছিল দুটো রান্নাঘর। একটা আমাদের রান্নাঘর, একটা ঠাকুমার। একটায় রান্না হত হিজবিজবিজবিজ, আর একটায় শুধুই বিজবিজবিজ, মানে আমিষ আর নিরামিষ। মা’র রান্নাঘর থেকে ভেসে আসা রান্নার গন্ধ শুঁকতে শুঁকতে ঠাকুমা মাঝে মাঝে ঘুমিয়ে পড়তেন। ঘুমের ভেতর দিয়ে চলে যেতেন তাঁর ষোলো বছরের কুঁড়ি ফোটার বয়েসে। মা কাজ সেরে দরজা বন্ধ করে অর্গান বাজাতে বসে পড়তেন। রান্নাঘরে মাছের ঝোলের ডেকচির ঢাকনা খুলে একটা মাছ নিয়ে গিয়ে আমি ঠাকুমার মুখের সামনে ধরতাম। ঠাকুমা চোখ খুলে অদ্ভুত ভাবে তাকিয়ে থাকতেন আমার দিকে। দূরের বন্ধ দরজার ভেতর থেকে ‘হায় গো, ব্যথায় কথা যায় ডুবে যায়, যায় গো’-র সুর ভেসে আসছে, কলতলা থেকে চৌবাচ্চা ছাপিয়ে জল ভেসে যাচ্ছে অদ্ভুত শব্দ করে। মন্ত্রমুগ্ধের মতন আমার হাত থেকে মাছ খেতেন ঠাকুমা। দৌ়ড়ে গিয়ে আর একটা মাছ, তার পর আবার দৌড়ে গিয়ে আরও একটা মাছ... এ ভাবেই কেটে গেল বেশ কিছু দিন। অর্গানের সুর, ঠাকুমার মাছ চিবোনোর শব্দ, আর তার সঙ্গে ঠাকুমার অদ্ভুত সুন্দর চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়া আমাকে পাগল করে দিত। এক দিন সমস্ত মাছ ঠাকুমাকে খাইয়ে দিলাম। ধরাও পড়ে গেলাম। মা হাত বেঁধে ভাঁড়ার ঘরে ঢুকিয়ে দিয়ে বাইরে থেকে ছিটকিনি তুলে দিলেন। এখনও মনে আছে, সারা রাত জেগে সে দিন একশো বারোটা টিকটিকি গুনেছিলাম। সবচেয়ে মোটাটা বলেছিল, বিধবাকে মাছ খাওয়ানো? শালা! এই বার চার পায়ে হাঁট আমাদের সঙ্গে।

প্রত্যেক মাসে বাবা ঠাকুমার হাতে পাঁচ টাকা দিতেন তাঁর নিজস্ব খরচের জন্য। ঠাকুমা পান-দোক্তা কিছুই খেতেন না। শুধু মাঝে মাঝে পোস্টকার্ড এনে দিতাম, আর ঠাকুমা চিঠি লিখতেন তাঁর সইকে। বলতেন, ‘দেখবি এক দিন আইব। আমার জন্য তার পরানটা কান্দে। আইবই, থাকব তোগো সঙ্গে।’ কোনও দিন আসেনি ঠাকুমার সই, কোনও দিন দেখা হয়নি তার সঙ্গে। বাড়ির সামনে একটা দোকানে বিস্কুট পাওয়া যেত, কোনওটা হাতি, কোনওটা ঘোড়া, কোনওটা পাখি। ঠাকুমার কাছ থেকে পয়সা নিয়ে সেই বিস্কুট কিনে আনতাম। বাড়ির সবাই খেয়ে ঘুমিয়ে পড়লে ঠাকুমা আর আমি চুপ করে পাশাপাশি বসে বিস্কুটগুলো খুঁটে খুঁটে খেতাম। এক দিন পয়সা নিয়ে দৌড়ে যেতে যেতে, মাঝরাস্তায় হাত খুলে দেখি, অদ্ভুত এক পয়সা! কোনও দিন আগে দেখিনি, কারও সঙ্গে মিল নেই সেই পয়সার। সালটা ১৯৫৭। জানতামই না, কয়েক দিন আগে থেকে বাজারে এক আনা, দু’আনা, চার আনার বদলে চলে এসেছে নতুন পয়সা।

এর পরে পরেই হঠাৎ এক দিন দেখি, থালা থেকে ভাত উধাও। মা গম ভেঙে খিচুড়ি করেছেন ডাল দিয়ে। থালার কোণে অনেকটা দূরে ছোট্ট এক টুকরো মাছ। এ ভাবেই চলল বেশ কিছু দিন। মাছটাও উধাও হয়ে গেল এক দিন। চাল পাওয়া যাচ্ছে না, অন্যান্য জিনিস বাড়ন্ত, সব কিছুর দাম আকাশছোঁয়া। আমার সরকারি ডাক্তারবাবু-বাবারও সাধ্য নেই সন্তানদের ভাত জোটানোর। সামনের ছোট কোয়ার্টার্সটার উঠোনে, কম্পাউন্ডার কাকুর বউ ঠোঁটে চিরুনি টিপে বিশাল বড় পেট নিয়ে ঘুরে বেড়াতেন। তার পর ঝুপ করে এক দিন দুটো বাচ্চা হয়ে গেল একসঙ্গে। কম্পাউন্ডার কাকু কী খুশি, একটাই জোটে না তায় দু-দুটো ছেলে! এক জনের নাম ক্রুশ্চেভ হাঁসদা, আর এক জনের বুলগানিন হাঁসদা। বাচ্চাদুটোর চিল-চিৎকার ছাপিয়ে রেডিয়োয় ভেসে আসত পণ্ডিত জওহরলাল নেহরুর গলা, নেহরু বলছেন তাঁর পুরনো সেই কথা... খক খক... দেশে যত ব্ল্যাক মার্কেটিয়ার আছে, তাদের মেরে ল্যাম্পপোস্টে ঝুলিয়ে দেওয়া হবে। হে হে... খবরকাগজে এক দিন নেহরুর সঙ্গে তাঁর সদ্য-যুবতী কন্যার ছবি বেরল। কী হাসি দুজনের, কী হাত নাড়া, কী সুন্দর দাঁত ইন্দিরার!

কয়েক দিন পর ভোরবেলা কানের কাছে দাদা ফিসফিস করছেন, ঘুম ভেঙে আমি ফিসফিস করলাম ছোটভাইয়ের কানে, ছোটভাই ফিসফিস করল বোনের কানে। কাউকে না জানিয়ে আমরা চার জন ছুটতে শুরু করলাম। একটা বিশাল গাছকে ঘিরে বেশ কিছু মানুষ দাঁড়িয়ে আছে। কেউ দাঁত ঘষছে নিমের ডাল দিয়ে, কেউ নুন আর তেল দিয়ে দাঁত মাজছে, কেউ সাতসকালেই পেয়ারা খাচ্ছে, আর গাছে ঝুলছে তিনটে শরীর। ফিরে আসতে আসতে দাদা বললেন, এরা আসলে ব্ল্যাক মার্কেটিয়ার। নেহরু এদের শাস্তি দিয়েছেন। পরে জেনেছিলাম, মাধব নামে এক জন না খেতে পেয়ে বউ আর মেয়েকে নিয়ে গাছে ঝুলে পড়েছে। স্বাধীন ভারতবর্ষে আমার দেখা প্রথম নাঙ্গা-ভুখার আত্মহত্যা। দূর থেকে বাড়ি দেখা যাচ্ছে। মা ঘুম থেকে উঠে স্নান করে অর্গান নিয়ে বসেছেন। সুর বাজছে, ভারত আবার জগৎসভায় শ্রেষ্ঠ আসন লবে। সেই আমার বালকবেলার দেশ-প্রেম ও দেশ-অপ্রেমের শুরু।


বিঃদ্রঃ বিষয়টা আমার বাবার কাছ থেকে শোনা। তারই জীবনের একটা ছোট্ট দুঃখের মুহুর্ত।।
সর্বশেষ এডিট : ১৫ ই মে, ২০১৬ রাত ১১:৪৯
৫টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আমেরিকানরা ভীষণ কনজারভেটিভ

লিখেছেন মুনতাসির, ০৬ ই নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ১০:২৬

আমেরিকা নিয়ে মন্তব্য করার যোগ্যতা আমার নেই—এটা প্রথমেই বলে ফেলা ভালো। আমি শুধু আমার অভিজ্ঞতার কথা বলছি। আমেরিকা তথা উত্তর আমেরিকাতে আমার যাওয়া হয়েছে বেশ কিছুবার। সবগুলো ভ্রমণ যোগ করলে... ...বাকিটুকু পড়ুন

যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনী ফলাফলে বাংলাদেশের জন্য দুশ্চিন্তা নেই

লিখেছেন মেঠোপথ২৩, ০৬ ই নভেম্বর, ২০২৪ দুপুর ১:২১

যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনী ফলাফলে বাংলাদেশের জন্য দুশ্চিন্তা নেই

ট্রাম্প হচ্ছে একজন আপাদমস্তক বিজনেসম্যান। কমলা হ্যা্রিস যেহেতু ইন্ডিয়ান বংশোদ্ভূত তাই ইন্ডিয়ান ভোটার টানার জন্য সে নির্বাচনের আগে বাংলাদেশ প্রসঙ্গ টেনে জাস্ট... ...বাকিটুকু পড়ুন

চট্রগ্রামে যৌথবাহিনীর ওপর ইসকনের এসিড হামলা সাত পুলিশ আহত।

লিখেছেন তানভির জুমার, ০৬ ই নভেম্বর, ২০২৪ দুপুর ১:৪৩

এসিড নিক্ষেপে আহত পুলিশ সদস্য



চট্টগ্রামে পুলিশের ওপর ইসকন সমর্থকদের হামলা ও এসিড নিক্ষেপের ঘটনা ঘটেছে। এ ঘটনায় সাত পুলিশ সদস্য আহত হয়েছেন। মঙ্গলবার (৫ নভেম্বর) সন্ধ্যা থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত... ...বাকিটুকু পড়ুন

মানব সভ্যতা চিরতরে ধ্বংস হবে কি করে?

লিখেছেন রাজীব নুর, ০৬ ই নভেম্বর, ২০২৪ দুপুর ২:৪৬



সে এক বড় অদ্ভুত বিষয়।
চিন্তা করে দেখুন এত দিনের চেনা পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাবে। বিশাল বিশাল ইমারত ভেঙ্গে যাবে, গুড়িয়ে যাবে। মানুষ গুহা থেকে বেরিয়ে আজকের আধুনিক... ...বাকিটুকু পড়ুন

ইসকন

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ০৬ ই নভেম্বর, ২০২৪ দুপুর ২:৪৭


INTERNATIONAL SOCIETY FOR KRISHNA CONSCIOUSNESS যার সংক্ষিপ্ত রূপ হলো ISKCON এর বাংলা অর্থ হল আন্তর্জাতিক কৃষ্ণভাবনামৃত সংঘ। যে সংঘের ঘোষিত উদ্দেশ্য হল মানুষকে কৃষ্ণভাবনাময় করে তোলার মাধ্যমে পৃথিবীতে প্রকৃত... ...বাকিটুকু পড়ুন

×