somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ফিকে হয়ে যাওয়া ভাষার গল্প

১৩ ই মার্চ, ২০১২ রাত ১:০৭
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

কলমের নিবটা রেডি হয়ে আছে। মারকারি বাতি থেকে একটা ফ্যাকাশে আলো এসে কলমের নিবটার ছায়া ফেলছে আমার ময়লা রঙের ডায়রির পাতার উপর। সেই ছায়াটা দেখে কলমের নিবকে আমার মিলিটারির বন্দুকের মতো লাগছে। এই প্রথমবারের মতো সে ব্যবহৃত হবে। এই ব্যবহারটুকুর জন্য তাকে কত শত বৈজ্ঞানিক, প্রায়োগিক ক্রিয়া-বিক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে। কত গবেষণা হয়েছে এই নিবটা তৈরির জন্য। তবে সে নিব হয়েছে। আমি এটা কিনেছি। এবং এটা দিয়ে আমার ময়লাটে ডায়েরির আরেকটা পাতা নষ্ট করছি। পাতাটা আস্তে আস্তে কালো গোটা অক্ষরে ভরে উঠছে। এইসব শব্দ-অক্ষর এই পাতায় লিখিত হয়ে হয়ে পাতাটাকে কী একটা বানিয়ে ফেলছে। অথচ পাতাটা আরো কত কিছু হতে পারত। কত অসীম সম্ভাবনা ছিল পাতাটার। একটা মিলিটারি নিব পাতাটাকে কেবল একটা ‘নির্দিষ্ট’ পাতা বানিয়ে ফেলল। এমন একটা পাতা যা ঘুরে ফিরে এই কলমের নিবটার কথাই বলে! এই জন্য পাতাটার কি একটু মন খারাপ হওয়া উচিত না? পাতাটা আমার কলমের তলায় না পড়ে টলস্টয় কি ফকনারের কলমের তলায়ও পড়তে পারত! সব পাতার সব ভাগ্য হয় না।

তবে এই পাতাটা কিংবা পাতাগুলো নিপাট সফেদও পড়ে থাকতে পারত। আজন্মকাল। তারপর বাড়িবদলের সময় ওজন কমানোর প্ররোচনায় ডায়েরিটা হয়তো ছুঁড়ে দিতাম গারবেজ ক্যানে। আজন্ম শূন্য থাকা মানে তো অসীম সম্ভাবনা নিয়েই পড়ে থাকা। ‘আনা কারেনিনা’ কিংবা ‘সাউন্ডস অ্যান্ড দ্য ফারি‘র সম্ভাবনাও সেই অসীমের মধ্যে পড়ে। সে এক দিক দিয়ে ভালোই। কিন্তু কলমের নিবের এই বেখেয়াল ঘষাঘষি যার জন্ম দিচ্ছে তার সম্ভাবনাকেও 'একক' বলা যাচ্ছে না। কারণ পাতাটা লিখিত হয়ে গেল মানেই তো আর ‘নির্দিষ্ট’ হয়ে গেল না। অসীম পাঠকের কাছে এই বস্তু অসীম রূপে ধরা দেবে, মা লক্ষ্মী এবং মা সরস্বতী যদি সহায় হন।

আজকে আমি যে গল্পটা লিখতে বসেছি তার নাম ‘ভাষা’। গতকাল এই দেশে একুশে ফেব্রুয়ারি ছিল। ‘একুশে ফেব্রুয়ারি’ এমন একটা শব্দগুচ্ছ হয়ে গেছে যে এটাকে নিছক তারিখ আর ভাবা যায় না। যখন রংপুরে থাকতাম, একুশে ফেব্রুয়ারি নিয়ে কোনো মাতামাতির মধ্যে ঢোকা হয়নি। আমার বড় হয়ে ওঠা যেহেতু রংপুরে, একুশে ফেব্রুয়ারি আমার জন্য আলাদা দিন হিসাবে অর্থবহ ঞয়ে ওঠেনি সেভাবে। একুশের স্মৃতি ভাবলে আমার গভীর বাল্যকালের স্মৃতি মনে পড়ে। ঝাপসা একটা সকাল মনে আসে। আমি তখন রাজারহাটে। ক্লাস ওয়ান-টুয়ে পড়ি। আমাদের রাজারহাটের যে প্রধান সড়ক, যে রাস্তাটাকে ‘সড়ক’ বলা যায় কি-না সেটাও একটা বিতর্কের ব্যাপার, সেই ‘সড়ক’টা তখন হেরিং বন্ডের ছিল। রাস্তায় পিচ ঢালার আগে ইট বিছানো হয়। কিন্তু ইট বিছিয়ে ফেলার পর বছরের পর বছর কোনো এক কারণে রাস্তাগুলোতে আর পিচ ঢালা হতো না। এবড়ো থেবড়ো ইটের কারণে রাস্তাগুলো হয়ে উঠত ভয়ঙ্কর। সেই রাস্তার নাম হেরিং বন্ড। আমার মনে পড়ছে, কোনো এক একুশের সকালে, ঝাপসা একটা রাস্তা দিয়ে আমি আমার ছোটফুপুর হাত ধরে খালি পায়ে রাজারহাট কলেজের দিকে হেঁটে যাচ্ছি। আমার হাতে আমাদের বাসার সামনের গাঁদা ফুলের গাছ থেকে ছিঁড়ে নেওয়া দুটো গাঁদা ফুল। ছোটফুপুর হাতেও কয়েকটা ফুল। রাস্তাটার উপরে একটা বটগাছ। সেখানে একুশে ফেব্রুয়ারির ভলান্টিয়াররা সবার পোশাকে কালো ব্যাজ এঁটে দিচ্ছে পিন দিয়ে। আমিও ছোটফুপুর পিছ পিছ ভলান্টিয়ারদের সামনে এসে দাঁড়াই, শরীরে কালো ব্যাজ এঁটে নেওয়ার জন্য। রাজারহাট কলেজের পাশেই রাজারহাট হাই স্কুল। আমরা যখন পৌঁছাই ততক্ষণে সেখানে ধুন্দুমার লেগে গেছে। মাঠের একদিকে শহীদ মিনারে ফুল দেওয়ার জন্য মানুষের ঠেলাঠেলি। অন্যদিকে শীতের শিশির পায়ে মেখে অ্যাথলেটরা দৌড়াচ্ছে, লাফ দিচ্ছে, দড়ি টানাটানি করছে, মেয়েরা খেলছে চেয়ার খেলা। স্কুল এবং কলেজের মাঠ দুটোর ঠিক কেন্দ্রে একটা করে লম্বা বাঁশ পোঁতা। বাঁশের মাথায় বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা। বাঁশ থেকে মাটিতে নেমে এসেছে লম্বা দড়ি। দড়িগুলো পোঁতা মাটিতে। আর দড়ির গা-জুড়ে লাল-নীল-বেগুনি কাগজের তিনকোনা পতাকা। মাইকে শাহনাজ রহমতুল্লাহর গলা। এসবের ফাঁকে বাচ্চাদের জন্য একটা দৌড়ের আয়োজনও ছিল মনে হয়। সে দৌড়ে অংশ নিয়ে আমি পেয়েছিলাম একটা সান্ত্বনা পুরস্কার, একটা কলম। আমার মনে আছে, একটা ইকোনো কলম। কলমটা এত সাদামাটা ছিল যে আর ওর গায়ে সান্ত্বনা কথাটা এত ম্যাটম্যাটে ভাবে লেপ্টে ছিল যে একুশে ফেব্রুয়ারির কথা মনে পড়লে আমার আজও এই কলমটার কথা মনে পড়ে।

বাংলাদেশে ‘চেতনা’ বলে যে শব্দটা ব্যবহার করা হয় সেটা খুব মারাত্মক একটা শব্দ। ‘মুক্তিযুদ্ধ’, ‘একুশ’—সবকিছুর সঙ্গে চেতনা চাপিয়ে দিয়ে অর্থেরও অতিরিক্ত অর্থ আরোপ করা হয়। তাই মুক্তিযুদ্ধ কিংবা একুশ ভাবলেই আমরা এমন একটা কিছু ভেবে বসি যে আমাদের মনে পবিত্রতার ভাব চলে আসে। আমরা শ্রদ্ধায় অধোবদন হই, মাথা নুয়ে আসে আমাদের। একুশ কিংবা মুক্তিযুদ্ধ আমাদের ধরাছোঁয়ার বস্তু থাকে না আর, কারণ এগুলো পবিত্র বস্তু এবং ধরে ফেললে, ছুঁয়ে ফেললেই তো পবিত্রতা ছুটে গেল। এভাবে মুক্তিযুদ্ধ কিংবা একুশ রাষ্ট্রের হয়ে যায়, মানুষের আর থাকে না।

এখনও বাংলাদেশে ভাষার শুদ্ধতা রক্ষা নিয়ে পুলিশগিরি চলছে। এমতাবস্থায় একুশ নিয়ে আমার কোনো পবিত্র স্মৃতি হাজির করতে পারছি না। একুশের সঙ্গে আমার একটা অতৃপ্তিবোধের স্মৃতি বিজড়িত। প্রার্থনা করি, পবিত্রতার ঘাটতি ব্লাসফেমি হিসাবে বিবেচিত হবে না!

এবার ভাষার গল্পে ফিরি। এই গল্পটা শুনেছি আমার বাড়ি থেকে দুই ব্লক দূরে যে স্যালুন তার মহিলা নাপিতের মুখে। মহিলার বাড়ি মেক্সিকো। চুল কাটানোর ফঁাকে মেক্সিকো নিয়ে তিনি কথা বলছিলেন। জিজ্ঞাসা করলাম, মেক্সিকোর সবাই কি স্পেনিশ বলে? মেক্সিকোর নিজের ভাষাটা কী? মহিলা বললেন, মেক্সিকোর গ্রামে গঞ্জে এখনও প্রচুর মানুষ পাওয়া যায় যারা স্পেনিশে কথা বলে না। কথা বলে তাদের আঞ্চলিক ভাষায়। বলে রাখা দরকার, স্পেনিশরা সম্ভবত পৃথিবীর ভয়ঙ্করতম উপনিবেশী। লাতিন আমেরিকার দেশগুলোতে স্পেনিশে কথা না বলার অপরাধে প্রচুর মানুষকে তারা খুন করেছে। আঞ্চলিক ভাষায় লেখা বইপত্র পুড়িয়ে দিয়ে এমন অবস্থা নিশ্চিত করেছে যাতে স্পেনিশ ছাড়া অন্য ভাষায় কেউ কথা না বলে। তো, তারপরও, মেক্সিকোতে এখনও অনেক আদিবাসী আছেন যাদের ভাষা স্পেনিশ না। নাপিত মহিলা এমন দুই আদিবাসীর গল্প শোনালেন যারা স্পেনিশে কথা বলেন না। কিন্তু মজার ব্যাপার হলো তারা দুজন এমন এক ভাষায় কথা বলেন, যে ভাষায় কথা বলা মানুষদের মধ্যে কেবল তারা দুজনই জীবিত আছেন। তাদের যেকোনো একজন মারা গেলেই এই ভাষায় মানুষ আর মানুষের সঙ্গে কথা বলবে না। এই তথ্যটা আমি আগেও কোথাও শুনেছিলাম। কিন্তু মেক্সিকান এই মহিলার কাছ থেকে শুনে কেমন শিউরে উঠলাম। নিজেকে ওই দুজন আদিবাসীর একজন হিসাবে ভাবলাম এবং উপলব্ধি করলাম, তত্ত্বের বাইরে ভাষা নিছকই একটা আটপৌরে দরকার। অথচ মানুষের ‘থাকা’র সঙ্গে এই দরকারের যোগ কত গভীর।

২২ ফেব্রুয়ারি ২০১২
শিকাগো।
০টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

বেফাঁস মন্তব্য করায় সমালোচনার মুখে সমন্বয়ক হাসিবুল ইসলাম !

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ০৩ রা নভেম্বর, ২০২৪ রাত ১১:৩২



"মেট্রোরেলে আগুন না দিলে, পুলিশ না মারলে বিপ্লব সফল হতো না "- সাম্প্রতিক সময়ে ডিবিসি নিউজে দেয়া সাক্ষাৎকারে এমন মন্তব্য করে সমালোচনার শিকার বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনের সমন্বয়ক হাসিবুল... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমিত্ব বিসর্জন

লিখেছেন আজব লিংকন, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ রাত ১:৪৮



আমি- আমি- আমি
আমিত্ব বিসর্জন দিতে চাই।
আমি বলতে তুমি; তুমি বলতে আমি।
তবুও, "আমরা" অথবা "আমাদের"
সমঅধিকার- ভালোবাসার জন্ম দেয়।

"সারভাইভাল অব দ্য ফিটেস্ট"
যেখানে লাখ লাখ শুক্রাণুকে পরাজিত করে
আমরা জীবনের দৌড়ে জন্ম... ...বাকিটুকু পড়ুন

স্বৈরাচারী আওয়ামীলীগ হঠাৎ মেহজাবীনের পিছে লাগছে কেন ?

লিখেছেন শিশির খান ১৪, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ৭:৪১


স্বৈরচারী আওয়ামীলীগ এইবার অভিনেত্রী মেহজাবীনের পিছনে লাগছে। ৫ ই আগস্ট মেহজাবীন তার ফেসবুক স্ট্যাটাসে লিখেছিলেন ‘স্বাধীন’। সেই স্ট্যাটাসের স্ক্রিনশট যুক্ত করে অভিনেত্রীকে উদ্দেশ্য করে আওয়ামী লীগ তার অফিসিয়াল ফেইসবুকে... ...বাকিটুকু পড়ুন

বিড়াল নিয়ে হাদিস কি বলে?

লিখেছেন রাজীব নুর, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ৯:২৪



সব কিছু নিয়ে হাদিস আছে।
অবশ্যই হাদিস গুলো বানোয়াট। হ্যা বানোয়াট। এক মুখ থেকে আরেক মুখে কথা গেলেই কিছুটা বদলে যায়। নবীজি মৃত্যুর ২/৩ শ বছর পর হাদিস লিখা শুরু... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। বকেয়া না মেটালে ৭ নভেম্বরের পর বাংলাদেশকে আর বিদ্যুৎ দেবে না আদানি গোষ্ঠী

লিখেছেন শাহ আজিজ, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ৯:৪১





বকেয়া বৃদ্ধি পেয়ে হয়েছে কোটি কোটি টাকা। ৭ নভেম্বরের মধ্যে তা না মেটালে বাংলাদেশকে আর বিদ্যুৎ দেবে না গৌতম আদানির গোষ্ঠী। ‘দ্য টাইম্স অফ ইন্ডিয়া’-র একটি প্রতিবেদনে এমনটাই... ...বাকিটুকু পড়ুন

×