আব্বুর একটা ইয়ামাহা মোটরসাইকেল ছিল। সেভেন্টি সিসি। সবুজ রঙের। মোটরসাইকেলটার একটা গল্প আছে। আমি ভুলেই গেছিলাম। আব্বু ভোলেনি। বছর দুয়েক আগের একটা পারিবারিক আড্ডায় আব্বু কথাটা পাড়লো। আমার সঙ্গে সঙ্গে মনে হলো, আরে তাইতো!
আমাদের রাজারহাটের বাসাটার সামনে দিয়ে একটা চিকন রাস্তা সোজা গিয়ে ঠেকেছে বড় রাস্তায়। চিকন রাস্তাটা আর বড় রাস্তাটা যেখানে এক হয়েছে সেখানে একটা কংক্রিটের পুল। কংক্রিটের পুলটা তৈরির উদ্দেশ্য ছিল এর নিচ দিয়ে পানি যেতে দেওয়া। রাস্তাটার দুই পাড়েই ধানের জমি। গভীর নলকূপের পানি কংক্রিটের পুলটার নিচ দিয়ে এক জমি থেকে আরেক জমিতে যেত। প্রতিদিন বিকালবেলা আমি গিয়ে বসে থাকতাম কংক্রিটের পুলটাতে। পুলের নিচে কে যেন বঁাশের জাল বঁেধে রাখতো। জালের সামনে এসে পানি কেমন খলবলিয়ে উঠত। পানির দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে আমার পা শিরশির করতো। নিশ্চয়ই লাফ দেওয়ার জন্যই। কিন্তু লাফঝঁাপ দেওয়া আমার ধাতে ছিল না। বড় রাস্তার উপর দুলালের দোকান থেকে এক টাকায় দুটো বেবি লজেন্স কিনে খোসা ছাড়াতে ছাড়াতে আমি পুলের উপর পা ছড়িয়ে বসে থাকতাম। কখন আব্বু ফিরবে!
আকাশ আলো পাল্টানো শুরু করতে না করতেই আব্বুর দেখা মিলত। সবুজ রঙের ইয়ামাহা সেভেন্টি সিসি। পুলের সামনে এসে আব্বু মোটরসাইকেলটা থামাত। আমি আব্বুর পিছে গিয়ে বসতাম। পুলের সামনে থেকে আমাদের বাসা—এই প্রায় শ'তিনেক গজ দূরত্ব আমি ইয়ামাহায় করে পাড়ি দিতাম। এই তিনশ' গজের আনন্দের জন্য এতক্ষণ বসে থাকা! এবং সপ্তাহের ছয়দিন বসে থাকা। ছয়দিনে প্রায় আঠারোশ' গজ। প্রায় এক মাইল!
কোনো এক সন্ধ্যায়, নাকি রাতে আমাদের বাসার ছোট্ট উঠানে মোটরসাইকেলটা আড়াআড়ি করে রাখা হলো। মোটরসাইকেলটাতে কোনো একটা অচেনা আলো এসে ঠোকর দিচ্ছিল বোধহয়। তাই আমার এখনও মনে আছে, মোটরসাইকেলটার ছিল সবুজ পিঠ। দুজন অচেনা লোক ওইদিন আমাদের বাসায় এসেছিল। তারা অচেনা ভঙ্গিতে কথাবার্তা বলছিল। একটুপর সবুজ ইয়ামাহাটা নিয়ে তারা বিদায় হলো। আমাকে জানানো হলো, আব্বু মোটরসাইকেলটা বিক্রি করে দিয়েছে। তার মানে এখন থেকে আমার বিকালগুলো অন্যরকম হবে। অন্য অনেক কিছুর মতোই ব্যাপারটা আমি মেনে নিলাম। আমি শান্ত এবং ভদ্র ছিলাম। সবকিছু মেনে নেওয়া ছিল আমার স্বভাব।
এই ঘটনা লিখতে গিয়ে এখন মনে পড়ছে, সবুজ মোটরসাইকেলটা এখন কোথায় আছে? আদৌ আছে তো? হয়তো রাজারহাটের কোনো মোটর মেকানিকের দোকানের সামনে দঁাড়িয়ে থাকা মোটরসাইকেলের কঙ্কালটাই সেই সবুজ ইয়ামাহা। আমাদের স্মৃতিগুলোও কি এমন কঙ্কাল হয়ে দঁাড়িয়ে থাকে? না, থাকে না। স্মৃতির শরীরে আমরা নতুন করে রক্তমাংস গঁেথে দিই। স্মৃতি সবসময় সশরীর, রক্তমাংসের জীবিত মানুষের মতো স্মৃতিরও খলবলে স্বভাব।
আব্বুর সঙ্গে আমার অভিজ্ঞতা সবসময়ই মিশ্র। বুয়েট থেকে বেরোনোর পর হঠাৎ করে যখন পত্রিকায় টুকটাক লেখা শুরু করলাম, আমার পরিবার থেকে আমাকে চাপ দেওয়া শুরু হলো। সরাসরি লেখা ছেড়ে দেওয়ার কথা বলা হলো না। বলা হলো, বিদেশে যাওয়ার প্রস্তুতি নিতে, বিদেশে গিয়ে বড় ডিগ্রা নিতে। এর পাশাপাশি ‘হবি’ হিসাবে লেখালেখি করা যেতে পারে। আমার ছোট চাচা আমেরিকায় থাকেন। সেখান থেকে ফোন করে কড়া ভাষায় লেখালেখিতে সময় নষ্ট না করে বিদেশে আসার প্রস্তুতি শুরু করতে বললেন। বললেন, এসব প্যানপ্যানানি জিনিস লিখে কী হবে? তুমি যদি লেখক হও তোমার পরিচয় মানুষকে আমরা কীভাবে দিব? তার কথাবর্াতায় আমার খুব অভিমান হলো। যদিও তিনি দুদিন পরেই মেইল করে সরি-টরি বললেন কিন্তু আমার অভিমান গেল না। খুব অপমানিত বোধ করলাম। কেন জানি মনে হলো, এই সবকিছুর পিছনে আছে আব্বু। আব্বু চায় না আমি লিখি। কিন্তু নিজ মুখে বলতে পারছে না বলে অন্যকে দিয়ে বলাচ্ছে।
ফলাফল যেটা হলো, আমি লেখালিখি বাড়িয়ে দিলাম। যদিও পরে একটা সময় দেশের বাইরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম, কিন্তু আব্বুর উপর রাগটা গেল না।
বছরখানেকের ক্লান্তিকর চেষ্টার পর আমেরিকা যাওয়াটা নিশ্চিত হয়েছিল ২০০৯-এ। আমেরিকায় আসার মাসতিনেক আগে রংপুরে আমাদের বাসায় গিয়েছি। পত্রিকার স্তূপ ঘঁেটে পুরোনো পত্রিকা বের করে পড়া আমার অভ্যাস। আমাদের রংপুরের বাসার বসার ঘরে একটা শো-কেস মতো করা হয়েছে। এর উপরের তাকগুলোতে বই থাকে। নিচের বড় বড় তাকগুলোতে আব্বু পুরোনো পত্রিকা জমিয়ে রেখেছে। এক রাতে আমি নিচের তাকগুলো খুলে পুরোনো পত্রিকা ঘঁাটছিলাম। কয়েক বছরের ঈদসংখ্যা সেখানে। জনকণ্ঠ, প্রথম আলো আর ইত্তেফাকের বোধহয়। হঠাৎ দেখি ঈদসংখ্যাগুলোর ফঁাকে বেশকিছু দৈনিক পত্রিকার পাতা। আমি পাতাগুলো বের করে উল্টেপাল্টে দেখলাম। প্রতিটা পাতাতেই আমার লেখা। এগুলো আসলে পত্রিকায় আসা আমার ছোটখাট লেখাগুলো। বুক রিভিউ, অনুবাদ, সাক্ষাৎকার। আব্বু সবগুলো রেখে দিয়েছে। একটাও বাদ দেয়নি। মানুষের জীবনের বড় বড় উপহারগুলো তার হাতে কেউ তুলে দেয় না আসলে। পত্রিকার স্তূপে লুকিয়ে রাখে!