বছরটা এবং তারিখটা এই মূহূর্তে সঠিক মনে করতে পারছি না। আমার আবার ডাইরী লেখার তেমন অভ্যাস নাই। (সম্ভবত ২০০৯)
সেই বছর ঈদুল ফিতরের পর পরই দূর্গা পূজার ছুটি হয় তাই বেশ লম্বা ছুটি।
যা হোক যে দিনের কথা বলছিলাম, ঘটনাটা কিশোরগঞ্জ সদরে ঘটা, আমার নানুবাড়ি সেদিন “বত্রিশ” এলাকায় নাঈমের নানুবাড়িতে একবোতল কোক শেষ করে, বিকাল চারটা নাগাদ বের হই, পূজা দেখতে দেখতে আসতে থাকি।
তখন সন্ধ্যাও হয় নি . . সূর্য হেলে পড়েছে। “মনসা” সিনেমা হলে কাছে এসে দেখি ‘ডিপজল’ এর মুভি ‘মায়ের দোয়া বেহেশতের চাবি’ সিনেমাটি চলছে। মাথায় কি যে ‘ভূত’ চাপলো ঠিক করলাম এই সিনেমাটি দেখব। তখনও হলে কেচি গেইট বন্ধ আর আগের শো শেষ হয়নি। নাইমকে বললাম “DC” এর দু’টি টিকিট কাটতে। ২৫টাকা করে দু’টি “DC” এর টিকিট কাটি আরামে সিনেমা দেখব বলে।
হলে ঢোকার আগে আমি চা খেলাম, আর নাঈম কয়েকটা সিগারেট কিনল, মাথায় ধোঁয়া না গেলে তার চোখ পরিস্কার হয় না। তাই বলে, সে হলের ভিতরে সিগারেট টানবে! কিন্তু সে যা উত্তর দিল তাতে, আমার হাঁ করে তাকিয়ে থাকা ছাড়া কিছুই বলার ছিল না। –“আরে মিয়া হলের ভিতরে সিগারট বেশী দাম নেয়।” আমি ভালা পোলা আমার কাছে আবার গাঁজা, মদ, সিগারেট হারাম। একবোতল কোক শেষ করার প্রতিক্রিয়া হিসেবে নিম্নচাপ। এটা হলের বাথরুম! চরম গরম সব সিনেমার ডায়লগে ভর্তি। আর লাইনটা টিকিট কেনার লাইন থেকে কম বড় না। আমাদের অবস্থা বেশ করুন তাই হলের পাশে ছোট ডোবায় ‘---’ সারলাম, আমাদের সাথে যারা অংশ নিচ্ছি তাদেরও মনে হয়ে একই “অবস্থা”।
তো দেখলাম সবাই গেটের সামনে জড়ো হচ্ছে বুঝলাম শো শেষ নাঈম আমাকে এক প্রকারে টেনেই নিয়ে যাচ্ছি, বলছিল- ‘ আইয়ো মিয়া ফরে জায়গা ফাইতাম না।’ বুঝলাম না আমাদের কাছে তো “DC”এর নাম্বার করা টিকিট রয়েছে, তাহলে তাড়াতাড়ি যাওয়ার কি হল? যেই মাত্র হলে কেচি গেটটা খুললো দেখলা সবাই অতি হুড়োহুড়ি করে ঢুকছে, দেখেই ধরে নেয়া যায় যে, এদের সবার ঢাকায় লোকাল বাসে চড়া অভ্যাস আছে। “DC”তে যাবার সিড়িঁটা বাইরের দিকে তাও আবার মোটামুটি পুরোনো।
হলের ভিতরে “DC”তে ঢুকে আমিতো হতবাক! সিনেপ্লেক্সের মত অতি সুন্দর কোন গদিওলা সিট দেখবেন ভেবেছিলেন? . . ..ভুলে যান!
হঠাৎ তামাকের প্রচন্ড গন্ধ নাকে বাড়ি দিল, আলো থেকে হঠাৎ আধাঁরে ঢুকে প্রথমে কিছু দেখতে পাচ্ছিলাম না, শুধু চিৎকার চেঁচামেচি, কিছু বোঝার আগেই পা কিসের সাথে যেন বাড়ি লাগে, বুঝলাম মেঝেটা কাঠের, তারপর, হালকা আলোয় দেখি আধা কাঠের ঘুনে ধরা লম্বা লম্বা বেঞ্চি, তার প্রায় সবগুলো ইতোমধ্যেই দখল হয়ে গেছে। তাকিয়ে দেখি একটি ছেলে বেঞ্চির উপরে পা ছড়িয়ে বসে একি ওদিক তাকাচ্ছে আর তার বন্ধু ও বান্ধবীদের ডাকছে। বুঝতে দেরি হলো না যে, “DC”র টিকেট দিয়ে হলের নীচ তলায় বসে সিনেমা দেখতে হবে। “ওয়াও! ডিপজলের সিনেমার তো পোলাপাইলে হেভি খায়।”
সে জায়গা দখল করার জন্যও আবার “দৌড়” দেই। গিয়ে যেখানে বসি তার উপরে “DC” এর কাঠের সিলিং।
তো সিনেমা শুরু হয়. .. ‘ডিপজল’ থাকে বাসার কাজের ছেলে . . . বাসার কাজের মেয়ের সাথে তার মাঝে মাঝে উত্তেযনাপূর্ণ ডায়লগে সারা হলজুড়ে হাত তালি,সিটি বাজায় কেউ, কেউবা করে উত্তেযনাপূর্ণ মন্তব্য।
আকস্মিক বিদুৎ চলে যায় জেনারেটর ছাড়া হয়, যাহার ঘররর...ঘররর শব্দ আমিও শুনতে পাচ্ছি। দেখি গরমে আমার সামনের পোলাপাইন গেঞ্জি খুলে খালি গা হয়ে গিয়েছে! একটু পড়ে আমার মামাতো ভাইটিও তার পরনে গেঞ্জি খুলে ফেলে। আমি ‘ভদ্র’ মানুষ হলেও কতক্ষণইবা গরম সহ্য করা যায়, তাই “গরমে নাই শরম” পড়নে টি-শার্টটি আমিও খুলে ফেললাম।
যা হোক সিনেমার বিরতির পর, চরম উত্তেযনাপূর্ণ কাহিনী চলছে, ‘ডিপলজকে ঘর থেকে বের করে দেয়া হয়েছে, তারপর সে তার সততা ও মায়ের দোয়ার জোড়ে প্রচুর পয়সাওলা, যেই মাকে (ডলে জহুর) তার ছেলেরা বের করে দিয়েছে, ডিপজল তাকে নিয়ে এসেছে।’ সেই সাথে দেখি ঝালমুড়িওলা, পান-বিড়ি সিগারেটওলা ফেরি করছে হলের ভিতরেই। আমারাও ঝালমুড়ি খাই, আর নাঈম সহ পোলাপাইনেরা তো বিড়ি-সিগারেট চলছেই। নাঈম তার মোবাইল খুজে পাচ্ছিল তখন। মনে করেছিলাম ঝালমুড়িওলা নিয়েছে। কিন্তু পরে দেখি তার প্যান্ট থেকে তা তার নীচে সিটে পড়ে গিয়েছিল।
‘ডিপজেল যাদের বাসায় কাজ কারতো সেই বাসার ভায়েরা ঋনের দায়ে জর্জরিত, ডিপজল ঠিক করল সেই সব ঋণ পরিশোধ করবে’ হা করে সিনেমার পর্দার দিকে তাকিয়ে আছি. . . . . তারপর হঠাৎ কিছু বুঝে ওঠার আগে .. .
ধুমধাম শব্দ. .. আমার মাথায় দেখি ধূলায় ভরে গেছে, কাঁধ আর পিঠও, পাশে তাকিয়ে দেখি আমার মামাতো ভাই নাঈমকে আমি চিনত পারছি না। তারও একই অবস্থা আর আমাদের পাশে পড়ে আছে “DC” এর আলগা কাঠবোর্ডের সিলিং বুঝতে বাকি রইল না যে, “DC” এর দর্শকদের পায়ের দাপাদাপিতে সিলিং ভেঙ্গে আমাদের মাথায় পরেছে। সবাই তখনও সিনেমার চরম মূহূর্ত নিয়ে ব্যস্ত, আর হল কতৃপক্ষেরও দেখা নাই।
চোখ জ্বলছে। কি আর কারা “ডিপজল” ভাইরে তার টাকার উপরে রাইখাই আমরা হল ত্যাগ করলাম।
বের হয়ে রাস্তায় যখন রিকশা নিচ্ছিলাম, কিছু উৎসুক দৃশ্য আমাদের দিকে তাকিয়ে ছিল। রিকশায় যখন উঠছি তখন আমাদের দু’জনের গায়ে পড়া ধূলা ঘামের সাথে মিশে ততক্ষণে কাঁদা পরিণত হচ্ছে।
নাঈম বলল-“বাসায় গেলে কইয়ো না যে, সিনেমা দেখতে গেছিলাম, কইবা স্পিকার হামিদের সভায় গেছিলাম। সভায় শেষে দৌড়ানি খাইছি”। সেদিন স্পিকার হামিদের জনসভা ছিল কিশোরগঞ্জ স্টেডিয়াম মাঠে।
মাথা ধোয়ার জন্য দুইটা “সানসিল্ক” মিনি প্যাক কিনলাম, আর একটা সিগারেট।